শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:২৬ অপরাহ্ন

বর্ষায় রাঙামাটি ভ্রমণ

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ জুলাই, ২০২৩

পাহাড়ের পরিপূর্ণ রূপ দেখা যায় বর্ষা মৌসুমে। তাই প্রকৃতিতে বর্ষা এলেই দলবেঁধে মানুষ পাহাড়ে যায়। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর মধ্য রয়েছে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ইত্যাদি। গত বর্ষায় আমরা পরিকল্পনা করলাম রাঙামাটি ঘুরতে যাবো; যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জেলা। রাত ১১ টা ৩০ এ আমাদের ডলফিন বাস ছাড়লো কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড থেকে। যখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো, তখন আমরা রাঙামাটি জেলার ভেতরে প্রবেশ করলাম। সেখান থেকে রাঙামাটি সদর আরো অনেকটা দূর। সদর থেকে কয়েক কিলোমিটার আগে মানিকছড়ি। আমরা সদরে না গিয়ে মানিকছড়িতে নামলাম। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো রাঙামাটির একজন স্থানীয় বাসিন্দা; সম্পর্কে যে আমাদের আত্মীয় হয়। তার বাড়ি নানিয়ারচর উপজেলায়। সেখান থেকেই একটা পরিচিত মাহেন্দ্র গাড়ি রিজার্ভ করে আনা হয়েছিলো। সেই গাড়িতেই আমরা সারাদিন ঘুরেছি।

রাঙামাটি ভ্রমণে আমাদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিলো ১০ জন। যদি সদস্য সংখ্যা কম হয়, তাহলে সিএনজি রিজার্ভ করেও ঘোরা যায়।

প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম আসামবস্তি ও বরাদমে। এটা মূলত কয়েক কিলোমিটার মনোরম সড়কপথ। একপাশে কাপ্তাই লেকের আদিগন্ত নীল জলরাশি, অন্যপাশে সুউচ্চ পাহাড়সাড়ি। সেই পাহাড়সাড়ির ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘের ভেলা। দূরের পাহাড়গুলো দেখতে গাঢ় নীল মনে হয়। কী যে অপূর্ব সেই দৃশ্য! আসামবস্তি ব্রিজে দাঁড়িয়ে আমরা সেই সুন্দর অবলোকন করলাম। এই সড়কের পেছনে সরকার অনেক অর্থ ব্যায় করেছে। এই সড়ককে কেন্দ্র করেই এখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্পট। যেমন- বড়গাঙ, রাইন্যা টুগন, বেরান্নে লেক, বাগী লেক ভ্যালি ইত্যাদি। এখানে বৌদ্ধদের ধর্মীয়গুরু বনভান্তের জন্মস্থানের স্মৃতিমন্দিরও রয়েছে। পথে যেতে যেতে আদিবাসীদের গ্রাম ও তাদের জীবনযাত্রাও চোখে পড়ে। আসামবস্তি ব্রিজের কাছেই খাবারের হোটেল আছে। আমরা সেখানেই সকালের নাস্তা সেরে নিলাম।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিলো রাঙামাটির সবচেয়ে আইকনিক জায়গা রাঙামাটি সদরের ঝুলন্ত ব্রিজে; যার ছবি ছোটবেলায় সবাই ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখেছি। আমার মতো অনেকেরই হয়তো তখন থেকে স্বপ্ন ছিল একদিন সেই ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে যাবো। শেষমেশ যখন সেই দৃশ্যপট চোখের সামনে ধরা দিলো, এক অপার মুগ্ধতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যেন। সবুজ পাহাড়, কাপ্তাই হ্রদের শীতল জলরাশি আর তার বুকে ঝুলে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর ব্রিজ দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে। ঝুলন্ত ব্রিজে প্রবেশ করতে টিকিট কাটতে হয়। ২০ টাকা টিকিট মূল্য। ঝুলন্ত ব্রিজের সাথেই জলযানে করে অনেকে পাহাড়ি আনারস, পেঁপে, শসা, কলা, এমন নানারকম ফলমূল বা খাবার বিক্রি করে। সুলভ মূল্যে সেসব খাবার কিনে খেতে পারেন ইচ্ছে হলেই।

ফলমূলগুলো একদম ফরমালিন মুক্ত এবং সুস্বাদু। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের জলযানে করে ঘোরার সুযোগও। জলযানে ঘোরার জন্য জলযানের ধরন ও ঘণ্টা হিসাবে টাকা নেয়া হয়। কিছু প্রমোদতরীও পাওয়া যাবে, যাতে রাত্রিযাপনেরও সুযোগ আছে। তবে তা রিজার্ভ করে নিতে হয় একাধিক দিনের জন্য। ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে ওপারে কিছুটা হেঁটে গেলেই আদিবাসীদের ওপেন মার্কেট চোখে পড়বে। সেখানে পাহাড়িদের হাতে বানানো পোশাক, খাবার ও বাহারি ধরনের পণ্য পাওয়া যায়; যার মূল্যও সুলভ।

ঝুলন্ত ব্রিজ থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিলো পলওয়েল পার্ক। তবে পলওয়েল পার্কে যাবার পথে আমরা এক ঝলক দেখে নিয়েছিলাম উপজাতীয় টেক্সটাইল মার্কেট। সেখানে সুসজ্জিত দোকানে আদিবাসীদের হাতে বানানো বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায়। তবে ওপেন মার্কেটের তুলনায় এখানে দাম তুলনামূলক একটু বেশি। এখান থেকে আমরা কেনাকাটা করিনি, ওপেন মার্কেট থেকে করেছিলাম। অল্প সময়েই আমরা পৌঁছে গেলাম পলওয়েল পার্ক। পার্কটি রাঙামাটি জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে কাপ্তাই হ্রদের কোল ঘেঁষে মনোরম পরিবেশে তৈরি করা হয়েছে।

এটি রাত ৮ টা অবধি খোলা থাকে, প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা। পলওয়েল পার্কে রয়েছে কিডস জোন, প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র, ঢেঁকিঘরের আদলে তৈরি একটা স্থাপনা, কলসি কাঁখে নারী ভাস্কর্য। আরো আছে ক্যাফেটেরিয়া, বসার জন্য অনেক টেবিল, চেয়ার, বেঞ্চি। আছে ফুচকা চটপটি খাওয়ার ব্যবস্থা। এখানে আছে সুন্দর ফিশিং পিয়ার; যেখান থেকে কাপ্তাই লেকের বিশালতা দারুণভাবে অনুভব করা যায়। আরো আছে ক্রোকোডাইল ব্রিজ। একটা লাভ পয়েন্টও আছে, তার পেছনে আছে এক মর্মান্তিক ইতিহাস। সবাই সেখানে ছবি তোলে। এখানে সুইমিং, কায়াকিং, জেট স্কিইং এর ব্যবস্থাও আছে। কেউ এখানে রাত্রিযাপন করতে চাইলেও করতে পারবে, তার জন্য আছে বিভিন্ন কটেজ; যদিও কটেজের ভাড়া একটু বেশি। পলওয়েল পার্কটা ছোট পরিসরে হলেও দেখতে খুব সুন্দর। শহরের প্রাণকেন্দ্রেই এর অবস্থান। তাই রোজ অনেক দর্শনার্থী ভীড় করে এখানে।

পলওয়েল পার্ক ঘুরে আমরা দেখতে গেলাম রাঙামাটির বিখ্যাত বনরূপা বাজার। বনরূপা বাজারে গেলে চোখে পড়ে নৌকা ভর্তি পাহাড়ি ফলমূল ও শাক-সবজি। সেখানকার ক্রেতা বিক্রেতা বেশিরভাগই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। এ বাজারের বেশিরভাগ পণ্য নৌপথেই আসে। এখানকার শাক-সবজি কিংবা ফলমূলে কোনো ফরমালিন নেই। এখানে এত বিচিত্র ধরণের শাক-সবজির পসরা চোখে পড়ে, যা সমতলের কোনো বাজারে দেখা যায় না। সপ্তাহের প্রতিদিনই এই বাজার খোলা থাকে। তবে প্রতি শনি ও বুধবার এখানে হাট বা বাজার বার। দর্শনার্থীরা চাইলে এই ব্যতিক্রমধর্মী বাজারটা ঘুরে দেখতে পারেন।

বনরূপা বাজার থেকে যখন আমরা বের হলাম, তখন মধ্যদুপুর। এরপর সোজা চলে গেলাম নানিয়ারচর। সদর থেকে নানিয়ারচরের দূরত্ব প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার। যেতে পথেই পাহাড়ি বৃষ্টি আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে গেল। নানিয়ারচরের ছাগলনাইয়া গ্রামে পৌঁছে আমরা সবাই গোসল সেরে নিলাম। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চাকমা পাড়া দেখতে। ছাগলনাইয়াতে আমরা যে আত্মীয়ার বাড়িতে উঠেছিলাম, সে-ই আমাদের ঘুরে দেখালো চাকমা পাড়া। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তারপর আমরা রাস্তার পাশে এক টং এ বসে চা খেয়ে নিলাম সবাই। ততক্ষণে আকাশে তারার মেলা বসেছে, পাহাড়ি জঙ্গলে জোঁনাকি পোকার আনাগোনা বেড়েছে। মুগ্ধ চোখে তা দেখতে দেখতে ঘরে ফিরে গেলাম। রাতে উঠোনে পাটি বিছিয়ে মোমের আলো জ্বেলে সবাই গল্পে মশগুল হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। তারপর রাতের খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন সকালে গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে নানিয়ারচর থেকে বিদায় নিলাম। সদরে গিয়ে প্রথমে গেলাম রাজবন বিহারে। এটা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৃহত্তম বিহার। এখানে প্রবেশ করতে কোনো টিকিট কাটতে হয় না। এর গোড়ার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৭৭ সালে বনভান্তে লংগদু এলাকা থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রাঙামাটি আসেন। বনভান্তে এবং তার শিষ্যদের থাকার জন্য ভক্তবৃন্দ এই বিহারটি নির্মাণ করে দেন। বিহারটির পরিবেশ খুব শান্ত শীতল। কাপ্তাই হ্রদ আর সবুজ বৃক্ষরাজি বিহারটিকে অপার মমতায় ঘিরে রেখেছে। এখানে আছে বনভান্তের সংরক্ষিত শবদেহ, অতিথিশালা, দেশনালয়, ভিক্ষুদের আবাসিক ভবন, অনুষ্ঠানমঞ্চ, সপ্ততলাবিশিষ্ট স্বর্গঘর এবং আরো নানাবিধ জিনিস। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়েই তৈরি এই রাজবন বিহার। হাঁটতে হাঁটতে বিহারের পেছনের দিকে গেলে চোখে পড়বে কাপ্তাই হ্রদের একটা সরু শাখা। নৌকা দিয়ে ওপারে গিয়ে একটু হাঁটলেই চাকমা রাজার বাড়ি। চাকমা রাজার আদি বাড়িটা কাপ্তাই হ্রদ তৈরির সময় পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তবে এখন যে বাড়িটি আছে, সেটিও সুন্দর মনোরম পরিবেশ বেষ্টিত; যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করবে। তবে আমরা যখন গিয়েছিলাম রাজবন বিহারে, শুনেছিলাম সঙ্গত কারণে এখন আর রাজবাড়িতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয় না। তাই রাজবাড়ি না দেখেই আমাদের ফিরে আসতে হয়েছিল।

রাজবন বিহার থেকে বের হয়ে আমরা গিয়েছিলাম সদরেই অবস্থিত রাঙামাটি উপজাতীয় সংস্কৃতি জাদুঘরে। সেদিন ছিলো শনিবার। জাদুঘরে গিয়ে জানলাম, শনিবারেই জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধ। এই তথ্যটা আমাদের আগে জানা ছিলো না। কেউ জাদুঘরটি দেখতে চাইলে শনিবার বাদে অন্য যেকোনো বারে যেতে পারেন।

তারপর আমরা চলে গেলাম রাঙামাটির সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত আরণ্যক হলিডে রিসোর্টে। এই রিসোর্টটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত। আর সে কারণেই হয়তো পুরো রিসোর্টটি খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানকার প্রবেশমূল্য মাত্র ৪০ টাকা। এত বড় সুন্দর একটি রিসোর্টের প্রবেশমূল্য এত কম, ভাবলেই অবাক হতে হয়। এখানে আছে ছোটদের বিভিন্ন রাইড, সুইমিংপুল, ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, হ্যাপি আইল্যান্ড, ভাসমান রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন ধরণের বোট, হেঁটে বেড়ানোর জন্য বিস্তর জায়গা। এর ভেতরেই একটি ছোট্ট দ্বীপের ওপর তৈরি করা হয়েছে নান্দনিক হিলতাজ রিসোর্ট। হিলতাজ রিসোর্ট ও হ্যাপি আইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য আলাদা করে টিকিট কাটতে হয়। বিভিন্ন রাইডের জন্যেও আলাদা আলাদা করে টিকিট কাটতে হয়। নৌকায় কাপ্তাই লেক ঘোরার জন্য বিভিন্ন বাজেটে নৌকা ভাড়া করে নেয়া যায়। রাঙামাটিতে ঘুরতে গেলে অবশ্যই আরণ্যক হলিডে রিসোর্টটা ঘুরে দেখা উচিত বলে আমি মনে করি।

আরণ্যকে আমাদের এতটাই ভালো লেগেছিলো যে সেখানেই থেকেছি সন্ধ্যা অবধি। সেখানেই সবাই গোসল করেছে, লাঞ্চ এবং নাস্তাও সেখানেই করা হয়েছে। সন্ধ্যায় আমরা চলে এলাম ডলফিন বাস এর কাউন্টারে। ফিরে যেতে হবে ঢাকা। ঢাকায় ফিরে এলেও আমাদের মনে গেঁথে রইলো দুটি অনিন্দ্য সুন্দর দিনের স্মৃতি। আবার কোনো এক বর্ষা মৌসুমে চলে যাবো পাহাড়ের ডাকে রাঙামাটিতে। ওহ হ্যাঁ, বলে রাখা আবশ্যক যে, দুই দিনে আমাদের রিজার্ভ মাহেন্দ্র ভাড়া নিয়েছিলো ৫ হাজার টাকা। পরিচিত না হলে সাধারণত আরো বেশি ভাড়া দিতে হয়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com