পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্পের ছোঁয়ায় বদলে গেছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম রূপপুর। সাত বছর আগে সন্ধ্যা হলেই যেখানে নেমে আসত গভীর রাতের নিস্তব্ধতা, সে এলাকা এখন দিনরাত কর্মচঞ্চল। প্রায় ৫ হাজার রাশিয়ান-বেলারুশ নাগরিকের পদচারণা বদলে দিয়েছে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র। চরের বিরান ভূমিতে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বী সুদৃশ্য আবাসিক ভবন, ঝকঝকে শপিংমল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্টসহ অসংখ্য দোকানপাট।
রূপপুরের মানুষ কখনো ভাবতেই পারেনি ভাষা শিখে বিদেশিদের সঙ্গে সখ্য গড়তে হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্পই এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন এনে দিয়েছে। কথাবার্তা, চলাফেরা, ব্যবসাবাণিজ্য বা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তারা রপ্ত করেছে রুশ ভাষা। পুরো এলাকাটি রুশ সংস্কৃতির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দোকানের সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে মূল্য তালিকায় বাংলাকে হটিয়ে ইংরেজির পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে রুশ ভাষা।
স্থানীয়রা জানান, ২০১৫ সালে রূপপুরের নতুন হাট এলাকায় ছিল শুধু কাঁটাতারের বেড়া। চারদিকে ধুধু ফাঁকা মাঠ আর দুই-একটি অস্থায়ী স্থাপনা। পাকিস্তানি আমলের ভবনগুলো ছিল বিষধর সাপের অভয়ারণ্য। ঝোপ-জঙ্গলে ঢাকা একতলা বাসাগুলো দেখলেই গা ছমছম করত। দিনের বেলায়ও সবাই সেখানে ঢুকতে ভয় পেত। সেই জায়গা এখন পুরোপুরি বদলে গেছে। শুধু রূপপুর নয়, পাশের পাকশী, সাহাপুর ও ঈশ্বরদীতেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। পালটে গেছে জীবনচিত্র। বিদেশি সংস্কৃতির ছোঁয়াও লেগেছে জীবনে। ফল ও সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে সব ব্যবসায়ী-কর্মচারীরা শিখেছেন রাশিয়ার ভাষা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় ধুধু বালুচর, ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি আর ছোট ছোট দোকানপাট নেই। বিপণিবিতান, বিদ্যালয়, সুউচ্চ ভবন, আন্তর্জাতিক মানের হোটেল-রেস্টুরেস্ট, রিসোর্ট কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর। বাঙালিদের পাশাপাশি রাশিয়ানসহ নানা ভাষাভাষীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে এ অঞ্চল। এখানকার কাঁচা বাজারগুলোতেও রাশিয়ানদের ছোঁয়া লেগেছে। মার্কেটের দোকানের সাইনবোর্ডে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষা লেখা রয়েছে রুশদের আকৃষ্ট করার জন্য। রুশ ভাষা শিখেছে এলাকার রিকশাচালকরাও।
পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর পাশেই নদী তীরে চলছে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্পে কাজের সুযোগ পেয়েছেন কয়েক হাজার বেকার যুবক। এতে তাদের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি বদলে গেছে সামাজিক চিত্রও। এর বাইরে চারপাশে গড়ে ওঠা হোটেল, রিসোর্ট, বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। বিদেশি নাগরিকদের কেনাকাটাসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজন মেটাতে পাকশী, সাহাপুর, রূপপুর ও ঈশ্বরদী শহরে গড়ে উঠেছে একাধিক বিপণিবিতান, আধুনিক শপিংমল, সুপারশপ, রিসোর্ট ও তারকা হোটেল। উন্নতমানের হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের পরিচালক ড. শওকত আকবর জানান, এই প্রকল্পে দেশি-বিদেশি ২৪ হাজার প্রকৌশলী ও শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের মধ্যে রাশিয়া, বেলারুশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫ হাজার কর্মকর্তা-শ্রমিক রয়েছেন, অন্যরা দেশের।
টিশার্ট বিক্রেতা ইসহাক আলী বলেন, ‘হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানে এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। রাশিয়ানদের পদচারণে রূপপুর যেন রাশিয়ার পল্লিতে পরিণত হয়েছে।’
নতুন হাট বিশ্বাস মার্কেটের মালিক অলিভ হোসেন বলেন, ‘আগে এখানে আমার রাইস মিল ছিল। ব্যবসা ভালো না হওয়ায় সেটা ভেঙে মার্কেট তৈরি করি।’ তিনি বলেন, ‘এখানে গ্রিন সিটি গড়ে তুলেছে সরকার। ২০ তলা করে গড়া ২০টি ভবনে থাকছেন প্রকল্পের কর্মীরা। রূপপুর প্রকল্পে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ায় এই মার্কেটের দোকানে রাশিয়ানসহ অনেক দেশের ক্রেতা আসেন। আগের চেয়ে ব্যবসা ভালো হচ্ছে।’
রাশিয়ান প্রযুক্তিতে নির্মাণাধীন প্রকল্প এলাকায় দেশটির নাগরিকদেরই আধিক্য। এ জন্য রাশিয়ান সংস্কৃতির প্রভাবও এখানে বেশি। নতুন হাট ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থাপনায় রুশ সংস্কৃতির ছোঁয়া। রেস্তোরাঁর নাম রাখা হয়েছে রাশিয়ান ডাইন, মস্কো হোটেল, রুশ ফ্যাশন । রয়েছে মস্কো টাওয়ার। প্রকল্পের কারণে উপজেলার প্রায় সব এলাকার রাস্তাঘাট নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বড় পরিবর্তন। প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই উপজেলায় ১০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে। রূপপুর প্রকল্পের ভারী মালপত্র রেলপথে আনা-নেওয়ার জন্য ৩৩৫ কোটি টাকা খরচে ২৬ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মিত হয়েছে। এই কয়েক বছরে এ এলাকার যতটা উন্নয়ন হয়েছে বিগত ৫০ বছরেও এমন কাজ হয়নি।
ডাব বিক্রেতা মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘অভাব-অনটনের কারণে আগে এসব গ্রামে প্রায়ই পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহ, দেনা-পাওনার নালিশসহ নানা ধরনের কলহ নিরসন করতে বিচার-সালিশ করতে হতো। বেকারত্ব দূর হওয়ায় গ্রামে এখন আর সেই পরিবেশ নেই। পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরেছে।’ গ্রিন সিটির সামনে বিশ্বাস মার্কেটের ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী, রেজাউল করিম, রফিকুল আলমসহ বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা হয় ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধির। তারা বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প নিয়ে এক সময় আশপাশের গ্রামবাসীর মধ্যে ছিল নানা সংশয় ও উদ্বেগ। তবে প্রকল্পে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান আর দেশি-বিদেশি কর্মীদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক অঞ্চল বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য। তাই এখন তাদের মুখে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জয়গান।
বিক্রয়কর্মী রেদওয়ান আহমেদ জানান, এখানে যারা ব্যবসা করছেন বা করবেন সবাইকে রাশিয়ান ভাষা শিখতে ও জানতে হবে। কাঁচামাল বিক্রেতারাও রাশিয়ান ভাষা শিখেছে। ক্রেতারা দোকানের সামনে এলে আমরা রাশিয়ান ভাষায় ডেকে থাকি। রূপপুরের মস্কো ডেন্টাল হাসপাতালে চিকিত্সকরা বলেন, রাশিয়ানদের দাঁতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে এই হাসপাতালে চলে আসেন। এই ক্ষেত্রে তাদের মুখের ভাষা শুনেই আমাদের ট্রিটমেন্ট দিতে হয়।
রাস্তায় টিশার্ট বা প্যান্ট বিক্রি করেন মোখলেস। এর আগে তিনি প্রকল্পে চাকরি করেছেন। প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে ব্যবসা শুরু করা মোখলেসের দোকানে ভিড় করেন রাশিয়ার নাগরিকরা। মোখলেস বলেন, ‘প্রতিদিন ভালো বিক্রি হয়। উনারা যখন (রাশিয়ার নাগরিক) দেশে ফিরে যান, যাওয়ার আগে প্রচুর জামাকাপড় কিনে নেন। এখন শীতের সময়। অনেকেই ফিরে যাবেন।’ বিক্রির নিয়ম জানিয়ে মোখলেস বলেন, ‘রাশিয়ানদের জন্য ফাইভ জিরো জিরো (৫০০ টাকা) আর আমাদের জন্য থ্রি জিরো জিরো (৩০০ টাকা)।’ পাশেই জুতার দোকানে দেশীয় কোনো সাইজের জুতা পাওয়া গেল না। বাংলাদেশিদের যেখানে স্বাভাবিক পায়ের মাপ ১০ ধরা হয়, সেখানে রূপপুরে জুতার দোকানগুলোতে মাপ দশের বেশি থেকে শুরু হয়। দোকানে ঢুকতেই এক রাশিয়ানকে জুতা খুঁজতে দেখা যায়। পছন্দমতো সাইজ মিলে গেলে খুব অল্প ভাষায় দাম নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা ভালো বলে জানান দোকানে আসা রুশ নাগরিকরা। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক রাশিয়ান বলেন, ‘আমরা এখানে ভালো আছি। এখানকার মানুষ আমাদের প্রতি আন্তরিক।’
প্রসঙ্গত, ১৯৬১ সালে রূপপুরে এই পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ সময় পেরোলেও সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর চুক্তি হয় রাশিয়ার সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের অক্টোবরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ শুরুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পুরোদমে কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর। ১ হাজার ৬২ একর জমির ওপর স্থাপিত ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত্ কেন্দ্রটিতে থাকছে দুটি ইউনিট। প্রথম ইউনিট উত্পাদনে আসবে ২০২২ সালে। পরের বছর চালুর কথা রয়েছে সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট। প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে রাশিয়া। প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি একটি গ্রিন সিটি গড়ে তুলেছে সরকার। ২০ তলা করে গড়া ২০টি ভবনে থাকছেন প্রকল্পের কর্মকর্তা ও শ্রমিকরা। পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র থেকে ১০ মিনিট দূরে এ সিটির অবস্থান।