শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন

প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কেন বিদেশমুখী তরুণরা

  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

এগোচ্ছে দেশ, বাড়ছে জীবনযাত্রার মান। তবু কেন মানুষ জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে এতটা আগ্রহী? তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশের প্রতি ভালোবাসায় কেন ভাটা পড়েছে? সঙ্গে জন্ম নিয়েছে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণাও? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নেতিবাচক ধারণার পেছনে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিষয়সহ অন্তত সাত কারণ রয়েছে।

জীবিকার জন্য অনেকে পাড়ি জমাচ্ছেন 
শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়। জীবিকার সন্ধানে অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। ভাগ্যবদলের জন্য অনেকে ভূ-মধ্যসাগরের বিপজ্জনক সমুদ্রপথ পাড়ি দিচ্ছেন। ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা। দালাল ও আদম পাচারকারীদের সংঘবদ্ধ চক্র শরণার্থী, অভিবাসন প্রত্যাশী ও ইউরোপের কাজের সন্ধান করা মানুষকে ছোট নৌযানে করে ইতালিতে আনে। এভাবে সমুদ্রযাত্রায় থাকে মারাত্মক প্রাণের ঝুঁকি। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ঘটনা হচ্ছে সংবাদ শিরোনাম। এত জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণ কী?

গত মাসে সৌদি আরবে মামার সহায়তায় গিয়েছেন এস এম সায়েম। তিনি বলেন, ‘দেশে আয়ের কোনো উপায় নেই। চাকরির জন্য অনেক জায়গায় সিভি পাঠিয়েছি। কোনো কাজ হয়নি। পরবর্তী সময়ে ধারদেনা করে সৌদিতে এসেছি। আমার আর দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।’

বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ইশিতা আকতার বলেন, ‘অর্থনীতিতে একটি সুষ্ঠু কাঠামো গড়ে উঠলেও সাংস্কৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রভাব আমাদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই সনাতন সমাজব্যবস্থা ছিল। এরপর আস্তে আস্তে আমরা আধুনিক সমাজ ও সংস্কৃতির কাঠামোকে গ্রহণ করি। কিন্তু সনাতন ওই ব্যবস্থা আর আধুনিক ব্যবস্থা পাশাপাশি অবস্থান করায় আমরা আধুনিক ব্যবস্থাকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারিনি। বিষয়টি এমন, সনাতন ব্যবস্থায় থেকে আধুনিক ব্যবস্থাকে মনে হয় আরও ভাল। তাই দেশে ঔপনিবেশিক এই মন আমাদের তরুণদের বিদেশমুখী করে তোলার জন্য প্রভাবিত করছে। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ বিচারে এটি একটি বড় কারণ তো বটেই। ’

জীবিকা

তবে সাংস্কৃতিক প্রভাবকের হিসেবে বিচার করলেও দেশের আর্থসামাজিক অবস্থাও এই প্রবণতার পেছনে দায়ী। বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে আয়-বৈষম্য এবং সুযোগ-সুবিধার অভাবও যে এখানে অনেকটা দায়ী তাতেও সন্দেহ নেই।

উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশই ভালো
দেশে শিক্ষার পরিসর বেড়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে অনেকগুলো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার মান নিয়ে যদিও রয়েছে প্রশ্ন কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা চালু হয়েছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের একাংশ বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন। সম্প্রতি একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশে শিক্ষা অর্জনের জন্য যাচ্ছেন। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিশাল একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, জার্মানি, ফিনল্যান্ড ও মালেয়শিয়ায় যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া মন্দ কিছু নয়। কিন্তু দেশে যেসব বিষয় অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে সেসব বিষয়েই অনেকে লেখাপড়া করতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশি তরুণদের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা বা ইচ্ছা বেড়েই চলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত বিশ্ববিদ্যালয় হলেও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য তাদের মাধ্যমে সাধিত হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বরাদ্দ ও গবেষণার অভাবও দায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘দেশে কোনোদিনই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না। তবে বিগত কয়েক দশকে রাজ্যশাসন স্থিতিশীলতা গড়ে উঠেছে। ফলে মানুষ এখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিপরীতে সংঘাতহীন সমাজে বাস করতে পারছে। তবে দেশের রাজনৈতিক সংকট ও ঘনবসতিপূর্ণতার ফলে তরুণ সমাজের মনে হচ্ছে এখানে তারা হয়তো টিকে থাকতে পারবে না। অন্যদিকে দেশে বিদেশে উচ্চশিক্ষার অসংখ্য এজেন্সি গড়ে উঠেছে। তাদের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। অবশ্য এই সুযোগে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের মতো রমরমা ব্যবসাও হয়। বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাটি মূলত আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের যোগাযোগের একটা প্রভাব। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখনো শিক্ষার্থীদের থেকে যাওয়ার পর্যাপ্ত আস্থা দিতে পারছে না।’

শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বেশ নাজুক। জনবল ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব একটি সমস্যা অবশ্যই। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়ে গেছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে শিক্ষার্থীরা হতাশায় ভোগে। তখন তারা দেশ ছেড়ে পালাতে যায়। এখন অনেক শিক্ষার্থীই মনে করে দেশে বিবিএ, ফিজিক্স, ক্যামিস্ট্রি পড়লে টিচারের চাকরি বাদে কিছু পাওয়া যাবে না। শিক্ষা অর্জনের পর তাদের চাকরিবাজারে প্রবেশের একটি ভাবনাও থাকে।’

জীবিকা

রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের পেছনে তাদের এ দেশ থেকে দূর হয়ে বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠার অপ্রত্যক্ষ উদ্দেশ্যও থেকে যায়। এমনকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দক্রম অনুযায়ী পড়তে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি পরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করে ভর্তি হতে হয়। তারা আগে থেকেই জানে না কোন বিষয়ে লেখাপড়া করবে। ভর্তি হওয়ার পর তাদের জটিলতা মানসিক রূপ নেয়। তখন চোখের সামনে বিসিএস একটি বড় সুযোগ। অন্য কর্মসংস্থান তারা দেখতে পায় না। সেখানেও তুমুল প্রতিযোগিতা। আর সেজন্যই তারা বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে।’

নিরাপত্তার অভাব থেকে অনেকে পাড়ি জমান বিদেশে
ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে নিরাপদ শহরের সূচকে ঢাকা ছিল সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ শহর। ১৩৪ জন নারী অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭১ শতাংশ জানান, দেশে নিরাপত্তার অভাবই তাদের দেশ ছাড়ার কথা ভাবতে বাধ্য করছে। তবে বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির কারণে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বিদেশে যাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে বটে। সম্প্রতি তরুণ ও বয়স্কদের চিন্তাভাবনার ব্যবধান খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

অনেকে মনে করছেন, আমাদের পরিবার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ পিছিয়ে রয়েছে। সেইসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা তৈরি করছে। তাই তারা মনে করেন, অন্য দেশে গিয়ে বাকস্বাধীনতা ও নিজ নিজ অধিকার চর্চার মাধ্যমে মুক্তভাবে জীবনযাপন সম্ভব। বর্তমানে ধর্মীয় মৌলবাদের কারণে এ ধরনের অসঙ্গতি দিন দিন বেড়ে চলেছে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতাও এ দেশে বসবাস করতে না চাওয়ার অন্যতম কারণ।

তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজাল ভেঙে নিজেদের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তুলছেন, কথা বলছেন পুরোনো নানান ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবার নিজের মতামত প্রকাশের সুযোগ হওয়ার কারণে তরুণ ও বয়স্কদের চিন্তাভাবনার ব্যবধান আমরা আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।

জীবিকা

শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা 
একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীরা পড়তে আসতেন। এখন তা কমে গেছে। কারণ ভর্তি প্রক্রিয়া জটিল। দেশের শিক্ষার্থীদের জন্যই যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া কঠিন সেখানে বিদেশিদের ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনাও কম হওয়ার কথা। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অনেকের কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারও রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ভুল ধারণা রয়েছে অনেক। হলে সিট নেই, গণরুম ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সেশন জট, শিক্ষার মান এসব তো রয়েছেই। একইসঙ্গে আরেকটি বড় সমস্যা রয়ে যায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোতে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করার মনোভাব দেখা যায় না।’

ড. ইফতেখার উদ্দিন আরও বলেন, ‘প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কিছু আলাদা উক্তি রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক জনপ্রিয়। আবার দেখা যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক মন্তব্য রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছোট বলে এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগে সবাই। স্থানিক বৈশিষ্ট্য আরোপ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে যাচাই করায় উচ্চশিক্ষার বিষয়ে তাদের ধারণা থাকে না। এমনকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় গতিধারায় ঘাটতি রয়েছে।’

তবে তরুণদের এই ধারণার সঙ্গে একমত নন সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশে শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের একটি সংযোগ গড়ে উঠছে। উন্নত বিশ্বে সরকার বা অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন গবেষণা, প্রকল্প ও কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পার্ট টাইম চাকরির একটি ব্যবস্থা করে দিবে বলেছিল। সেটি আশার মুখ দেখলে অনেকেই উৎসাহী হবেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিদেশি শিক্ষার্থী আনার বিষয়েও মনোযোগী হতে হবে। শুধু র্যাংকিং নয়।’

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মান্নান বলেন, ‘২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার খোলার সুযোগ রাখা হয়েছিল। কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় সে মতে আবেদনও করেছিল। কিন্তু এই পর্যন্ত কাউকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বুঝে শুনে নির্বাচিত কিছুকে অনুমোদন দিলে হয়তো শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা হলেও কমতো।’

জীবিকা

ড. আবদুল মান্নান বলেন, ‘সরকার হয়তো মনে করে থাকতে পারে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশে আসতে সুযোগ করে দিলে দেশের টাকা বাইরে চলে যাবে। তবে বর্তমানে যে হারে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার নামে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে আর তাতে যে পরিমাণে দেশের টাকা বাইরে পাচার হচ্ছে  তা তো বন্ধ করার ক্ষমতা কারও তেমন একটা আছে বলে মনে হয় না। একই সঙ্গে যারা চলে যাচ্ছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশে ফিরছে না। টাকাও যাচ্ছে মেধাও পাচার হচ্ছে। এই সব বিষয় নিয়ে নীতি নির্ধারকদের এখনই চিন্তা করতে হবে। দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নয়ন করতে পারলে, এক শ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে তা বন্ধ হলে এবং নির্বাচিত কিছু বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দিলে উচ্চশিক্ষার খোঁজে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে আর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বিদেশে পাচার কিছুটা হলেও বন্ধ হবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করতে হবে।’

আইটি খাতের সক্ষমতা না বাড়ানো
সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে পরিচিত প্রযুক্তি খাতকে সঠিকভাবে গড়ে না তোলার ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাচ্ছেন অনেকে। বিশেষত ফ্রিল্যান্সিং করে আয়ের পথ বন্ধ অনেকের জন্য।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম কায়সার জানান, ‘আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা পুরোপুরি উন্নত হয়নি। এখন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রচারণার জন্য তাদের ওয়েবসাইট ব্যবহার করে এবং শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য অনেক চেষ্টা করে থাকে। আমাদের দেশে প্রযুক্তির এই ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলার কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। তাছাড়া ফ্রিল্যান্সিং খাতে দক্ষ কর্মী যাওয়ার সুযোগও অনেকাংশে বন্ধ হয়ে আছে। পেমেন্ট গেটওয়ে নেই, মার্কেটপ্লেসে কিভাবে অর্ডার আদায় করবে ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে তা-ও তাদের জানা নেই। ফ্রিল্যান্সিং খাতে অনেকে প্রতারণার শিকার হন আবার অনেকে বেটিং সাইট কিংবা এমএলএম সাইট এর ফাঁদে পড়ে অর্থ হারান। এই সমস্যাগুলোর সমাধান না হওয়ায় অনেকেই কোরিয়া বা অন্য অনেক বিদেশে পাড়ি জমান।‘

আয়-বৈষম্য আরেকটি বড় কারণ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ড. মুনতাহা রকিব বলেন, ‘বাংলাদেশের ভেতরে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। সার্বিকভাবে মাথাপিছু আয় বাড়লেও এই আয়ের বৈষম্য রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ২০ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত কোনো দেশ থেকে এভাবে হাজার হাজার মানুষের বিদেশে আশ্রয় প্রার্থনাকে যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যখন দেশকে উন্নয়নের মহাসরণীতে নিয়ে যাওয়ার দাবি করছে, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশ উন্নয়নশীল থেকে মধ্য আয়ের দেশের পরিণত হতে চলেছে, ঠিক তখন কেন এভাবে হাজার হাজার তরুণ-যুবক দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে! দেশের সরকার এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। ভূ-মধ্যসাগরে আটক হওয়া এবং আশ্রয় প্রার্থীদের ক্রাইটেরিয়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদেশে আশ্রয় প্রার্থী এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পথে পাড়ি জমানো ব্যক্তিদের শতকরা ৯০ভাগেরই বয়েস ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে যেমন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত যুবক রয়েছে, আবার শহুরে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর স্বল্প-শিক্ষিত বেকার ও উচ্চাভিলাষী তরুণ-তরুণীও আছে।

জীবিকা

মূলত দেশে যথোপযুক্ত কর্মসংস্থান না থাকা, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান এবং রাজনৈতিক কারণে পুলিশি হয়রানি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক যুবক-তরুণ এমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়ছে। অবৈধ পথেই শুধু নয়, সচ্ছল ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মেধাবী সন্তানরা লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির আবেদন করেও দেশ ছাড়ছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এদের বেশিরভাগই আর দেশে ফিরে আসেনা।

দ্বৈত নাগরিকত্বও একটি কারণ
বাংলাদেশিদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের পরিসর আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চলতি বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগে ইউরোপ আমেরিকাসহ মোট ৫৭টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা পাওয়া যেত। নতুন করে আরও ৪৪টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ দেওয়া হবে এবং এ বিষয়ে এসআরও জারি করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের ১৯টি, দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ১২টি, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ১২টি এবং ওশেনিয়া মহাদেশের ১টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা পাবে বাংলাদেশিরা। তবে সরকারি চাকরিতে কর্মরত কেউ এ সুবিধা পাবেন না তা বলা হয়েছে। মন্ত্রীসভার বৈঠকের এ সিদ্ধান্তে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন এ সিদ্ধান্তে আমাদের ক্ষতি হবে। আবার অনেকে এর ভালো দিকও দেখতে পাচ্ছেন। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন সিদ্ধান্তের ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক নিয়ে অত ভাবার কিছু আপাতত নেই। কারণ এ সুবিধা অতীতেও ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, ‘উন্নত বিশ্বের দেশে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা বাড়লে বাইরে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ দেখতে পাই, তেমনি আমাদের অর্থ দেশের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে নাগরিকরা অন্য দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সরাসরি আমানত রাখতে পারেন। অর্থাৎ আইনি প্রক্রিয়াতেই দেশের অর্থ বিদেশে নিয়ে যাওয়া যাবে। আর অন্য একটি দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার পর সেখানে বসবাস করা শুরু করলে নিত্যদিনের খরচাপাতি কিংবা সুযোগ-সুবিধা ওই রাষ্ট্র থেকেই নেবেন।

সেদিক থেকে আমাদের কাছে সব সময় বৈদেশিক মুদ্রা আসবে এমনটা প্রত্যাশিত নয়। একটি বিষয় লক্ষ্য করা জরুরি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ আসে সস্তা শ্রমের বিনিময়ে। আমরা দেখছি, শ্রমিকের কষ্টার্জিত অর্থই রেমিট্যান্স আকারে আসে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষরা উন্নত দেশগুলোর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের অর্থ গচ্ছিত রাখেন। দ্বৈত নাগরিকত্ব সুবিধা পাওয়ার পর তাদের দুই দেশেই কর দিতে হয়। কিন্তু কেউ কেউ জন্মভূমির সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ বিদেশে নিয়ে যান। তাদের বক্তব্য, যেহেতু এখানকার সম্পত্তি তাদের ব্যবহার করা হয় না— তাই অহেতুক কর না দিয়ে বিক্রি করে দেওয়াই ভালো। আমাদের অবকাঠামোগত অসুবিধার কথা চিন্তা করেই অনেকে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন।’

ইত্তেফাক

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com