বিশ্বায়নের এই যুগে দূরত্বের সাথে সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতার তালিকা। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষের সব কর্মকাণ্ড এখন অতি সহজ হয়ে গেছে। প্রযুক্তির তেমনই এক প্লাটফর্ম বুকিং ডট কম। ইন্টারনেটের এই যুগে আমরা এই সাইটের সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে এই প্লাটফর্ম অতি পরিচিত এক না
হোটেল রিজার্ভেশনের জন্যে বিশ্ববাসীর কাছে এক আস্থার নাম হয়ে উঠেছে এই ওয়েবসাইটটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন এবং পরিচালিত বুকিং ডট কম বুকিং হোল্ডিংসের প্রাথমিক রাজস্ব উত্স। এই প্লাটফর্মটির সদরদপ্তর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অবস্থিত। বর্তমানে এই প্লাটফর্মের ২ কোটি ৮০ লাখের ওপর লিস্টিং আছে এবং এটি ৪৩ ভাষায় ব্যবহারযোগ্য।
ইতিহাস :
বর্তমানে কয়েক বছর ধরে এয়ারবিএনবি আতিথেয়তা এবং ভ্রমণ শিল্পে ভ্রমণকারীদের প্রচুর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, ঠিক তার আগে থেকেই হোম-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম বুকিং ডটকমই মূলত অনলাইন আবাসন খাতে আধিপত্য বিস্তারকারী প্রতিষ্ঠান। বুকিং ডটকমের ইতিহাস এয়ারবিএনবির মতো অল্প বয়স্ক সংস্থাগুলোর তুলনায় আরও অনেক আগের। বিগত কয়েক দশক ধরে কীভাবে অনলাইন আবাসন পরিবর্তন হয়েছে এই প্লাটফর্মের হাত ধরে তার এক ঝলক দেখে নেয়া যাক।
মূলত, বুকিংস ডট এনএল (Bookings.nl) হিসাবে নির্মিত, ছোট ইন্টারনেট সংস্থা একাধিক সংযুক্তি এবং অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে বুকিং হোল্ডিংসের অংশ হয়েছে। ১৯৯৯ সাল থেকে ন্যাসডাকের ওপর প্রকাশ্যে লেনদেন করা শুরু হয়েছে এবং এসএন্ডপি ১০০ এবং ৫০০ সূচকগুলোর একটি উপাদানে পরিণত হয়েছে।
ধীর প্রলয়ে শুরু সত্ত্বেও, বুকিং ডটকম ২০১৭ সালের জন্য বুকিং হোল্ডিংসের মোট মুনাফার প্রায় ৮৯ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করেছিল এবং গত ২০ বছরে বিশ্বজুড়ে হোটেল বুকিংয়ের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেরদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শুরুটা যেভাবে হলো?
১৯৯৬ সালে, বুকিং ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা গির্ত-জ্যান ব্রুইনস্মা হিলটন ডট কম হোটেলের মাধ্যমে এসেছিলেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেটে হিল্টন হোটেল রুম বুকিংয়ের অনুমতি দেয়। অনলাইনে আমস্টারডামে হোটেল রুম বুক করতে পারেন কিনা তা দেখার জন্য গির্ত প্রথমে চেষ্টা করে দেখলেন যে তা অসম্ভব না। আর তখনই তিনি অনলাইনে নেদারল্যান্ডসে থাকা কিংবা সেখানে যাওয়া লোকজনের জন্য একটি হোটেল রুম বুক করার ওয়েবসাইট তৈরির সিদ্ধান্ত নেন।
গির্ত হোটেল শিল্পের সাথে খুব ভালভাবে পরিচিত ছিল না, তবুও দ্রুত বুকিংস.এনএল সজ্জিত করে এবং হোটেলগুলোকে ৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে ওয়েবসাইটে তাদের কক্ষের ভাড়া নির্ধারণ করে শুরু করে দেয়। ১৯৯৭ সালে সংবাদপত্রে কোনও বিজ্ঞাপন বের করার চেষ্টা করেছিলেন। যেহেতু বিজ্ঞাপনগুলো কেবল ওয়েবসাইটের ঠিকানার জন্য প্রচারিত হতে পারে না এবং একটি ফোন নম্বর প্রয়োজন সেহেতু তখন তাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
গির্তের প্রাথমিক উদ্যোগে, বুকিংস.এনএল আমস্টারডামের হোটেল সম্পর্কিত দুটি ওয়েবসাইটের পেছনে ছিল, যার মধ্যে একটিও অনলাইন রিজার্ভেশন অফার করে না। একটি ই-মেইল ফর্মের মাধ্যমে রিজার্ভেশনের অনুমতি দেয় এবং অন্যটি কেবল হোটেলগুলোর জন্য একটি অনলাইন বিজ্ঞাপনের জায়গা। ঠিক তাই গির্ত বুকিং কমিশনের ওপর ৫০/৫০ বিভাজনের মাধ্যমে তাদের সাইটগুলো বুকিং ডট এনএল (Bookings.nl)-এ সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেয়।
আর গির্তের এই পদক্ষেপ তার ব্যবসায়ে দারুণ সুযোগ এনে দেয়। ১৯৯৮ সালের শেষদিকে তিনি তার সহযোগিতার জন্য অন্য এক ব্যক্তিকে নিয়োগ করেন। ২০০০ সালে, বুকিংস ডট এনএল বুকিং অনলাইন (Bookings Online)-এর সাথে একীভূত হয়েছিল। গির্ত ২০০২ সালে তার প্রতিষ্ঠানে আরও পাঁচজন কর্মচারী নিয়োগ করেন, সাথে সাথে বর্তমানে ব্যবহৃত বুকিং ডটকমের ইউআরএল ও গ্রহণ করেন সেসময়ে।
এর পরের কয়েক বছরেই, বুকিং ডটকম একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবহারকারীদের ভীত হিসেবে আকর্ষণ পায় এবং এক্সপিডিয়ার দ্বারা প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির আলোচনায় স্থান করে নেয়। প্রায় ছয় মাস কাজ করা এবং আলোচনার পরে, এক্সপিডিয়ার বোর্ড শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তারা ক্রয় করবে না। প্রায় তিন বছর পরে ২০০৫ সালে, প্রাইসলাইন গ্রুপ বুকিং ডটকমকে ১৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে এক্টিভ হোটেলস লিমিটেডের সাথে একীভূত করেছিল।
যদিও প্রাইসলাইন গ্রুপের বিভিন্ন পরিচিত ভ্রমণ এবং আবাসন ওয়েবসাইটের (Priceline.com, Kayak.com, Rentalcars.com, and Agoda.com) এর মালিকানা রয়েছে, সাথে তারা এই নব্য প্লাটফর্মটি কিনে নেয়। এরপর থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের উপার্জনের মূল চালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে বুকিং ডট কম। ২০১৮ সালের প্রারম্ভকালীন এই গ্রুপ তাদের নামটি পরিবর্তন করে বুকিং হোল্ডিংস (Booking Holdings) করেছিল।
বুকিং ডট কমের দেখানো পথে এর পর থেকে বিশ্ব বাজারে আসতে শুরু করে এমন নানান প্লাটফর্ম। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য, বুকিং ডট কম স্বল্পমেয়াদী ভাড়া্র আবাসন পদ্ধতি বাজারে আনা হয়েছে। ২০১২ সালের মে মাসে সংস্থাটি বিশ্বজুড়ে ৫৮ লাখেরও বেশি হোম-লিস্টিংয় করার কথা বলেছে, ২০১৮ সালে বিকল্প থাকার জায়গার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (সংস্থার সামগ্রিক আয়ের ২০ শতাংশ) উপার্জন করেছে।
বুকিং ডট কমের অন্যান্য সেবা
প্রতিযোগিতায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে নানা ধরণের সেবা প্রদান শুরু করে। তার মধ্যে রয়েছে :
অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট
২০১০ সালের নভেম্বরে, সংস্থাটি আইপ্যাডের জন্য একটি হোটেল এবং লজিং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছে।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংস্থাটি অ্যান্ড্রয়েডের জন্য তাদের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছে।
২০১২ সালের এপ্রিলে সংস্থাটি আইফোন এবং আইপড টাচের জন্য নকশাকৃত প্রথম বিশ্বব্যাপী লাস্ট মিনিট হোটেল অ্যাপ্লিকেশন ‘বুকিং ডটকম টুনাইট’ চালু করে।
২০১২ সালের অক্টোবরে, সংস্থাটি উইন্ডোজ ৮ ব্যবহার করে মাইক্রোসফ্ট উইন্ডোজের জন্য প্রথম অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছে। একই সময়ে সংস্থাটি একটি নতুন ফাংশন,পাসবুকের সাহায্যে আইফোন অ্যাপের সংস্করণ আপডেট করেছে।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে, সংস্থাটি তার কিন্ডল ফায়ার অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি এবং জাপানসহ অ্যামাজনের সমস্ত অ্যাপ স্টোরগুলোতে ডাউনলোডের জন্য সহজলভ্য।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে সংস্থাটি একটি উন্নত অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছে।
বর্তমান বিশ্বে ভ্রমণকারীদের কাছে আবাসন সংকট সমাধানে সবচেয়ে কার্যকরী এই সংস্থাটি আমাদের দেশেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের সব পর্যটন এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হোটেল রুম রিজার্ভেশনের জন্য এক আস্থাভাজন প্লাটফর্ম। যেখানে আপনি সাধারণের চেয়ে কম ভাড়ায় রিজার্ভেশন করতে পারবেন এবং রিজার্ভেশন সম্পূর্ণ ফ্রি।