অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে এমন আরো অনেক অপরাধীচক্র রয়েছে, যারা নারীপাচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে।
চক্রের সদস্যরা
চক্রের হোতা মেহেদী হাসান ও শেখ জাহিদ পরস্পর খালাতো ভাই। চক্রের অন্য যে ছয় সদস্যকে সিআইডি গ্রেপ্তার করেছে, তাঁরা হলেন : জাহিদ হাসান কাঁকন, তানভীর আহমেদ ওরফে দীপ্ত, সৈয়দ হাসিবুর রহমান, শাদাত আল মুইজ, সুস্মিতা আক্তার ওরফে পপি ও নায়লা ইসলাম। গত মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকা, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর ও যশোরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
অবৈধ অর্থে দেশে বিপুল সম্পদ
সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থে অপরাধীরা ঢাকাসহ যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা এবং দেশের আরো কয়েকটি এলাকায় প্রচুর জমি কিনেছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে তাঁদের চিংড়িঘের। বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বাড়ি। স্বজনদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিপুল অর্থ রেখে পাচার করা হয়েছে বিদেশে।
দেশে-বিদেশে রয়েছে চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক
সিআইডি সূত্র জানায়, দেশে-বিদেশে চক্রটির রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শতাধিক চ্যানেলে কয়েক লাখ গ্রাহক সংগ্রহ করা হয়েছে। অর্থ লেনদেন করতে তারা ব্যবহার করত এমএফএস (মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস)। এ ছাড়া ক্রিপ্টোকারেন্সিতেও তাদের অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
সিআইডির তদন্ত
তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা অনেক চ্যালেঞ্জের ছিল। দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার চক্রের হোতাসহ অন্যদের শনাক্ত করে।
সিআইডি সূত্র জানায়, চক্রটির রয়েছে শত শত মোবাইল সিম। তবে এসব সিম ন্যাশনাল আইডি দিয়ে নিবন্ধন করা নয়। এ ক্ষেত্রে তারা নিম্ন আয়ের মানুষকে সামান্য অর্থ দিয়ে সিম কার্ড তুলে নিত। কনটেন্ট আদান-প্রদান ও সাবস্ক্রিপশনের জন্য রয়েছে তাদের টেলিগ্রাম প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট এবং বিভিন্ন পেইড ক্লাউড সার্ভিস।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে ‘আইডেন্টিফায়ার’, ও ‘জনস্বার্থে আমরা’ নামক টেলিগ্রাম আইডি, হাসিব অ্যান্ড সিল্ক ট্রাস্টেড এজেন্সি, ডিরেক্ট দেশি, ঢাকা রিয়েল সার্ভিস সেন্টার, রাফসান হক এন্টারটেইনমেন্ট এজেন্সি, বাংলাদেশ এসকর্ট এজেন্সি, ইন্টারন্যাশনাল এসকর্ট সার্ভিস, মডেল অ্যান্ড সেলিব্রিটি জোন, বিডি এসকর্ট সার্ভিসসহ অসংখ্য টেলিগ্রাম গ্রুপ ও টেলিগ্রাম চ্যানেলে অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীদের বিপুল ন্যুড ছবি ও ভিডিও উদ্ধার করে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্টন থানায় পর্নোগ্রাফি আইন, পেনাল কোড ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে।
দুই হোতার স্বীকারোক্তি
চক্রের হোতা মেহেদী হাসান ও শেখ জাহিদ বিন সুজন সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তাঁরা বিভিন্ন সময় ‘নারী’সহ বিভিন্ন পেশার মানুষের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছিলেন। এরপর নিজেরাই মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে অপরাধজগত্ গড়ে তোলেন। শুরুতে তাঁরা অল্পবয়সী নারীদের টার্গেট শুরু করেন। ফাঁদে ফেলে শুরু হয় বিভিন্ন প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট তৈরি। এরপর সেগুলো টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে তাঁদের চ্যানেলে গত সাত বছরে গ্রাহকদের সরবরাহ করে প্রায় ১০০ কোটি টাকা আয় করেন। সিআইডি সূত্র বলছে, এই দুই হোতার খপ্পরে রয়েছেন কয়েক শ নারী। এই নারীদের মধ্যে রয়েছেন টিকটক, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম সেলিব্রিটিও।
সিআইডিপ্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, কাজের সুযোগ করে দেওয়ার নামে চক্রটি নারীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিদেশেও তারা বিপুল অর্থ পাচার করেছে।