শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ অপরাহ্ন

বাংলাদেশবিমুখ বিদেশি এয়ারলাইন্স, কমছে ফ্লাইট বাড়ছে ভাড়া

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৩

বাংলাদেশে ফ্লাইট সংখ্যা ক্রমেই কমিয়ে আনছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো। তাদের দাবি, রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ক্ষতি ও যথাসময়ে টাকা পাঠানো নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয় এখানে। এতে প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে বিদেশি ফ্লাইট পরিচালনা। ফলে দেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে উড়োজাহাজ ভাড়া বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এতে বেশি বিপাকে পড়ছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। ভাড়া বাড়ায় ব্যবসা পরিচালনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোও।

ট্রাভেল এজেন্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। সংগঠনটি জানায়, আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দিনে ৪০টি এয়ারলাইন্সের প্রায় ১৫০টি ফ্লাইট ওঠা-নামা করতো। কিন্তু গত বছরের নভেম্বর থেকে দেশে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইট আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশ ফ্লাইট কমেছে। ফ্লাইট কমার এ ধারা অব্যাহত আছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় প্লেন টিকিট যাত্রীদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এতে কমতে থাকবে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া লোকসানের মুখে ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।

অ্যাভিয়েশন খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ফ্লাইট কমানোর বিষয়ে তারা বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। এয়ারলাইন্সগুলো জানিয়েছে, তারা যখন টিকিট বিক্রি করে তখন প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান থাকে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। কিন্তু রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে টাকার মান হয়ে যায় ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। ফলে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে এয়ারলাইন্সগুলো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়া ডলার সংকটের কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্স তাদের টিকিট বিক্রি বাবদ অর্থ যথাসময়ে নিজ দেশে পাঠাতে পারছে না। এ কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

jagonews24

দেশে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইট কমার কারণে প্রবাসী শ্রমিক, ওমরাহ, চিকিৎসা ও পর্যটকের সংখ্যা ক্রমেই কমছে বলে জানান আটাবের মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এরই মধ্যে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর টিকিট বিক্রি কমে অর্ধেকে নেমেছে। বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে অনেক এজেন্সি। এভাবে চলতে থাকলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত দুই লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। তাই বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত না করে স্বাভাবিক ফ্লাইট পরিচালনায় উৎসাহিত করা যায়। চলমান ও ভবিষ্যৎ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র জানায়, ২০২২ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১২ মাস ধরে এয়ারলাইন্সগুলো নিজ দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ ছিল। উল্টো তাদের এয়ারক্রাফটে রিফুয়েলিংয়ের সময় বাংলাদেশ থেকে যে জ্বালানি কিনছে তার মূল্য ইনওয়ার্ড রেমিট্যান্সের মাধ্যমে ডলার এনে পরিশোধ করতে হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের পাওনা টাকা জমা রয়েছে, যা যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সগুলোকে দেওয়া হচ্ছে না। এতে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে বাংলাদেশের পরিবর্তে যেসব গন্তব্য থেকে বেশি মুনাফা আসে সেখানে ফ্লাইট চালাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের পর্যটন শিল্প, বিদেশগামী যাত্রী পরিবহন ব্যয় ও ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর ব্যবসায়।

গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইটের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার বিষয়টি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সচিবকে এক চিঠিতে জানিয়েছিল আটাব। ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে টার্কিশ এয়ারলাইন্স সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করতো। সেখান থেকে তারা কমিয়ে পাঁচটি চালাচ্ছে। একইভাবে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ১০টি থেকে কমিয়ে সাতটি এবং ক্যাথে প্যাসিফিক পাঁচটির পরিবর্তে একটি ফ্লাইট অপারেট করছে। জাজিরা, মালিন্দো, কুয়েত এয়ারলাইন্সসহ আরও অনেক এয়ারলাইন্স এরই মধ্যে তাদের ফ্লাইট পরিচালনার সংখ্যা কমিয়ে আনছে। এভাবে ফ্লাইটের সংখ্যা কমতে থাকলে অ্যাভিয়েশন ব্যবসা ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে পর্যটন শিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায় ধস নেমেছে।

এই চিঠিতে আরও বলা হয়, ফ্লাইট কমে যাওয়ার কারণে টিকিটের মূল্য বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। অথচ বাংলাদেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণে শ্রমিক, ওমরাহ, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্যাকেজ ট্যুরের যাত্রী সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। চলমান সংকটের কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো দিন দিন বাংলাদেশ থেকে তাদের ফ্লাইটের সংখ্যা কমাচ্ছে। ফলে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর টিকিট বিক্রি কমে ৫০ শতাংশে নেমেছে।

jagonews24

এ বিষয়ে জানতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ দেশে ডলার সংকট। অনেক চেষ্টা করেও এ খাত নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। দিন দিন টিকিটের চাহিদা বাড়ছে। মন্ত্রণালয় করণীয় নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।

জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সারা বিশ্বেই এয়ারলাইন্সের ভাড়া বেড়েছে। তবে দেশে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর ভাড়া কমাতে চাপ দিচ্ছি। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। কারণ, বিশ্ববাজারে জেট ফুয়েলের দাম, এয়ারলাইন্স রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেড়েছে। ফলে উড়োজাহাজ ভাড়া এখন অনেক বেশি।

পাশের দেশ ভারত থেকে বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে অনেক কমে এয়ারলাইন্সের টিকিট কেনা যায়, তাহলে বাংলাদেশে কমে টিকিট পাওয়া যায় না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মফিদুর রহমান বলেন, ভারতের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাদের অভ্যন্তরীণ এয়ারলাইন্স, বিমানবন্দরগুলোকে সাবসিটি দেয়। যে সাবসিডিটা আমাদের দেশের এয়ারলাইন্সগুলোকে তেমন দেওয়া হয় না। আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ভারত ও বাংলাদেশের টিকিট মূল্য প্রায় সমান।

দেশে ডলার সংকটের কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো নিজ দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে সমস্যা সমাধানে কী উদ্যোগ নিয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, বিষয়টি নিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছে। সমস্যাটি এখন নেই।

টিকিট মূল্য বেড়েছে তিনগুণ

বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভাড়া বেড়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে। এখন ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের ওয়ানওয়ে একটি টিকিট নির্ধারিত দামের প্রায় তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ট্রাভেল এজেন্সির মালিকদের অভিযোগ, এশিয়ার মধ্যে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিক সবচেয়ে বেশি। ডলার সংকটের অজুহাতে এ রুটের টিকিট সব সময় একটি সিন্ডিকেটের কব্জায় থাকে। ফলে আগে যে টিকিটি ৩০ হাজার টাকায় পাওয়া যেত, এখন তা গড়ে ৭০ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যগামী টিকিটের দাম গড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-মালয়েশিয়া রুটের ফ্লাইটগুলোর এখন চাহিদা বেশি। চাহিদা বাড়ার কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স নিয়মিত ফ্লাইট বোয়িং-৭৩৭ এর পাশাপাশি বোয়িং-৭৭৭ দিয়ে অতিরিক্ত আরও তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া ইউএস-বাংলা, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, এয়ার এশিয়া, মালিন্দো এয়ার নিয়মিত ফ্লাইট চালাচ্ছে।

আটাবের মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ জাগো নিউজকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের মতো উড়োজাহাজের টিকিটও সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে। যে কারণে শ্রমিক পাঠানোর জন্য নির্ধারিত দামের তিনগুণ টাকায় টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছে এজেন্সিগুলো।

দীর্ঘ ১১ বছর ধরে ফকিরাপুল এলাকায় ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করে মাহিয়ান এক্সপার্ট ট্রাভেল। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম বিগত সব রেকর্ড ভেঙেছে। ডলার সংকটের শুরু থেকে এ প্রবণতা বাড়ছে। গত এক বছর ধরে টিকিট বিক্রির হার ৫০ শতাংশ কমেছে। এভাবে চলতে থাকলে পথে বসতে হবে।

উড়োজাহাজের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল আজিম জাগো নিউজকে বলেন, মালয়েশিয়াসহ সব রুটেই এখন বিমানের টিকিটের চাহিদা বেশি। আর টিকিটের চাহিদা বাড়লে এমনিতেই ভাড়া বেড়ে যায়। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে। ফলে ভাড়া বাড়িয়েছে দেশ-বিদেশের সব এয়ারলাইন্সই। এখন টিকিটের চাহিদা কমলে ভাড়াও কমে আসবে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com