পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের উপকন্ঠে সাগরের দিক মুখ করে থাকা রেঁস্তোরায় বসে খেতে খেতে দু’চোখ ভরে সাগর দেখাটা বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। মেরিন ড্রাইভের বুকে রেঁস্তোরার ভীড় বাড়ার সাথে সাথে পর্যটকরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন বালুকাবেলায় দৃষ্টি রেখে সামুদ্রিক মাছ ভাজায় তৃপ্তি মেটানোতে। কিন্তু পাখির চোখে সৈকত আর উপকূলবর্তী শহরের আলো দেখতে দেখতে সান্ধ্যকালীন ভোজ শুধু অভিনব অভিজ্ঞতাই নয়, অনেক দুঃসাহসের কাজও বটে। এই অভিজ্ঞতা দিতেই ২০২১ এর ৩০ নভেম্বর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে উদ্বোধন হলো বাংলাদেশের প্রথম ঝুলন্ত রেস্টুরেন্ট ফ্লাই ডাইনিং। এই বিস্ময়কর রেস্টুরেন্ট নিয়েই আজকের ফিচার।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতগামী পর্যটকদের সবচেয়ে প্রিয় স্থান সুগন্ধা পয়েন্টে গড়ে উঠেছে ফ্লাই ডাইনিং রেস্টুরেন্ট। হোটেল সি-প্রিন্সেসের পাশে অবস্থিত ফ্লাই ডাইনিং কিচেন ও রেঁস্তোরা থেকে সৈকতের পুরো দৃশ্যটাই চোখে পড়ে। কলাতলী পয়েন্টের উত্তর অংশের এই উন্মুক্ত পরিবেশের রেঁস্তোরাটি কক্সবাজারের অন্যান্য অভিজাত রেস্তোরাগুলোর মতই মনে হবে। কিন্তু কিচেনের পশ্চিম পাশের ক্রেনটি দেখার পর চমকের প্রথম ধাক্কাটা শুরু হবে। কেননা অন্যান্য রেস্টুরেন্টগুলোর যেমন উপরে উঠার জন্য সিড়ি বা লিফট থাকে, সেখানে এই ক্রেন দিয়ে অতিথিদের তোলা হবে শূন্যে।
চব্বিশজনের সিট সমেত ডাইনিং প্ল্যাটফর্মটি যখন ওপরে উঠতে শুরু করবে তখন থেকে শুরু হবে রোমাঞ্চের ষোল কলা পূর্ণ হওয়া। আশেপাশের লম্বা লম্বা গাছপালা ছাড়িয়ে ডেকটি যখন অদূরের বহুতল স্থাপনাগুলোর সাথে সমান্তরালে থেকে ওপরে উঠতে থাকবে, একমাত্র তখনি বোধগম্য হবে ফ্লাই ডাইনিং-এর বিশেষত্বটা। কারণ নিচের কিচেনে খাবার অর্ডার করার সময় পাশের বিশাল স্তম্ভের সাথে সংযুক্ত ওপরের দৈত্যাকার ক্রেনের হুকটি দেখে তেমন কিছুই বোঝার উপায় নেই। সেই হুকটিই ডেকটাকে টেনে স্তম্ভের গা বেয়ে ওপরে তুলবে।
এই যান্ত্রিক কৌশলটা বোধগম্য হলেও ওটা দিয়ে ওপরে ওঠার সময়েই একমাত্র পিলে চমকানো অনুভূতিটা হবে। মাধ্যাকর্ষণের শিহরণ কাটিয়ে যদি চারপাশটায় চোখ বুলানোর সাহস সঞ্চয় করা যায়, তবে দেখা মিলবে দূরের ধূসর-কালো পাহাড়গুলোর। তখন ভয়, বিস্ময় ও ভালো লাগার এক অদ্ভূত অনুভূতি খেলে যাবে হৃদয় জুড়ে। আর মূলত এর জন্যই একবার হলেও সাহস সঞ্চয় করে চড়া উচিত এই ঝুলন্ত রেস্টুরেন্টে।
নিচের কিচেনে রসনা বিলাসের দারুণ এক ট্রেলার দেখানো হবে প্রতিটি অতিথিকে। যদিও ব্যাপারটাতে কোন নতুনত্ব নেই, কিন্তু ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৬০ ফুট উচ্চতায় বসে চারপাশের দৃশ্যের হাতছানি উপেক্ষা করে অর্ডার দেয়া খাবারগুলো মুখ পর্যন্ত তুলে আনাটাই হবে অভাবনীয় অভিজ্ঞতা।
মাথার ওপরে বিশাল ছাতার মত শেডটি সূর্যালোক থেকে ছায়া দেবে। আর ডানে-বায়ে, সামনে-পেছনের খোলা জায়গার পুরোটাই বরাদ্দ অসীম নিসর্গ উপভোগের জন্য।
এরকম অভিজ্ঞতা সারা জীবনের পাথেয় করে নেয়ার জন্য আগেই নিজের জায়গা নির্ধারণ করতে হবে সেই ডেকের চব্বিশটি সিটের মধ্যে। ফ্লাই ডাইনিং খাবারের তালিকায় আছে- পাকোড়া বেবি কর্ন ও তেঁতুলের সস, আচার দিয়ে মোরগ পোলাও, শাম্মি কাবাব, শসা ও গাজরের মিক্সড সালাদ, চিংড়ি ও সসেমি টোস্ট, প্লেইন রাইস সাথে মাটন কালা ভুনা, শাকসবজি শাসলিক, জার্মান আলুর সালাদ। মিষ্টির মধ্যে আছে- ফল কাস্টার্ড ও শেফ শাবেব চকোলেট ফাজ।
এছাড়া ভেজিটেরিয়ানদের জন্য আলাদা ভাবে থাকছে নিরামিষ রোল, ভেজি ব্ল্যাক বিন এনচিলাডাস এবং গলানো পনির। নেয়াপোলিটানার সাথে স্প্যাগেটি, পালং শাক এবং সরিষা দিয়ে ডিমের সালাদ। আর মিষ্টির মধ্যে আছে ডালিমের সাথে তাজা ফলের সালাদ।
পাশাপাশি আমিষভোজীদের জন্য আছে চিংড়ি রোল, সীফুড ফ্রাইড রাইস, গ্রিলড সীফুড, টুনা, টমেটো সালাদ এবং মিষ্টির ভেতর মিশরীয় চালের পুডিং।
উল্লেখ্য যে, এখানে রান্নার কাজটি তত্ত্বাবধানে নিয়জিত আছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত রন্ধনশিল্পী টনি খান।
ভিআইপিদের ক্ষেত্রে অথবা নির্দিষ্ট কোন দিন উদযাপনের জন্য ফ্লাই ডাইনিং-এর আছে গিফট ভাউচারের ব্যবস্থা। এগুলোর মাধ্যমে প্রাপককে তার ফ্লাই ডাইনিং অভিজ্ঞতার জন্য যে তারিখ ও সময়ে যেতে চান তা বেছে নেবার সুযোগ দেয়।
তাছাড়া জন্মদিনের গান থেকে শুরু করে অন্যান্য বিশেষ ঘোষণার ব্যবস্থা করা হয়। তবে এর জন্য তাদেরকে অবশ্যই আগাম জানাতে হবে।
ফ্লাই ডাইনিং-এর এই বুকিং নেয়া হয় মূলত চারটি সময়ে। সিজনগুলো হলো- বিকাল ৪টা, সন্ধ্যা ৬টা, রাত ৮টা এবং রাত ১০টা। এখানে শুধু সিজন-১ এর জন্য খরচ ৬ হাজার ৮৬৪ টাকা আর বাকি সময়গুলোর জন্য ৫ হাজার ৭২০ টাকা। এই খরচে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যে দুজন অতিথি খাওয়া-দাওয়া সহ ফ্লাই ডাইনিং ট্রিপ সম্পন্ন করতে পারবেন।
ভারতের নিদার গার্ডেন গ্যালেরিয়া মলের ফ্লাই ডাইনিং-এ রিজার্ভেশনের ব্যবস্থা আছে সকাল থেকে রাত অব্দি মোট সাতটি সময়ের, যার প্রতিটির জন্য খরচ ৩ হাজার ৪৩১ টাকা।
উল্লেখ্য, এখানে ২০২১ এর ৪ ডিসেম্বরের ভারতীয় মুদ্রা রুপি থেকে বাংলাদেশের টাকার কনভার্সন রেট অনুসরণ করা হয়েছে।
ফ্লাই ডাইনিং ডিজাইন করা হয়েছে জার্মানিতে। জার্মান কোম্পানি এই রাইডটির সার্বিক সমন্বয় সাধন এবং গুণাগুণ নিশ্চিত করে বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে। পর্যটন প্রধান দেশগুলোর পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিসমূহ দূর করে অতিথিদের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা প্রদানের নিশ্চিয়তা প্রদান করে।
পুরো ফ্লাই ডাইনিং ডেকটি লম্বায় ৯ মিটার ও চওড়ায় ৫ মিটার। ৮টি নিচে এবং ৮টি উপরে এভাবে মোট ১৬টি ধাতব তারের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা পুরো প্ল্যাটফর্মটি। প্রতিটি দড়ি ৪ টন ওজন নেয়ার ক্ষমতা রাখে। তার মানে এই ১৬টির একটি দড়িই যথেষ্ট পুরো প্ল্যাটফর্মটি ধরে রাখতে। এক্ষেত্রে ওজন বহনে নিরাপত্তা হার বেড়ে যাচ্ছে ৮ গুন।
প্ল্যাটফর্মটির মাঝে একটি সেন্টার টেবিল সহ চারপাশ দিয়ে মোট ২৪টি সিট আছে। প্রতি রাইডে ডেকটি সেন্টার টেবিলে সর্বোচ্চ ৬ জন স্টাফ এবং ২৪ জন অতিথি ধারণ করে।
ফ্লাই ডাইনিং-এর গাঠনিক বৈশিষ্ট্য থেকেই এর নিরাপত্তার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সেই সুবাদে অতিথিদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই আয়োজন করা হয়েছে এই রেস্টুরেন্টটি। চব্বিশটি সিটের নিচের প্ল্যাটফর্মের ভেতরে আছে অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিল। যাত্রীদের প্রত্যেকে নিজেদের আসন গ্রহণ করার পর উড্ডয়নের পূর্বে সবার সিট বেল্ট বেঁধে দেয়া হয়। এ মুহুর্তের অনুভূতিটা অনেকটা প্লেন ছাড়ার আগ মুহুর্তের মত। সিট বেল্টের বন্ধনীর ফলে হাত ও মাথা মুক্তভাবে নেড়ে ওপরে ওঠার পুরো সময়টা উপভোগ করতে পারেন যাত্রীরা। তাছাড়া ভোজন পর্ব শুরু হওয়ার পর স্বাচ্ছন্দ্যে খেতে পারেন প্রতিটি অতিথি। এতে সিট বেল্ট অথবা ডেকটি কোন রকম জটিলতার সৃষ্টি করে না।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যাত্রীদের জন্য ফ্লাই ডাইনিং সার্বজনীন নিয়মনীতি মেনে চলার পরামর্শ দেয়। যেমন উচ্চতা সর্বনিম্ন ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি এবং ওজন সর্বোচ্চ ১৫০ কেজি ওজন সহ ১৩ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ এই রাইডে উঠতে পারবে৷ ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য পিতামাতা বা আইনগত অভিভাবকের উপস্থিতি এবং স্বাক্ষর প্রয়োজন হবে। গর্ভবতী মহিলাদের এক্ষেত্রে অনুমতি দেয়া হয় না। হৃদরোগ, পিঠ ও ঘাড়ের সমস্যা, হাড় ভাঙা, সাম্প্রতিক অস্ত্রোপচার এবং উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ফ্লাই ডাইনিং নিষিদ্ধ।
কক্সবাজার ফ্লাই ডাইনিং-এর সামগ্রিক নির্মাণ কাজ, আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় কাজ করেছে আন্তর্জাতিক পর্যটন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইয়োর ট্রাভেল্স লিমিটেড। ম্যানেজার সানোয়ার শিহাব খানের ভাষায়, ‘১৬০ ফুট উচ্চতায় চব্বিশ জন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই ডেকে বসে মেঘের সাথে খাবার খাওয়া যাবে।’ পরিচালক দিব্যা পাঠাক বলেন, ‘অতিথিরা এই ঝুলন্ত রেঁস্তোরায় জন্মদিনসহ যে কোন পার্টি উদযাপন করতে পারবে।’
কক্সবাজার ফ্লাই ডাইনিং এর মতন বিশ্ব মানের বিনোদনমূলক কার্যক্রম সম্পূর্ণ বদলে দেবে কক্সবাজারের পর্যটন পরিবেশকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যান্য ঐতিহাসিক পর্যটন এলাকাগুলোকেও আরও সাজিয়ে তুলতে অনুপ্রেরণা যোগাবে। ফ্লাই ডাইনিং এর শোভাযাত্রা অত্যাধুনিক নগরায়নের ক্রমবিকাশ তো বটেই, তার সাথে সাথে বিদ্যমান সম্পদের সদ্ব্যবহারেরও পরিচায়ক।