রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০২ পূর্বাহ্ন

বর্ষা এল বাংলার প্রকৃতিতে

  • আপডেট সময় বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০২৪

জলবতী মেঘের বাতাস নিয়ে বর্ষা এল বাংলার সঘন সজল প্রকৃতিতে। আজ পয়লা আষাঢ়, বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষা ঋতুর বন্দনা করে লিখেছেন, ‘এসো শ্যামল সুন্দর,/ আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।/ বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।’

ষড়্ঋতুর এই দেশে গ্রীষ্মের পরই বর্ষা আসে থইথই জল-জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে। মাঠ-ঘাট, নদ-নদী, খাল-বিল—সবখানে জলেরই উল্লাস, জলেরই খেলা।

বর্ষা আসার আগেই কদম ফুল ফুটতে শুরু করেছে। দোকান থেকে সেই ফুল কিনছেন দুই তরুণী। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়
বর্ষা আসার আগেই কদম ফুল ফুটতে শুরু করেছে। দোকান থেকে সেই ফুল কিনছেন দুই তরুণী। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এ বছর অবশ্য বৃষ্টি শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ষা ঋতু আসার আগেই। এপ্রিল গেল প্রচণ্ড খরতাপে। ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানল মে মাসের শেষ দিকে। এর পর থেকেই অবশ্য ঝড়বাদল শুরু হয়েছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। তবে গরমের খামতি নেই।

আজ পয়লা আষাঢ়ে আবহাওয়া কেমন যাবে, গতকাল শুক্রবার বিকেলে জানতে চেয়েছিলাম আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হকের কাছে। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বৃষ্টি একেবারে নিরাশ করবে না, পূর্বাভাস দিলেন তিনি। জানালেন, আজ দমকা ও ঝোড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে ঢাকা, রংপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

বর্ষায় অনেকেরই প্রিয় খাবার খিচুড়ি ও ইলিশ মাছ
বর্ষায় অনেকেরই প্রিয় খাবার খিচুড়ি ও ইলিশ মাছছবি: প্রথম আলো

বাঙালির জীবনে বর্ষার রয়েছে তীব্র উপস্থিতি। কেবল কাব্য, সংগীত ও চিত্রকলায় নয়, এখানকার মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বর্ষা।

বর্ষা ঋতুর কথা আলোচনায় এলে বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথের নাম ঘুরেফিরে আসবেই। এ দেশের গ্রামবাংলায় বর্ষা-বর্ষণের সঙ্গে নাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথের নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছিল জমিদারি দেখাশোনার সুবাদে, যখন তিনি শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসর অঞ্চলে এলেন, ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে। সেই অবকাশে, সাময়িক বসবাসের সুবাদে নদীমাতৃক, বর্ষা-বর্ষণপ্রধান গ্রামবাংলাকে স্বরূপে চিনে নিলেন কবি। বাংলার ওই প্রকৃতি তাঁর চেতনায় স্থায়ী আবাস গড়েছিল। তাঁর বিভিন্ন লেখায় সে প্রমাণ ধরা আছে। জুলাই ১৮৯৩ সালে কবি যেমন আঁকলেন বর্ষায় পদ্মায় ভ্রমণের একটি ছবি, ‘বাতাস বেগে বইতে লাগল, পদ্মা নৃত্য করতে লাগল, পলে ফুলে উঠল, দিনের আলো মিলিয়ে এল, আকাশের ধারের মেঘগুলি ক্রমে আকাশের মাঝখানে ঘনঘটা করে জমে গেল, চারদিকে পদ্মার উদ্দাম জল করতালি দিচ্ছে, আমি যেন প্রকৃতির রাজার মতো বসে আছি।’

আষাঢ় ও শ্রাবণ নিয়ে রাশি রাশি গান-কবিতা রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘গীতবিতান’-এর অন্তর্ভুক্ত প্রকৃতিবিষয়ক গানের মধ্যে বর্ষা ঋতুর গানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সম্ভবত সে সংখ্যা ১৩৪ বা ১৩৫ (কালি ও কলম, বর্ষা-বর্ষণের রূপ চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ, আহমদ রফিক)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ও বহু চর্চিত কবিতা ‘সোনার তরী’। এ কবিতায় বর্ষারই অপরূপ ছবি এঁকেছেন কবি, ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।/ কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।/ রাশি রাশি ভারা ভারা ধান–কাটা হল সারা,/ ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা—/ কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।।’ যদিও কবিতাটি তিনি রচনা করেন ফাল্গুন মাসে। এ বিষয়ে কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন লিখেছেন, ‘স্থান ও পাত্রের কেমন সংযোগ হলে কালের বাস্তবতাকে ছাপিয়ে উঠতে পারে ভাবলোক!’

ফিকে হলো মধ্যবিত্তের ইলিশ-রোমাঞ্চ

বৃষ্টি মানেই রাশি রাশি সুখস্মৃতির খুলে যাওয়া জানালা! হঠাৎ বৃষ্টিতে বই-খাতা প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে, মানকচুর পাতায় মাথা ঢেকে কাদার সড়ক পেরিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা, মফস্‌সলের শিশু-কিশোরদের জীবনে আজও আনন্দের উপলক্ষ। পার্থক্য একটাই—আজ ততটা ভেজা মাটির সড়ক দেখা যায় না। ভরা পুকুরের জলে ডুব দিয়ে বৃষ্টির গান কিংবা টিনের ঘরে বসে বৃষ্টির একটানা খেয়াল-ঠুমরি শোনা, শেষ বিকেলে বৃষ্টিধোয়া আকাশে হংস-মিথুনের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা—এসব অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তারপরও বর্ষা এমন সব আনন্দ-স্মৃতিরই এক সজল পাঠাগার।

শহরে বর্ষাকালের কদর অন্য রূপে। মায়েরা সন্তানদের বৃষ্টিতে ভিজতে দেন না একেবারেই; কারণ, সর্দি-জ্বর-ইনফ্লুয়েঞ্জার ভয়। এর মধ্যেই কোনো কিশোরী-তরুণীর দল খোলা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে দ্বিচক্রযানে বৃষ্টি-ভ্রমণে বের হলেই দুষ্টু আলোকচিত্রীদের ক্যামেরার শাটারে হাত পড়বেই।

ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে দল বেঁধে নিশ্চয়ই মাঠে খেলতে নেমেছিলেন
ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে দল বেঁধে নিশ্চয়ই মাঠে খেলতে নেমেছিলেনদিনার মাহমুদ

বাঙালির রসনাতৃপ্তিতেও বৃষ্টি আছে প্রবলভাবে। বৃষ্টি এলে কিংবা দিনটা যদি মেঘমেদুর হয়, অনেক ঘরেই ছড়িয়ে পড়ে খিচুড়ির ঘ্রাণ। ফেসবুকের ওয়ালজুড়ে সে ছবি। অন্য গৃহনিপুণারাও নড়েচড়ে বসেন। বসে থাকে না রেস্তোরাঁগুলোও। সেখানেও চলে ‘বৃষ্টি-ভোজের’ যত প্ররোচনা। যুগটা যখন ডিজিটাল, অ্যাপে ফরমাশ দিলেই একেবারে গরম-গরম খানাপিনা হাজির ঘরের দরজায়।

বৃষ্টির সঙ্গে জলের রুপালি শস্য ইলিশের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ইদানীং ইলিশ নিয়ে সেই আবেগ কিছুটা ফিকে হতে চলেছে কি? মহার্ঘ বস্তুটির উচ্চ মূল্যও একটি কারণ। শুক্রবার ঢাকার বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেজি আকারের একটি রুপালি ইলিশ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা বাঙালি মধ্যবিত্তের ইলিশ-রোমাঞ্চ অনেকটা শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য বোধ করি ওই একটি কারণই যথেষ্ট। এর চেয়ে খিচুড়ির সঙ্গে দুটি বেগুন ভাজা আর একটি মরিচ পোড়া হলেই তো দিব্যি চলে যায় অনেকের।

‘বর্ষা উৎসব’

১৬ বছর ধরে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী ও বর্ষা উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের আয়োজনে প্রতিবছর ১ আষাঢ় ‘বর্ষা উৎসব’ উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে। প্রতিবছরের মতো এবারও আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের আয়োজন করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায়। পাঠকেরা এ লেখা যখন পড়ছেন, এর আগেই হয়তো শুরু হয়ে গেছে অনুষ্ঠান। আষাঢ়ের এই সকালে একটু সুযোগ তৈরি করে সবান্ধব বর্ষা উৎসবে ঘুরে আসাই যায়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com