সিডনিকে বলা হয় ‘রঙের শহর’। সিডনির বছর শেষের এবং শুরুর আতশবাজি পৃথিবীবিখ্যাত। সেখানে আতশবাজির শুরুতে যে চলচ্চিত্র দেখানো হয় সেখানে সিডনিকে উপস্থাপন করা হয় ‘সিটি অব কালারস’ হিসেবে। প্রকৃত অর্থেও সিডনি আসলেই রঙের শহর। রঙ যেমন এর প্রকৃতিতে তেমনি এখানে বসবাসরত মানুষের মধ্যে।
পঞ্জিকা অনুযায়ী এখানে চার ঋতু–গ্রীষ্ম, শরত, শীত এবং বসন্ত। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সিডনির রঙ বদলে যায়। গ্রীষ্মের সিডনি তপ্ত এক নগরী। তাপমাত্রা কখনও কখনও পঞ্চাশের ঘর ছাড়িয়ে যায়। শরতের শুরুতেই সিডনির গাছগুলোর পাতা বাহারি রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নেয়। এরপর শীতের সিডনি যেন নির্জীব এক শহর। গাছগুলো তখন পাতা ঝরিয়ে যেন বিশ্রাম নেয় আর তৈরি হয় বসন্তের জন্য।
আর তারই সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিডনির রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে ইমারতগুলোও সেজে উঠে। এছাড়াও সিডনির নিজস্ব কিছু উৎসব থাকে বছরজুড়ে। বিশেষ করে শীতকালের নির্জীব সিডনিকে সজীব রাখতে আয়োজন করা হয় চোখ ধাঁধানো এক আলোক উৎসবের। এই আলোক উৎসব ‘ভিভিড সিডনি’ নামে পরিচিত। এভাবেই সিডনি হয়ে উঠে রঙের নগরী।
কিন্তু গত প্রায় দুই বছরের লকডাউনের ফলে সিডনির কোনো উৎসবই আলোর মুখ দেখেনি। যার ফলে সিডনি যেন তার রঙ হারিয়ে একেবারে শীতকালের গাছের মতো ধূসর বর্ণ ধারণ করেছিলো। অবশেষে করোনার টিকা গ্রহণের নির্দিষ্ট হার অর্জিত হওয়ার পর লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। যদিও সিডনির অধিবাসীদের দেখলে মনে হবে যেন লকডাউন পুরোপুরি উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।
অবশ্য এখনও জনসমাগমের স্থান যেমন শপিংমল ও জনপরিবহনে মাস্ক বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। এছাড়াও সব জায়গাতেই পরিপূর্ণ টিকাদানের ছাড়পত্র ও কিউ আর কোড স্ক্যান করে প্রবেশ করতে হচ্ছে। কিন্তু এতে করে উৎসব প্রিয় সিডনিবাসীকে আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে। তারা মুক্তির আনন্দে বের হয়ে এসেছে।
গত ২৫শে অক্টোবর ২০২১ থেকে লকডাউন শিথিল করার পর আমরা আজই (৩০ অক্টোবর ২০২১) প্রথম বের হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো হারবার ব্রিজ এ যাওয়া। অবশ্য হারবার ব্রিজ আর অপেরা হাউস কাছাকাছি হওয়াতে একইসঙ্গে দুটোই দেখা হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের এবারের লক্ষ্য ছিলো হারবার ব্রিজের শুরুর জায়গাটা যেটাকে বলা হয় ‘দ্য রকস’। সেখানে নেটফ্লিক্সের বর্তমানের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজ ‘স্কুইড গেম’র প্রথম খেলা ‘রেড লাইট, গ্রিন লাইট’ যেটা অনেকটা বাংলাদেশের বরফ পানি খেলার মতো।
এই সিরিজে দেখানো হয়েছে একটা হলুদ রঙের পুতুল এই খেলাটা পরিচালনা করে। সেই পুতুলেরই একটা রেপ্লিকা স্থাপন করা হয়েছে দ্য রকসে। সার্কুলার কিয়ে স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ। স্টেশন থেকে বের হয়েই আমরা যেন জনস্রোতে মিশে গেলাম। অনেকদিন পর একসঙ্গে এতো মানুষ দেখে খুবই ভালো লাগছিলো। আর আগামীকাল (৩১ অক্টোবর ২০২১) সারা অস্ট্রেলিয়াজুড়ে পালিত হবে ‘হ্যালোইন’ উৎসব তাই তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে শিশুদের পোশাক আশাকে ছিল তার ছোঁয়া।
তারা বাহারি সব সাজে সেজে চলাচল করছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন গত দুই বছরের ধূসর সিডনির গাঁয়ে একটু একটু করে রঙের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। যাওয়ার পথে সিডনি অপেরা হাউসকে পেছনে রেখে আমরা একটা গ্রুপ ছবি তুলে নিলাম। যেমন প্রথমবার কেউ সিডনি আসলে সবাই ছবি তুলে। অতিমারির সময় পেরিয়ে আমরাও যেন সিডনিকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করলাম। এরপর ‘স্কুইড গেম’র পুতুলের সঙ্গে ছবি তুলে আমরা উদ্দেশ্যবিহীন হাটা শুরু করলাম।
এই উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটিও আমরা খুবই উপভোগ করছিলাম। পথে পথে মানুষের কলরব। আহা কতদিন পর সেই পুরোনো কোলাহলে ফেরা। অনেকেই ছবি তুলছেন পরিবারের সঙ্গে। আমরা যেমন অনেকের পারিবারিক ছবি তুলে দিতে সাহায্য করলাম ঠিক তেমনি অনেকেই আমাদেরও সাহায্য করলো। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুধা পেয়ে গিয়েছিলো সবার। তখন রাস্তার একটা স্প্যানিশ টং দোকান থেকে বাংলাদেশের খিচুড়ির মতো একটা খাবার কিনে উদরপূর্তি করে খেয়া নেওয়া হলো।
পাশাপাশি বড়দের জন্য কফি আর ছোটদের জন্য নেওয়া হলো আইসক্রিম। এভাবেই একটা সময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়ে গেলো কিন্তু আমাদের ফেরার কথা মনে ছিলো না। মানুষের এই মুখর পদচারণ যেন জীবনের প্রতিচ্ছবি। অতিমারির দমবন্ধ সময় পেরিয়ে মানুষ যেন একটু বুকভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। পথে পথে মানুষের কোলাহল যেন গেয়ে চলেছে নবজীবনের জয়গান।
প্রকৃতির নিয়মে সময় ডানায় ভর করে সিডনিতে এসেছে শীতের পর বসন্ত। গাছে গাছে নতুন পাতা আর ফুলের মেলা। অস্ট্রেলিয়ার বসন্তের সিগনেচার ফুল জ্যাকারান্ডা ফুটতে শুরু করেছে। শীতের নির্জীব গাছে পাতা আশার আগেই বেগুনী রঙের এই ফুল ফুটে গাছটাকে একেবারে পুরোপুরি বেগুনী রঙের চাদরে ঢেকে দেয়। পাখির চোখে তখন সিডনি শহরকে দেখলে মনে হবে যেন কোনো নিপুণ শিল্পী মনের আনন্দে সিডনি শহরকে বেগুনী রঙে রাঙিয়ে দিয়েছেন।
আমাদের আশা সিডনি তথা পুরো বিশ্বই খুব দ্রুত যেন অতিমারির এই প্রকোপ কাটিয়ে উঠে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। রঙ লাগবে বিশ্বে, রঙ লাগবে সিডনিতে। প্রকৃতির রঙের পাশাপাশি মানুষের উৎসবমুখর পদচারণায় আবারও মুখরিত হয়ে উঠবে সিডনির পথঘাট, বিপণীবিতান থেকে শুরু করে সব জায়গা। আবারও প্রাণ ফিরে আসুক সিডনীতে। আবারও সিডনি হয়ে উঠুক রঙের শহর।