প্রধান চারটি ধর্মের মানুষ বসবাস করে আমদের প্রিয় বাংলাদেশে। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ আরো বিভিন্ন ধর্মের লোকের বসবাস রয়েছে। যদিও মুসলিম প্রধান দেশ এই দেশে সব ধর্মের মানুষজন শান্তিতে বসবাস করে এবং তাদের ধর্মীয় উৎসব পালন করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন গুরুত্বের সাথে তাদের ধর্মীয় উৎসব গুলো পালন করেন। চলুন জেনে আসা যাক সেই সকল উৎসব সম্পর্কে :
দোল উৎসব :
দোল উৎসবের অন্য নাম হলি বা রঙ উৎসব। ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বা দোল পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সাথে রং খেলায় মেতে ছিলেন। সেখান থেকে দোল খেলার উৎপত্তি হয়েছে যা এখনো চলমান। দোল যাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের আবির স্নানের পর শোভা যাত্রায় বের করা হয়। এরপর ভক্তরা আবির ও গুলাল নিয়ে রং খেলায় মেতে উঠেন। দোল উৎসবের জন্য ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোল পূর্ণিমা বলা হয়ে থাকে। এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামও বলা হয়। রঙের এই উৎসবে কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে রঙের প্যাকেট উপহার হিসেবে থাকে। এই উৎসবে একে অন্যের প্রতি ভালোবাসার মানুষকে মিষ্টি মুখ করায়।
হিন্দু ধর্মের অনেকে এই দিনে বিবাহিত মেয়েকে এবং মেয়ের জামাইকে নতুন কাপড় উপহার হিসেবে দেয়। হোলির আগের দিন সবাই মিলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজা করে। তখনও কিন্ত শুকনো রং ছিটানো হয়। এই হোলির জন্য দোকানে বিভিন্ন রং,আবির এবং বিভিন্ন ওয়াটার গান বিক্রি করা হয়। তবে আসল হোলির আগের দিন কেবল পরিচিতদের মধ্যেই শুকনো রং ছিটানো হয়, অন্যদের মধ্যে নয়। বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি রঙের আয়োজন নিয়ে বসে দোকানিরা আনন্দের সাথে রঙ বিক্রি করে। রং খেলার উৎসব আনন্দে চারিদিক মুখর হয়ে ওঠে। অনেকেই আবার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, বাড়ির ছাদে উঠে উপভোগ করেন বিশেষ এই হোলি খেলা। হিন্দুরা বিশ্বাস করে এই রঙ খেলার মাধ্যমে তাদের নিজেদের মধ্যকার সব অহংকার, ক্রোধ শেষ হয়ে যায়। সবাই মিলেমিশে উপভোগ করে এই হোলি উৎসব বা দোল পূর্ণিমা, যার আনন্দ সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে।
দুর্গা পূজা :
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। দুর্গা পূজা কবে, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল তা ইতিহাস থেকে ঠিক করে বলা যায় না। তবে দুর্গাপূজার ইতিহাস সু-দীর্ঘকালের বলে জানা যায়। হিন্দু পুরাণে পূজার সূচনা সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনী পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর মধ্যে কোথাও কোথাও বলা আছে, প্রাচীনামলে রাজা সুরথ হারিয়ে যাওয়া রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য দেবী দুর্গার পূজা করতেন। তখন এই দুর্গা পূজা হতো বসন্তকালে, সেজন্য এই পূজাকে বাসন্তী পূজাও বলা হয়ে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন যুগ থেকেই নানান রূপে দেবী দুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে। মূলত দেবীপক্ষের পুণ্য তিথিতে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী- এই তিনদিন মহা আয়োজনে দেবী দুর্গার পূজা হয়ে থাকে। দুর্গা পূজা কিন্ত শুধু দেবী দুর্গার একার পূজা নয়। দেবীদুর্গার পূজা উপলক্ষে আরও অনেক দেব-দেবীর পূজা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন। মহা অষ্টমীর দিন কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়ে থাকে। অষ্টমী ও নবমী তিথির মাঝে আয়োজিত হয় সন্ধিপূজা। সবশেষে আসে দশমীর দিনের শেষ পূজার লগ্ন। এই দিনকে বলা হয় দশমী যা বেশি সু-পরিচিত বিজয় দশমী নামে।
জন্মাষ্টমী :
জন্মাষ্টমীর উৎসব হলো হিন্দুদের ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জন্মবার্ষিকী। মূলত সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে জন্মাষ্টমী পালন হয়। এই তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীকৃষ্ণ। এই দিনে অনেক ভক্তরা শ্রী কৃষ্ণের উপাসনা করেন। অনেকেই আবার উপবাস রাখেন। হিন্দুদের মধ্যে এটি বিশ্বাস করা হয় যে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতিমার সাথে বাঁশি এবং ময়ূরের পালকগুলো রাখা হলে ঈশ্বর খুশী হন। এতে করে জীবনে সুখ আসে। বলা হয়ে থাকে, কেউ যদি একবার শ্রীকৃষ্ণের এই জন্মাষ্টমী উপবাস পালন করেন, তা হলে তাঁকে আর এ জগতে জন্ম, মৃত্যু, কষ্ট ভোগ করতে হয় না। এমনকি পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হয় না।
রথযাত্রা :
রথের যাত্রা নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। জগন্নাথ এবং বিষ্ণু, শ্রী কৃষ্ণের দুই রূপ। বলরাম বা বলভদ্র, শ্রী কৃষ্ণ বা জগন্নাথ এবং সুভদ্রাদেবী এই তিনজন একে অপরের ভাইবোন ছিলেন। পুরাণে বর্ণিত যে, তাদের তিন ভাইবোনের ঘনিষ্ঠ, সৌহার্দপূর্ণ ও স্নেহপরায়ণ সম্পর্কের জন্যই তাঁরা পূজনীয়। রথযাত্রাও তাদেরকে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে। রথ যাত্রার সময় রথের রশি ধরে টেনে নিয়ে চলেন ভক্তরা। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, রশি টানলে তাদের আর এই জগতে পুনর্জন্ম হবে না। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে শুরু হয় এই উৎসব, যার প্রত্যাবর্তন হয়ে থাকে একাদশী তিথিতে। পুরাণ হতে জানা যায়, আষাঢ় মাসের শুক্লা তিথিতে জগন্নাথ, তার ভাই বলভদ্র (বলরাম) ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে পুরীধামের মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দিরে যান। সেখানে তারা নয় দিন অবস্থান করেন। এরপর আবার পুরীধামে সবাই ফিরে আসেন। পুরীধামে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই উৎসব যা বাংলাদেশেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন গুরুত্বের সাথে পালন করেন।
সরস্বতী পূজা :
সরস্বতী হলো হিন্দুদের বিদ্যার দেবী। সরস্বতী পূজা হিন্দু বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর উদ্দ্যেশ্যে পালন করা হয়। এটি একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। নিয়ম অনুযায়ী, মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত করা হয়ে থাকে। উক্ত তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বলা হয় বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত রয়েছে। বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন খুব সকালে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্র-ছাত্রীদের বাসা ও পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয় সকলে মিলে। অনেক ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি এছাড়া ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃ তর্পণের প্রথাও প্রচলিত রয়েছে যা বিশেষ প্রশংসনীয়। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুগামীরা পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পূজামণ্ডপগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। পূজার পরের দিনটিকে বলা হয় শীতলষষ্ঠী।