অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী মানুষের কাছে অত্যন্ত পছন্দের এক গন্তব্য হচ্ছে কেভ কিংবা গুহা। সাধারণভাবে আমরা যে ধরনের পরিবেশে বসবাস করি, গুহার ভেতরের পরিবেশ সে তুলনায় একেবারে আলাদা। সূর্যালোকের সংস্পর্শ না থাকায় গুহার ভেতরের পরিবেশ অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। রূপকথার রাজ্যের মতো একেকটি গুহাও যেনও আমাদের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ; পৃথিবীতে এর অবস্থান সত্ত্বেও যেন পৃথিবীর বাইরে।
এমনই একটি গুহা পোস্তোয়ানা। মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়ায় অবস্থিত। বর্তমানে এই গুহা রহস্যপ্রেমীদের কাছে এক জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। অন্য দেশ থেকে স্লোভেনিয়ায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের বলতে গেলে সবাই লেক ব্লেড এবং পোস্তোয়ানাকে তাঁদের তালিকা শীর্ষে রাখেন।
পোস্তোয়ানা গুহার প্রতি দর্শকদের এত আগ্রহের কারণ জানতে চেয়েছিলাম সেখানকার এক স্থানীয় অধিবাসীকে। তিনি জানান, ইউরোপের মধ্যে এ রকম গুহা নাকি আর একটিও নেই। বিশেষ করে তিনি হিউম্যান ফিশ নামক এক বিশেষ শ্রেণির জলচর প্রাণীর কথা বললেন, যার দেখা কেবল এই পোস্তোয়ানা গুহাতেই পাওয়া যায়। তাঁর মতে, পোস্তোয়ানা গুহা হচ্ছে প্রকৃতির এমন এক নিদর্শন,যার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপকরণ।
সপ্তদশ শতাব্দীতে কার্নিওলার বিখ্যাত স্কলার ইয়োহান উইকহার্ড ভন ভালভাসোর সর্ব এ গুহার কথা তুলে ধরেন; যদিও ঐতিহাসিকদের মতে ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই পোস্তোয়ানাসহ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে মানুষের বসবাস ছিল।
১৮১৮ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের শাসক প্রথম ফ্রান্সিস এ গুহা পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম ফ্রান্সিসের আগমন উপলক্ষে গুহাটির বিভিন্ন অংশে লাইট বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; যার মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় লুকা চেচ নামের স্থানীয় এক অধিবাসীকে। গুহার বিভিন্ন অংশে লাইট স্থাপন করার সময় তিনি নতুন করে এর সম্প্রসারিত অংশ আবিষ্কার করেন। পরবর্তী বছর, অর্থাৎ ১৮১৯ সালে অস্ট্রিয়ার আর্কডিউক এই গুহা পরিদর্শন করেন; এর মধ্য দিয়ে পোস্তোয়ানা গুহা আনুষ্ঠানিকভাবে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে যাত্রা শুরু করে। লুকা চেচ ছিলেন পোস্তোয়ানা গুহার ইতিহাসে প্রথম ট্যুরিস্ট গাইড। ১৮৮৪ সালে সম্পূর্ণ গুহাটি বিদ্যুৎ–সংযোগের অধীনে আনা হয়। এ সময় থেকে গুহার ভেতরে ইলেকট্রিক লাইট স্থাপন করা শুরু হয়।
অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডের কথা আমরা অনেকে শুনেছি। ১৯১৪ সালের ১৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে বিদ্রোহী সার্ব মিলিশিয়া বাহিনীর এক সদস্যের গুলিতে তিনি নিহত হন। অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং একই বছরের ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরই রেশ ধরে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। রাশিয়া এ সময় সার্বিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে এবং সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে না জড়ানোর জন্য অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিকে হুঁশিয়ারি প্রদান করে। এর তিন দিন পর, অর্থাৎ ৩১ জুলাই জার্মানিও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে কাজ করা সৈনিকদের হাতে বন্দী রাশিয়ানরা গুহার ভেতরে একটি ব্রিজ নির্মাণ করেছিলেন, যা আজও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানি ও ইতালির সম্মিলিত বাহিনী স্লোভেনিয়া দখলে নেয়। এ সময় জার্মান ও ইতালিয়ান সৈন্যরা এ গুহার ভেতর প্রায় এক হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেলের মজুত রেখেছিলেন। ১৯৪৪ সালে স্লোভেনিয়ান পার্টিশান বাহিনী জার্মান ও ইতালিয়ান সৈন্যদের মজুত করা জ্বালানি তেলে আগুন ধরিয়ে দেয়, যার ফলে গুহার এক অংশ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সাম্প্রতিক কালে এ গুহার ভেতরে পোস্ট অফিস স্থাপন করা হয়েছে; এখন পর্যন্ত মাটির তলদেশে অবস্থিত এটি পৃথিবীর একমাত্র পোস্ট অফিস। সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১২ থেকে ১২ লাখ মানুষ পোস্তোয়ানা গুহা পরিদর্শনে আসেন।
এটা ঠিক যে বিদেশি পর্যটকেরা যেভাবে পোস্তোয়ানা গুহা পরিদর্শনের জন্য উৎসাহ দেখান, স্লোভেনিয়ার স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সেই আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না।
স্লোভেনিয়ার স্থানীয় পর্যটকেরা পোস্তোয়ানার তুলনায় স্কোচিয়ান নামক অন্য একটি গুহাকে অধিক গুরুত্ব দেন। তাঁদের মতে, পোস্তোয়ানার তুলনায় নাকি স্কোচিয়ানের গুহাটি আরও বেশি প্রাকৃতিক। বিদেশি পর্যটকেরা দুটি কারণে স্কোচিয়ানে আসতে চান না, প্রথমত এর যাতায়াতব্যবস্থা। স্কোচিয়ানে পৌঁছাতে হলে লুবলিয়ানা থেকে প্রথমে বাস কিংবা ট্রেনে করে ডিভাচাতে আসতে হবে। সেখান থেকে প্রায় দুই মাইল হাঁটতে হবে। দ্বিতীয়ত, পোস্তোয়ানা গুহার ভেতরে মিনি রেল সংযোগ থাকায় পর্যটকেরা না হেঁটে পুরো গুহা পরিদর্শন করতে পারেন, যেটা স্কোচিয়ানের ক্ষেত্রে হয় না।
ইউরোপের দীর্ঘতম কার্স্ট গুহাগুলোর মধ্যে পোস্তোয়ানা একটি। পোস্তোয়ানা গুহার ভেতরের অংশের প্রধান উপাদান হচ্ছে কার্স্ট, যা মূলত লাইমস্টোন বা চুনাপাথরে তৈরি। ভূগর্ভস্থ নদী পিভকার জলীয় প্রবাহ এ গুহা সিস্টেম তৈরির মূল কারিগর।
গুহার ভেতরে সূর্যের আলো ঢুকতে না পারায় সেখানকার পরিবেশ সব সময় অন্ধকারাচ্ছন্ন ও স্যাঁতসেঁতে।
এ কারণে গুহার ভেতরে বসবাস করা প্রাণীগুলো সেভাবে অভিযোজিত হয়েছে। এরা কোনো ধরনের আলো সহ্য করতে পারে না, এদের দৃষ্টিশক্তিও অত্যন্ত ক্ষীণ। পাশাপাশি এদের ত্বকে পিগমেন্টের উপস্থিতি না থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এরা বর্ণহীন কিংবা হালকা বর্ণের হয়ে থাকে। তাই গুহার ভেতরে ঢোকার সময় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছিল, নির্দিষ্ট কিছু স্থান ব্যতীত অন্য কোথাও যেনও আমরা কোনো ধরনের ছবি তোলার চেষ্টা না করি। গুহার ভেতরে ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
হিউম্যান ফিশের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে প্রোটিয়াস অ্যাগিনাস। প্রকৃতপক্ষে হিউম্যান ফিশ হচ্ছে একশ্রেণির সালাম্যান্ডার। অনেকে গড়ে প্রায় ১০০ বছর বাঁচতে পারে এবং কোনো রকম খাবার ছাড়া বেশ কয়েক বছর বাঁচতে পারে। হিউম্যান ফিশের পাশাপাশি পোস্তোয়ানা গুহায় বসবাস করা অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে রয়েছে স্লেনডারনেক নামক এক বিশেষ প্রজাতির বিটল এবং বিভিন্ন ধরনের কৃমি ও বিশেষ এক প্রজাতির মাকড়সা।
এই গুহার পাশে রয়েছে ভিভিরিয়াম এবং একটি মিউজিয়াম। গুহার ভেতরের ইকোসিস্টেমসহ সেখানে বসবাসরত জীবদের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে ভিভিরিয়ামে জড় হন সবাই। মিউজিয়ামটি আমার কাছে বিশেষ কিছু মনে হয়নি। প্রজাপতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ও তাদের দেহের অংশবিশেষ সেখানে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মধ্যযুগে পোস্তোয়ানা কিংবা এর আশপাশের অঞ্চলে জনবসতি স্থাপন করা অধিবাসীদের ব্যবহার করা বিভিন্ন নিদর্শনও এখানে রয়েছে। পাশাপাশি আছে একধরনের বিশেষ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে পোস্তোয়ানা গুহার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যাবে।
যেকোনো দেশের পর্যটনশিল্পে গুহা বাড়তি মাত্রা দান করে, বিশেষত অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী মানুষের কাছে গুহা মানে উল্লেখযোগ্য কোনো কিছু। স্লোভেনিয়ার মোট জনসংখ্যা ২১ লাখের মতো। অথচ এক পোস্তোয়ানা গুহা দেখতেই প্রতিবছর আসে অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ পর্যটক। ফলে দেশটির অর্থনীতিতে বর্তমানে পোস্তোয়ানা গুহার গুরুত্ব অপরিসীম।
কোনো কোনো গুহা আবার ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে শুরু করে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষার কাজে গুহা হচ্ছে অন্যতম আদর্শ স্থান। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত গুহা থেকে বঞ্চিত। আমাদের বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে আলুটিলা এবং বাদুড়গুহা নামক দুটি গুহা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করতে হলে এখন থেকেই এ দুটি গুহাকে পরিকল্পনামাফিক সাজানো প্রয়োজন। তাহলে পোস্তোয়ানা গুহার মতো আলুটিলা ও বাদুড়গুহাও এ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
লেখক: রাকিব হাসানশিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।