রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন

বরগুনার নৈসর্গিক পর্যটন স্পট

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০২৩

বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বরগুনা জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঘিরে দেশের পর্যটন শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলকে পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করতে চলছে নানা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। খবর বাসসের।

বঙ্গোপসাগরের গর্জন, পাশেই বন বনানীর শ্যামলিমা, পৃথিবীখ্যাত মায়াবী চিত্রল হরিণের দুরন্তপনা, নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনচিত্রে ভরপুর রাখাইন পল্লী, চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযুদ্ধ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। একই স্থানে প্রকৃতির এমন বাহারি সৌন্দর্যের সমাহার খুব কম জায়গায়ই মেলে।

বরগুনার ও নিকটবর্তী স্পটসমূহ- চর বিজয়, বঙ্গবন্ধু দ্বীপ, আশারচর, সোনাকাটা, টেংরাগিরি, শুভসন্ধ্যা সৈকত, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, লালদিয়ারচর, হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পদ্মার চর, সোনাতলা, মোহনা, চুলুর চর, ঐতিহাসিক বিবিচিনি শাহী মসজিদ, গাজীকালু ও চম্পাবতীর মাজার, জাহাজভাঙ্গা শিল্পাঞ্চল, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ প্রায় দুই ডজন পর্যটন স্পট এখন খুলে দিচ্ছে দেশের পর্যটন শিল্পের অমিয় সম্ভাবনার দ্বার।

পর্যটনের বিকাশে উদ্যোগে সরকার বরগুনা সদর, আমতলী, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলাসহ পটুয়াখালীর কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালীতে বিশেষ পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে পরিকল্পনা কমিশন এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ-পর্যটনভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন নামে প্রকল্প অনুমোদনও দিয়েছে।

বরগুনার তালতলী উপজেলার সোনাকাটা পর্যটন স্পট থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে সাগর বক্ষে ‘চর বিজয়’ দ্বীপটি অবস্থিত। দুরন্ত অভিযাত্রীদের জন্য অনন্য ও আকর্ষণীয় একটি পর্যটন স্পট।

বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত ‘বঙ্গবন্ধু দ্বীপ’টি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটক ও অভিযাত্রীদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। সমুদ্রগামী জেলেরা এ দ্বীপটির আবিস্কারক হলেও ঠিক কত সালে তারা প্রথম দ্বীপটি খুঁজে পেয়েছিলেন সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।

বিভিন্ন তথ্য সূত্রে থেকে জানা গেছে, জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ ভক্ত মালেক ফরাজী নামের এক মৎস্য শিকারি ১৯৯২ সালে দু’জন জেলেকে নিয়ে এই দ্বীপে কোন কারণে অবতরণ করেন। পরবর্তীতে তিনি দ্বীপটির নামকরণ করেন ‘বঙ্গবন্ধু দ্বীপ’। দুবলার চর থেকে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে দ্বীপটি অবস্থিত। এ দ্বীপের বর্তমান আয়তন প্রায় ১০ কিলোমিটারের মতো। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই মিটার উঁচু দ্বীপটি। এবং সেখানে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়ে আসেন। বর্তমানে বিপুল সংখ্যক পর্যটক সেখানে ঘুরতে যান।

বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনিতে সবুজের সমারোহে নয়নাভিরাম পরিবেশে ৪০ ফুট উঁচু টিলার উপর মাথা উঁচু করে মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক গম্বুজ বিশিষ্ট দৈর্ঘে ৪০ ফুট, প্রস্থে ৪০ ফুটের ঐতিহাসিক ‘শাহী মসজিদ’। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে সুদূর পারস্য থেকে এসে শাহী মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আধ্যাত্বিক সাধক হযরত শাহ্ নেয়ামত উল্লাহ্। নেয়ামত শাহের কন্যা চিনি বিবির নামের সাথে মিল রেখে এই গ্রামের নামকরণ করা হয় বিবিচিনি।

মসজিদের চার পাশের দেয়াল ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি চওড়া। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে তিনটি দরজা-খিলান রয়েছে। মসজিদের ইটগুলো দৈর্ঘে ১২ ইঞ্চি, প্রস্থে ১০ ইঞ্চি এবং চওড়ায় ২ ইঞ্চি, রং ধুসর বর্ণের।

তালতলী উপজেলার ফকিরহাটে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের কোলে গড়ে ওঠা ‘টেংরাগিরি’ বনাঞ্চল। এই বনে এসে কান পাতলে শোনা যায় সাগরের গর্জন। টেংরাগিরি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় টেংরাগিরি বনাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৬৭ সালে। এই বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর ৪ হাজার ৪৮ দশমিক ৫৮ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত হয় টেংরাগিরি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য।

বনাঞ্চলের সখিনা বিটে ২০১১ সালে ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে পর্যটকদের জন্য আগেই নির্মাণ করা হয়েছে একটি ডাকবাংলো। বনের ভিতরে পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য দু’টি সেতু (সকিনা ও সুদরিয়া খালে), দুই কিলোমিটার পাকা সড়ক, পুকুরে পাকা ঘাট, সাগরপাড়ে জেটি, ৩ টি টয়লেট, বনের মধ্যে বিশ্রামাগার, হরিণ, শুকর, ছোট মাংশাসী প্রাণী আর বাঘের বেষ্টনী এবং কুমির প্রজনন কেন্দ্র ও বেষ্টনীসহ মানববান্ধব বনজপ্রাণীর আশ্রায়স্থল রয়েছে। টেংরাগিরি বনাঞ্চলের অভয়ারণ্যে ১০টি হরিণ, ২৫টি শূকর, ৩টি চিতাবাঘ, ২৫টি অজগর, ২টি কুমির, শতাধিক বানর, ২টি শজারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে। সারি-সারি গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই কেওয়া, তাল, কাঁকড়া, হেতাল, তাম্বুলকাটা গাছের মধ্যে এখানে ঘুরে বেড়ায় নানা প্রজাতির জীবজন্তু।

তালতলীর ২৩টি ‘রাখাইন পল্লী’তে বসবাস করছে কয়েক’শ বছরের পুরোনো রাখাইন স¤প্রদায়। তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, প্রাচীন উপাসনালয়, বুদ্ধমূর্তিগুলো পর্যটকদের ভিন্ন মাত্রার আনন্দ দেবে। বঙ্গোপসাগরের তীরে নৃ-গোষ্ঠি এই রাখাইনপল্লীতে সারাবছর তাঁতের লুঙ্গি, শার্ট, পিচ, শাল, ব্যাগ কাপড় বোনা চলে। তাঁতগুলোর খট্খট্ শব্দে রাখাইন পল্লী মুখর হয়ে থাকে। তাঁতশিল্প, রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির আর সেখানে রক্ষিত বিভিন্ন ধরণের মূল্যবান মূর্তি দেখতে সারাবছরই পর্যটকদের আগমন ঘটে।

‘সোনাকাটা চরাঞ্চল’ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাকেন্দ্র। তালতলী সদর থেকে খুব কাছেই বঙ্গোপসাগরের কোলে সোনাকাটা। সোনাকাটার বনের মধ্যে ছোট বড় ১২টি প্রাকৃতিক কিল্লা (উঁচু ভূমি) আর ৭টি মিঠা পানির পুকুর রয়েছে। সোনাকাটায় দেখা যাবে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সৌন্দর্য।

তালতলী সদর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ‘আশারচর’এ আছে শুঁটকির সাম্রাজ্য। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে দূর সাগরের বুকে মাছ ধরারত নৌকোগুলোর টিমটিমে আলো দেখলে মনে হয় ভাসমান কোনো বন্দর। বালিহাঁস, গাঙচিল, পানকৌড়িসহ হরেক পাখির কুজনে সব সময় মুখর থাকে আশারচর।

বরগুনা জেলা সদরের অদূরে বালিয়াতলী ইউনিয়নের রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ‘মোহনা’ পর্যটন কেন্দ্র। বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহর পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় বরগুনা জেলা প্রশাসন স্থানীয় কয়েকজন উদ্যমী যুবক ‘সবুজ বরগুনার রঙিন নদীপাড়’ স্লোগানে ‘মোহনা’ নামের এই পর্যটন কেন্দ্রটির উন্নয়ন করছেন। পায়রা নদীর তীরে বিস্তৃত বাহারী রঙ্গে রঙ্গিন সিমেন্ট এর ব্লকগুলো পর্যটকদের মনকে রাঙিয়ে তুলবে। ¯িœগ্ধ বিকেলে গোধূলীর রক্তিম সৌন্দর্যের সন্ধানে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক মোহনা পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ করে থাকেন।

তালতলীতে রয়েছে আরেকটি পর্যটন স্পট ‘শুভসন্ধ্যা সৈকত’। এখানে দেশের সবচেয়ে বড় জোছনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাহাজভাঙ্গা শিল্প অঞ্চলও হতে পারে তালতলীর অন্যতম পর্যটন স্পট।

আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের টেপুরা গ্রামে ‘গাজী কালু ও চম্পবতীর’র মাজার রয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে বিশ্বাসী হাজারো নারী-পুরুষ আসেন জিন্দা পীরের কাছে তাদের মঙ্গল কামনা ও মানত, মনোবাসনা পূরণের জন্য। মাজারের তত্বাবধায়ক মিন্টু মল্লিক জানিয়েছেন, প্রতি বছর ২৯ মাঘ ও ২৯ ফাল্গুন এখানে ওরস মাহফিল উপলক্ষে বসে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের মিলন মেলা। চলে প্রার্থনা, কবি ও পালাগান। ওরসের দুই দিন ছাড়াও আধ্যাতিক বিশ্বাসের লোকজন সারাবছরই এ মাজারে আসা-যাওয়া করেন।

সুন্দরবনের চেয়ে আকৃতিতে বড় প্রজাতির মায়াবী চিত্রল হরিণের বিচরণস্থল হওয়ায় বনের নামকরণ হয়েছে ‘হরিণঘাটা’। মায়াবী হরিণের দল বেঁধে ছুটে চলা, চঞ্চল বানর আর বুনো শূকরের অবাধ বিচরণ, পাখির কলরবে সারাক্ষণ মুখর থাকে হরিণঘাটা বনাঞ্চল। পাথরঘাটা উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর তিন নদ-নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হরিণঘাটা। সৃজিত এই বনে হরিণ, বানর, শূকর, কাঠবিড়ালী, মেছো বাঘ, ডোরা বাঘ, শজারু, ভোদড়, শিয়ালসহ অসংখ্য বুনো প্রাণির বিচরণ। রয়েছে সুবিশাল তিনটি সৈকত লালদিয়া, পদ্মা, লাঠিমারা। ৫ হাজার ৬০০ একর আয়তন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই বনাঞ্চল।

‘লালদিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল’এ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকো ট্যুরিজম সুযোগ বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় ৯৫০ মিটার ফুটট্রেল (পায়ে হাঁটার কাঠের ব্রিজ) স্থাপন করা হয়েছে। রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার বেঞ্চ, ঘাটলা ও ইটের রাস্তা। মিঠাপানির জন্য খনন করা হয়েছে পুকুর।

বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বর বঙ্গোপসাগরে মিলেছে সোনাতলা এলাকায়। তিন নদ-নদীর সঙ্গমস্থলে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক নৈসর্গের আরেক লীলাভূমি ‘সোনাতলা বনাঞ্চল’। সোনাতলা, বাবুগঞ্জ, ছোনবুনিয়া, পদ্মা, কুমিরমারা এই এলাকার বিস্তীর্ণ চর ঘিরে গড়ে ওঠা সৃজিত এই বনভূমির আয়তন ৪ হাজার ৬০০ একর। সারি-সারি কেওড়া, গেওয়া গাছে ছাওয়া এই বনে শূকর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, মেছো বাঘসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী রয়েছে। এখানে রয়েছে একটি পিকনিক ¯পট, কয়েকটি গোলঘর, একটি ডাকবাংলো, পুকুর।

বরগুনা শহরের পশ্চিম পাশে বিষখালী নদীতে রয়েছে প্রকৃতি ও মানুষের উন্নয়নে সম্মৃদ্ধ দ্বীপ-বন ‘টুলুর চর’। এখানে বন বিভাগ নানা প্রাণি অবমুক্ত করেছে।

পাথরঘাটয় অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ‘বিএফডিসি’র কর্ম চাঞ্চল্য পর্যটকদের আনন্দে ঘিরে রাখতে পারে দীর্ঘ সময় ধরে।

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানিয়েছেন, পর্যটন স্পট ও কেন্দ্রগুলোর তালিকা পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এসব এলাকার অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য নানা মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চলছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com