হাতিয়া দ্বীপ হচ্ছে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর এলাকার উত্তর দিকে অবস্থিত মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত একটি দ্বীপ। এই দ্বীপ নোয়াখালী জেলায় পড়েছে। এর আয়তন ৩৭১ কিলোমিটার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ভোলা ও মনপুরা হাতিয়া দ্বীপের দুটি উল্লেখযোগ্য উপকূলীয় দ্বীপ।
সবগুলো দ্বীপই ঘনবসতিপূর্ণ। হাতিয়ার পরিষদ হচ্ছে ওছখালী বাজার এটা প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় ও ধ্বংসাত্মক সামুদ্রিক ঢেউয়ের কবলে পড়ে থাকে। বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি উপকূলীয় দ্বীপ হাতিয়া।
চারদিকে অথৈ জলের রাশি আর উত্তাল তরঙ্গের মাঝে ভাসমান ভেলাসদৃশ এ দ্বীপ ও তার আশপাশে জেগে ওঠা ১৯টি চর নিয়ে হাতিয়া নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা।
২১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত এ দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জেগে ওঠা এ দ্বীপের উত্তর ও পশ্চিম পার্শ্বে প্রবাহিত মেঘনা নদী এবং পূর্ব ও দক্ষিণ পার্শ্বে কল কল রবে বয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগর।
‘হাটিয়া’-‘হাতি’-‘হাইতান’-‘হা-ইতিহ’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে নামকরণের প্রবাদ থাকলেও কালক্রমে এটি বর্তমানের ‘হাতিয়া’ নামে নামান্তরিত হয়ে সারাবিশ্বে সুপরিচিতি লাভ করেছে। হাতিয়াকে প্রধানত দু’টি কারণে পৃথিবীর মানুষ চিনেছে।
প্রথমত এ মাটির সুপ্রাচীন ও সমৃদ্ধ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও অন্যটি এ দ্বীপের উপর বয়ে যাওয়া বিগত শতাব্দীর ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়সমূহ। ভেনিসিয়ান পরিব্রাজক সিজার ফ্রেডারিকের মতে, এ দ্বীপাঞ্চল ছিল পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম উর্বর ও বাসযোগ্য এলাকা।
হাতিয়ার সুপরিচিতি লাভে দ্বীপের অনন্য ও বিদগ্ধ প্রতিভাবান পণ্ডিতদের অবদানও কোনো অংশে কম নয়। হাতিয়া দ্বীপের প্রাচীন স্বর্ণালী ইতিহাস বর্তমানে অনেকটা ম্লান, নিভু নিভু। নদীর অব্যাহত ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়- জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রকৃতির বৈরীসুলভ আচরণে আজ ক্ষত-বিক্ষত হাতিয়ার জনজীবন।
বর্তমানে ‘হাতিয়ার দুঃখ’ নদীর ভাঙন। ২২০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা থেকে হাতিয়া হারিয়েছে ১০০ বর্গ কিলোমিটার। অথচ এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে একে আমরা সম্পূর্ণ খোদার লীলাখেলা বলে চুপ করে বসে আছি। হাতিয়া ভাঙছে, আবার গড়ে উঠছে নতুন নতুন চর।
নিঝুমদ্বীপ হাতিয়ার অলংকার। নিঝুমদ্বীপসহ জেগে উঠা চরাঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনার আরেক নতুন বাংলাদেশ। হাতিয়া আমাদের প্রিয়দ্বীপ। শত প্রতিকূলতার পরও হাতিয়াকে নিয়ে বহন করছি আমরা কয়েকশ’ বছরের এক উজ্জ্বল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার।
নদী ভাঙন হাতিয়ার নিত্যসঙ্গী। ১৯৬০-এর দশক হতে হাতিয়ার নদী ভাঙন সমস্যা তীব্রতর হয়ে ওঠে। ভাঙনে বিগত ৫০ বছরে হাতিয়ার প্রায় ৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ‘সাহেবানীর চর’ নামে হাতিয়ার পূর্ব পার্শ্বে একটি চর ভেঙে চোখের পলকে সম্পূর্ণরূপেই ডুবে গেছে মেঘনায়।
মেঘনা হাতিয়ার উত্তরাঞ্চলের যতটুকু গ্রাস করেছে- তার পুরোটাই ছিল সমৃদ্ধ জনপদ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণ, উন্নয়নের পটভূমি। ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে হাতিয়ার ঐতিহ্যবাহী শহর, বৃটিশ আমলে নির্মিত আদালত ভবন, সরকারি হাসপাতাল, ডাকবাংলো, কারুকার্যমণ্ডিত প্রাচীন জামে মসজিদ, সরকারি কলেজসহ নামী-দামী বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
নিলক্ষী, সাগরদী, হরণী-চান্দী সম্পূর্ণরূপেই নদীগর্ভে। সুখচর নলচিরারও প্রায় অংশ বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে দ্বীপের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র তমরদ্দি বাজার। হুমকির মুখে কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদসহ সমৃদ্ধ জনপদ আফাজিয়া। ভাঙনের কবলে চরঈশ্বরের পূর্বাঞ্চল, চরকিং-এর পশ্চিমাঞ্চল, তমরদ্দি ও সোনাদিয়া ইউনিয়নের কিয়দঞ্চল।
অব্যাহত নদী ভাঙনে ভিটেমাটি ও সহায়সম্বল হারিয়ে হাতিয়ার দু’লাখেরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তুর মত মানবেতর জীবন যাপন করছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হাতিয়ায় গড়ে প্রতি বছর ১২০০-১৫০০ পরিবার সর্বস্ব হারাচ্ছে।
ভূমিহীন এ মানুষগুলো বেড়ির পার্শ্বে খালের পাড়, খাস জমি, নিঝুমদ্বীপ, ঢালচর, মৌলভীরচর, বয়ারচর, নঙ্গলিয়া, নলেরচর, কেরিংচর ইত্যাদি এলাকায় মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ ও মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
হাতিয়ার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারগুলো এক সময়ের ‘স্বপ্নের দ্বীপ’ ছেড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি জমাচ্ছে। ভাঙনই তার একমাত্র কারণ, অন্য কিছু নয়।
নৌ-পথই হাতিয়ার সাথে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। হাতিয়া হতে নোয়াখালী জেলা সদরে যাতায়াতের জন্য বিআইডব্লিউটিসি’র দু’টি সি-ট্রাক আছে। এর মধ্যে যে কোনো একটি প্রায়ই অচল থাকে। অন্যটিতে তখন যাত্রীদের বসা দূরের কথা দাঁড়ানোরও জায়গা থাকে না।
এ সময় বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে ট্রলারে নদী পারাপার হতে হয়। হাতিয়া নোয়াখালী রুটে আছে যাত্রীবাহী অবৈধ ট্রলারের দৌরাত্ম্য। ফিটনেসবিহীন ট্রলারে যাতায়াত করতে যাত্রী সাধারণকে বিভিন্ন কৌশলে বাধ্য করা হয়।
এ যাবত অনেকগুলো ট্রলার দুর্ঘটনায় ব্যাপক যানমালের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পরও উন্নত জলযানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই এ পথে। জোয়ারভাটার উপর নির্ভরশীলতা হাতিয়ায় যাত্রীদের দুঃখ। ডুবোচরে সি-ট্রাক ট্রলার আটকে গিয়ে ভোগান্তি এখনো পূর্বের মতোই রয়ে গেছে।
বর্ষাকালে হাতিয়ার নদী থাকে অশান্ত আর উত্তাল ঢেউ। একটু বাতাস হলে পাহাড়সম ঢেউ আছড়ে পড়ে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সঙ্গত কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। কালোবাজারি ও একশ্রেণির সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী তখন দ্রব্যসামগ্রীর দাম দ্বিগুণ-ত্রিগুণ করে ফেলে।
যাতায়াত সমস্যায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায় জটিল রোগী ও প্রসূতি মায়েরা। ষাটের দশকে হাতিয়াতে হেলিকপ্টার সার্ভিস ছিল। বেসরকারি পর্যায়ে হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু করলে তা অবশ্যই লাভজনক হবে।
জরুরি ও জটিল রোগীদের জন্য তা আশীর্বাদ বয়ে আনবে। বেসরকারি পর্যায়ে উন্নত জলযান এনে এ পথে যাত্রী সাধারণের ভোগান্তি দূর করা যায়। পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
হাতিয়া নৌ-ঘাটগুলোতে পল্টুন নেই। অথচ পল্টুনের নামে চাঁদা আদায় হচ্ছে। হাতিয়ার অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাটের উন্নতি হলেও নৌ-পথে নিঝুমদ্বীপ, ঢালচর, মৌলভীর চর, রামগতি, নলেরচর ইত্যাদিতে ফিটনেসবিহীন নৌকা ও ট্রলারই একমাত্র মাধ্যম। নিঝুম দ্বীপের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ।
হাতিয়ার সঙ্গে দেশের সরকারি ডাক যোগাযোগ, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হলেও গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, এয়ারটেল টেলিকমন কোম্পানিগুলো টাওয়ার নির্মাণ করে হাতিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।
বিদ্যুৎ শক্তির দুর্বলতার কারণে এখানকার মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানের সহজলভ্য সুবিধাবলী হতে চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। এ দ্বীপে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত হলে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতি আসবে। ছোটখাট শিল্পকারখানা স্থাপন করে বেকারত্বের হার কমানো যাবে।
বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা পাবে হাতিয়ার মানুষ। সর্বোপরি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়নে এ দ্বীপ অনেকদূর এগিয়ে যাবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম লিমিটেড ও ভারতের উষার এগ্রো লিমিটেড যৌথভাবে ৫ মেঘাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অত্যাধুনিক বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন কাজ হাতে নিয়েছেন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পুরো হাতিয়ার ৬ লাখ মানুষ সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে। এ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের বিনামূল্যে কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করা হবে। দ্বীপের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের জন্য প্রয়োজন ১ হাজার ৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ।
১৯৯১ সালে এ ঘাটতি পূরণ করার জন্য সরকার ১২শ’ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি অত্যাধুনিক জেনারেটর স্থাপন করে। বর্তমানে এর ২টি ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে আছে। বাকি ২টির মধ্যে ১টি বিকল হওয়ার পথে।
হাতিয়া দ্বীপের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নান্দনিক বিশাল অবকাঠামো যেন উপহাসের পাত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ দ্বীপের বেশিরভাগ গরিব মানুষগুলো আদিমকালের মানুষের মতো ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে জটিল রোগীদের মধ্যে বছরে ৫০০ রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বিশেষজ্ঞ এবং এমবিবিএস ডাক্তার সঙ্কট হাতিয়ার চিকিৎসা সেবার অন্যতম সংকট। এ দ্বীপের ৬ লাখ মানুষের জন্য আছে মাত্র চার জন এমবিবিএস ডাক্তার।
হাতিয়াতে ডাক্তার আসতে চান না বা থাকতে চান না। হাতিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সমস্যা চিকিৎসা সেবার অন্যতম অন্তরায়। শুধু ডাক্তার সংকট নয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিভিন্ন টেকনিশিয়ান পদে জনবলের অভাব, নার্স, সুইপার, আয়া পদেও শূন্যতা আছে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, এম্বুলেন্স ও জেনারেটরগুলোও অকেজো থাকে।
নদী ভাঙ্গনে হাতিয়ার বিশাল এলাকা বিলীন হলেও হাতিয়ার চতুর্দিকে অনেকগুলো চর জেগে উঠেছে। জেগে ওঠা চরাঞ্চল নিয়ে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হলেও চরের সমস্যাও কম নয়। নোয়াখালী সদর, রামগতি ও ভোলা জেলার সাথে আছে সীমানা বিরোধ। স্বত্ব নিয়ে ঢালচর ও মৌলভীর চরেও চলছে টানাটানি। ভূমিদস্যু-বনদস্যুদের
চাঁদাবাজি, ভূমিগ্রাসীদের ভূমিদখল ইত্যাদি কারণে ভূমিহীনরা শোষণ আর নির্যাতনে নিঃস্ব থেকে হচ্ছে আরো নিঃস্ব। ভূমিহীনদের নেই চূড়ান্ত তালিকা। পুনর্বাসনের নেই সুব্যবস্থা। ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী আইন, সংস্কার এবং সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে এ সমস্যা সুন্দরভাবে সমাধা করা যায়।
ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাতিয়ার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দুর্যোগ হাতিয়াকে বিশ্ববাসীর নিকট সুপরিচিত করে তুলেছে। সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছবাসের মতো দুর্যোগে অনেক বারই ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে হাতিয়া। লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে।
ফসলের ক্ষতি হয়েছে শত শত কোটি টাকার। গবাদিপশু মারা যায় বেশুমারে। চিরসবুজ বন বনানী পরিণত হয় মরুভূমিতে। রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, বসতবাড়ি, বেড়িবাঁধসহ সব ধরনের অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
বিগত ১০০ বছরের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় ১৯১৯, ১৯৫৬, ১৯৬০, ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৭ ইং সালে হাতিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন প্রকৃতির ঝড় জলোচ্ছবাস এবং সাইক্লোন আঘাত হানে। দুর্যোগে মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রধান উৎসগুলো তাৎক্ষণিকভাবে থমকে দাঁড়ায়।
জরুরি অবস্থায় বাইরের ত্রাণ সহায়তা ছাড়া বেঁচে থাকার বিকল্প অবলম্বন থাকে না। নানা রোগব্যাধির শিকার হয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে হয়ে পড়ে।
হাতিয়ার উপকূল দেশের অন্যতম মৎস্যচারণ ক্ষেত্র। হাতিয়ার উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণরত ট্রলারগুলো যে পরিমাণ মৎস্য আহরণ করে তা গোটা দেশের আহরিত মৎস্যের ১৭ ভাগ। বঙ্গোপসাগরে যে পরিমাণ মৎস্যসম্পদ আছে তা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তবে দেশের সমৃদ্ধির চেহারা অনেকদূর এগিয়ে যেতো।
এদেশের মৎস্য সম্পদ অন্যান্য দেশের জেলেরা চুরি করে ও জোর করে নিয়ে যায়। মৎস্য আহরণের জন্য পর্যাপ্ত ও আধুনিক মানসম্মত ট্রলারের অভাব রয়েছে। মৎস্য আহরণ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন করা গেলে দেশীয় চাহিদা পূরণ করার পরও ৩০ লাখ মেট্রিক টন মৎস্য রফতানি করা সম্ভব হতো।
চিংড়ি পোনা ধরা ও ঝাটকা নিধন হাতিয়ার মৎস্য সম্পদকে দিন দিন দুর্বল করে দিচ্ছে। মৎস্য হ্যাচারী ও বরফ কলের সমস্যার হাতিয়ার মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব অনেক কমিয়ে দিচ্ছে। জেলা শহর নোয়াখালী থেকে বরফ এনে হাতিয়ার মৎস্য বাইরে নেওয়া হয়। সরকারিভাবে হাতিয়ায় একটি বরফকল প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
বঙ্গোপসাগর ও হাতিয়ার উপকূলজুড়ে প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তেল গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের জরিপ কার্য সম্পাদন করে অত্র অঞ্চলে গ্যাস থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
এখনো অনুসন্ধান ও গবেষণার কাজ চলছে। এরই মধ্যে হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকার মাটি খোড়া ও নলকূপ বসানোর সময় যেভাবে গ্যাস দেখা যাচ্ছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে এ অঞ্চলে দেশের বৃহত্তম তেল গ্যাস খনি আবিষ্কৃত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে।
হাতিয়ার মাটি অত্যন্ত উর্বর। যা কৃষিকাজের জন্য খুবই উপযোগী। এ দ্বীপে বার্ষিক খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন। খাদ্যশস্যের চাহিদা হচ্ছে ৫৮ হাজার মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের পরিমাণ ৪০ হাজার মেট্রিক টন।
এ দ্বীপের ধান ও অন্যান্য রবিশস্যের পাশাপাশি প্রচুর বাদাম, গোলআলু ও তরমুজ উৎপাদিত হয়। হাইব্রিড বীজ এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করলে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের মাত্রা আরো অধিকহারে বাড়ানো যায়।
হাতিয়ার কৃষি ও কৃষকের সমস্যাগুলো হলো- উন্নত বীজের অভাব, সার ও কীটনাশকের অভাব, পোকার আক্রমণ, কৃষি ঋণের সমস্যা, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি, জোয়ার ও জলোচ্ছবাসে ফসলহানি, লবণাক্ততা ইত্যাদি। কৃষি ও কৃষকের সমস্যাসমূহ দূর করা গেলে হাতিয়া সত্যিই সুজলা-সফলা শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠবে।
হাতিয়া ক্রমাগত ভাঙছে। ১৯৬৮ সাল হতে বিগত ৪০ বছরে প্রায় ৬০ বর্গ কিলোমিটার জনপথ মেঘনা গ্রাস করে নিয়েছে। হাতিয়ার ‘দুঃখ’ নদী ভাঙন হলেও হাতিয়াকে ঘিরে জেগে উঠা চরসমূহ দ্বীপবাসীকে আশার আলো দেখাচ্ছে।
বয়ারচর, নঙ্গলিয়া, নলেরচর, কেরিং চর ও পূর্ব দিকে উড়িরচর পর্যন্ত যে বিশাল এলাকা ইতোমধ্যে জেগে উঠেছে তা ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে হাতিয়াকে ছুঁই ছুঁই করেছে। এ চরাঞ্চল মূল হাতিয়ার চেয়ে বড় দীর্ঘতম ভূ-খণ্ডের ইশারা দিচ্ছে বাংলাদেশকে। হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণাংশে জেগে উঠছে অনেকগুলো চর।
নিঝুমদ্বীপের আশপাশের চরগুলো যেভাবে পলিবাহিত হয়ে জেগে উঠছে তা অব্যাহত থাকলে নোয়াখালী জেলার চেয়েও বড় আয়তনের ভূখন্ডের আত্মপ্রকাশ ঘটবে নিঃসন্দেহে।
হাতিয়াকে ঘিরে বিশাল বিশাল আয়তনের চরগুলো জেগে ওঠার বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ও নদী ও ভূ-বিশেষজ্ঞ দ্বারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাতিয়ার ভাঙনে মাত্রা কমানো গেলে নিকট ভবিষ্যতে গোটা বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বিশাল এক ভূখণ্ড সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
১৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের নিঝুমদ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে বন বিভাগের সৃজিত বাগান, সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, গোলপাতা, কেশড়ী ইত্যাদি নানাবিধ বৃক্ষ ও গুল্মে সবুজাব নিঝুমদ্বীপ। এখানে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে।
সৎ বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহযোগিতায় সংঘটিত বৃক্ষ নিধন বন্ধ করা গেলে ও দ্বীপের আশপাশে জেগে ওঠা চরে বনায়ন করে এখানে অনায়াসে গড়ে তোলা যায় সুন্দরবনের মতো আরেক সবুজ প্রান্তর।
অপরূপ নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত এক দ্বীপ হলো নিঝুম দ্বীপ। এ দ্বীপের লোকসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার হলেও চিত্রল হরিণের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ যে দ্বীপে মানুষের চেয়েও হরিণ বেশি। চোখ ফেরালেই দেখা মেলে এখানে মায়াবী হরিণের।
দ্বীপের বনে, ফসলের মাঠে, রাস্তা-ঘাটের পাশাপাশি লোকালয়েও ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায় হরিণের পাল। এরই মধ্যে আশা জেগেছে হরিণ রফতানির। বন কর্মকর্তাদের হিসেবে নিঝুম দ্বীপ থেকে ২০ হাজার হরিণ রফতানি করা সম্ভব। তাছাড়া হরিণ রফতানি করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ হরিণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে গিয়ে দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ বৃক্ষ নিধন হওয়ার কারণে হরিণের খাদ্য চরম আকার ধারণ করেছে। লবণাক্ত পানির কারণে হরিণগুলোর দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রোগব্যাধি। দ্বীপের ৬০ হাজার হরিণের জন্য মিঠা পানির ১টি পুকুরের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে পানি না থাকায়, পানির সন্ধানে বনের হরিণগুলো প্রায়ই লোকালয়ে চলে আসে।
তাছাড়া খাদ্যের অভাব, রোগাক্রান্ত, বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত, কুকুরের আক্রমণ ও প্রভাবশালীদের হরিণ শিকারের কারণে দ্বীপের বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা এসব হরিণ হুমকির মুখে রয়েছে। এসব হরিণের চিকিৎসা নেওয়ার জন্য বন বিভাগের কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। নেই কোনো পশু হাসপাতাল।
দুর্যোগ মুহূর্তে হরিণের আশ্রয় নেওয়ার জন্য কোনো কেল্লা বা উঁচু জায়গার ব্যবস্থা নেই। যার ফলে গত ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে প্রায় ১০ হাজার হরিণ মৃত্যুবরণ করে। অপরদিকে বর্তমানে বনে থাকা প্রায় ৬০ হাজার হরিণের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে মাত্র ৭-৮ জন বন প্রহরী। ফলে বন কর্মকর্তারা হরিণ নিয়ে আছেন মহাবিপদে।
নিঝুম দ্বীপের একটি মা হরিণ বছরে দু’বার কমপক্ষে দু’টি করে মোট ৪টি বাচ্চা প্রদান করে থাকে। এ দ্বীপে প্রায় ২০ হাজারের মতো মা হরিণ আছে। এ হিসেবে প্রতি বছর ৮০ হাজারের মতো হরিণের বাচ্চা জন্মানোর কথা। এর এক-চতুর্থাংশ বেঁচে থাকলেও বছরে বৃদ্ধি পায় ২০ হাজার হরিণ।
হরিণের সংখ্যা খুব বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপে হরিণের বিচরণ ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে প্রায় হরিণ লোকালয়ে চলে আসে এবং কুকুর, শৃগাল ও শিকারিদের হাতে ধরা পড়ে। নিঝুম দ্বীপ থেকে অতিরিক্ত হরিণ সরিয়ে অন্য কোনো দ্বীপ বা বনে স্থানান্তর না করা গেলে দ্বীপের ভারসাম্য ও হরিণের জীবন রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
ধর্মীয় দিক থেকে দ্বীপবাসী আবহমানকাল থেকে দুই ধারায় বিভক্ত মুসলমান এবং হিন্দু। সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আলাদা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ দ্বীপে গড়ে উঠেনি। তবে সংখ্যাগুরু মুসলিম অধিবাসীদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনে এই দ্বীপে গড়ে উঠেছে বহু মাদরাসা-মক্তব।
এই দ্বীপে স্কুল ভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা ও মাদরাসা ভিত্তিক ইসলামী শিক্ষার গোড়াপত্তন ঘটে ১৯১২ খৃস্টাব্দে। দ্বীপের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠা হলো হাতিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় এবং হরণী ইসলামিয়া জুনিয়ার মাদরাসা। হাতিয়ার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও শিক্ষার প্রতি অনুরাগী।
হাতিয়ায় ১টি সরকারি কলেজ, ৩টি বেসরকারি কলেজ, ১টি কামিল মাদরাসা, ১৬টি আলিম-ফাজিল মাদরাসা, ২৯টি উচ্চ বিদ্যালয়, ২১১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬৫টি এবতেদায়ী মাদরাসা। ৮৯টি মক্তব, ৪০টি নূরানী মাদরাসা আছে।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এই দ্বীপে শিক্ষার যেই ক্ষীণ প্রাতিষ্ঠানিক ধারার সূচনা হয়েছিল, তা আজ এক শতাব্দীর পরিসরে দ্বীপের সর্বত্র বিস্তৃতি লাভ করেছে। দ্বীপের হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর চলমান জীবন ধারার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত মাদরাসা ও স্কুল শিক্ষার ধারাটি বয়ে চলবে কাল থেকে কালান্তরে।
হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপকে বিভক্তকারী ১২৫০ মিটার দূরত্বের অগভীর মুক্তারিয়া খালের ওপর একটি ক্রসড্যাম নির্মাণের দাবি হাতিয়াবাসীর দীর্ঘদিনের। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পিতভাবে ক্রসড্যাম প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিঝুম দ্বীপের পাশে ৩০ লাখ একর জমি জেগে উঠবে।
জাহাজমারা নিঝুম দ্বীপের মধ্যে ক্রসড্যাম নির্মাণের সম্ভাব্যতা নিরূপণকল্পে নেদারল্যান্ড সরকারের একটি বিশেষজ্ঞ দল স্থানীয় ভূমি পুনঃউদ্ধার বিভাগের সহায়তায় দুইবার হাতিয়া-জাহাজমারা নিঝুম দ্বীপের অবস্থান ও ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর উক্ত স্থানে ক্রসড্যাম নির্মাণ করা যেতে পারে বলে জরিপ দলের রিপোর্টে উল্লেখ করেন।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আজও কোননো সরকারি কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের ফাইলটি দীর্ঘদিন যাবৎ মন্ত্রণালয়ে ফাইল বন্দি হয়ে পড়ে আছে। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, মাত্র ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের মাধ্যমে নদী ভাঙন রোধসহ বিশাল ভূমি জেগে উঠলে এতদাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে।
ক্রসড্যামের ফলে প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি নিঝুম দ্বীপে ব্যাপক হারে পর্যটক ভ্রমণ করতে পারবে যা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আশা করছি, বাংলাদেশ সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থে সম্ভাবনার আরেক নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।