রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৪ পূর্বাহ্ন

পাহাড়ের রানী উটি, চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য

  • আপডেট সময় সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৩

মেঘলা আকাশ। তবে প্লেন থেকেই দেখা যাচ্ছিল দক্ষিণের শৈল শহরের কালো পাহাড়গুলো। প্লেন যখন কোয়েম্বাতুর রানওয়ে স্পর্শ করল তখন ভরদুপুর। কেরালার সীমানাঘেঁষা তামিলনাড়ু রাজ্যের একটি জেলা কোয়েম্বাতুর। এবার গন্তব্য নীলগিরি জেলার ‘পাহাড়ের রানী’খ্যাত ‘উটি’র পথে। টুরিস্ট বাস চেপে রওনা দিলাম প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচু শহরে। দূরত্ব প্রায় এক শ’ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪০ কিলোমিটারই পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথ। পথের দু’পাশে অসংখ্য সুপারি আর নারিকেল গাছ। এই পাহাড়ী বনে বানর, হরিণ, নীলগাই, চিতা বাঘসহ বিভিন্ন প্রাণী ও পাখির আবাস। বানরের দল চোখে পড়ল বেশ কয়েকবার। যাত্রা বিরতিতে একবার নীলগাইও দেখা দিল। তাও আবার একজোড়া। একেবারে বন্য অবস্থায় এসব প্রাণী দেখতে পাওয়াও সৌভাগ্যের। অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখলাম এখানে। একবারও কানে আসেনি টুরিস্ট বাসের হর্ন। এক পর্যায়ে সবুজের বুকে মেঘ ঢেকে যাচ্ছিল বার বার। পাহাড় দেখা যাচ্ছে না।

এখানে পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা বসতি সত্যি এক বিস্ময়। সবুজ পাহাড়ের কঠিন বুক চিরে সাজানো লাল-নীল সব সংসার। টোডা ও কোটা নামে একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এ অঞ্চলের আদি অধিবাসী। তাই শহরজুড়ে তাদের নানা চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। পরে ব্রিটিশদের উপনিবেশ থাকায় বলা যায় তারাই গড়ে ছিল শহরটি। উটির আসল নাম উধাগম-লম। পাইনের বন, চা-কফির বাগান আর মেঘে ঘেরা উটিতে রয়েছে একাধিক লেক, জলপ্রপাত ও বোটানিক্যাল গার্ডেন। ‘উদাগাম-লম’ আদি নাম হলেও লোকের মুখে পরিচিত ‘উটি’ হিসেবেই। উটির পশ্চিমে কেরালার মালাপ্পুরম জেলা, দক্ষিণে কোয়েম্বাতুর ও পালাক্কাদ, পূর্বে ইরোড এবং কর্নাটকের চামরাজনগর জেলা এবং উত্তরে কেরালার ওয়ানাদ জেলা। তিনটি রাজ্য তামিলনাড়ু, কেরালা ও কর্নাটকের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই ‘উটি’। জনসংখ্যার অধিকাংশ মালয়ালি ও কান্নাডিগা। উটির আশপাশের ছোটখাটো শহরগুলোর নাম এখনও সেই ব্রিটিশদের নামানুসারে। উটির পাশেই একটি শহর আছে ওয়েলিংটন নামে। পথ চলতে চলতে পাহাড়ে সন্ধ্যা নামল।

রাতের আবাস যেখানে ‘স্টারলিং ফার্ন হিল রিসোর্টের’ নামটিও সেই ব্রিটিশদের নামানুসারে। দিল্লীর ৩৫ ডিগ্রী তাপমাত্রায় যাত্রা শুরু করে রিসোর্টে পৌঁছাতে তাপমাত্রা নামল ১২ ডিগ্রীতে। তবে শীতে শূন্যে নেমে আসে এখানকার তাপমাত্রা। ১৯৮৩-৮৪ সালের উটিকে ফ্রেমে ধরেছিল ডেভিড লিনের ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’, কমল হাসন-শ্রীদেবীর ‘সদমা’। কসমো-কালচারে সমৃদ্ধ এ শহরকে ব্রিটিশরা হ্যান্ডমেড চকোলেট তৈরি থেকে শুরু করে শিখিয়ে ছিল অনেক কিছুই। পরদিন ভোরের আলোয় বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। পানির জন্য বেশ সংগ্রাম করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। বৃষ্টি এখানে আশীর্বাদ। দক্ষিণ ভারতে খাবার হিসেবে ইডলি, দোসা খুব জনপ্রিয়।

রিসোর্টের সামনে নানা প্রজাতির ফুল চোখ জুড়ালো। প্রকৃতিকে আঘাত না দিয়েই জীবন গড়েছে এখানকার মানুষ। জীবনের তাগিদে যতটুকু কাটাছেঁড়া করা দরকার ঠিক ততটাই। প্লাস্টিক-পলিথিন এখানে একেবারেই নিষিদ্ধ। রুমের পানির বোতলও সব কাচের। কোন পণ্য কিনলে মেলে কাগজ কিংবা কাপড়ের ব্যাগ। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এখানে প্রচুর চা, কফি ও চকোলেট হয়। উটি শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরের একটি চা জাদুঘর রয়েছে। এ যেন এক অন্যরকম জাদুঘর। টিকেট ১০ রুপী। ভেতরে ঢুকে চোখে পড়ল এ অঞ্চলে চায়ের ইতিহাস সংবলিত কিছু ছবি। চায়ের কাঁচাপাতার ঘ্রাণ লাগছে নাকে এসে। একটু ঘুরে তাকিয়ে দেখা গেল চায়ের পাতা একেকটি কন্টেনারে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে মেশিনের মধ্যে। এটি একটি চা কারখানাও। দর্শনার্থীদের কাছে বড় আকর্ষণ এটি। চা কিভাবে তৈরি হয় তা সরাসরি দেখা। সবচেয়ে বড় চমক উৎপাদিত টাটকা চায়ের গরম গরম এক কাপ চা। দর্শনার্থীদের জন্য এটা বিনামূল্যে। বাইরে বেরিয়ে সারি ধরে চায়ের দোকান।

সেখান থেকে কেনা যাবে হরেক পদের চা। সর্বনি¤œ ২শ’ টাকা থেকে শুরু সর্বোচ্চ নয় হাজার টাকা দামের চা কিনতে পারবেন এখানে। এ ছাড়া টি অয়েল থেকে শুরু করে মিলবে বিভিন্ন হারবাল পণ্য। চমক এখানেই শেষ নয়, চা দেখে বের হওয়ার কোন রাস্তা নেই। আবার উপরে উঠতে হবে। এবার চকোলেট কারখানা দেখার পালা। হাতে তৈরি চকোলেট সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে বিখ্যাত। সেই চকোলেট তৈরি দেখা এবং কেনার সুযোগও আছে। দাম কেজিপ্রতি ৫শ’ থেকে ২ হাজার রুপী পর্যন্ত। কারখানার বাইরে পরিবেশটাও মন ভোলানো। পর্যটকদের কীভাবে আকর্ষণ করতে হয় এরা তা জানে।

ওটি বোটানিক্যাল গার্ডেন ভারতের প্রাচীনতম উদ্যানগুলোর মধ্যে একটি। এটি ১৮৯৭ সালে মার্কুইস অফ টুইডেল দ্বারা স্থাপন করা হয়েছিল এবং এটি ৫৫ একর জুড়ে বিস্তৃত। এখানের বিশেষ আকর্ষণ মাঙ্কি পাজল ট্রি ও দুই কোটি বছর আগের একটি গাছের জীবাশ্ম। মাঙ্কি পাজল ট্রির বিশেষত্ব হলো প্রায় সব গাছে চড়তে পারলেও বানর এতে চড়তে পারে না। এ গাছ সাত শ’ বছর বাঁচে। উদ্যানে দুটি গাছ রয়েছে। একটি শতবর্ষী। গাছের পাতা দেখতে ছোট সবুজ হলেও পাতা বেশ শক্ত এবং কাঁটার মতো। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল, অর্কিডসহ কয়েক হাজার প্রজাতির গাছ।

এ ছাড়া রোজ গার্ডেন (দুই হাজারের বেশি প্রজাতির গোলাপ আছে কালো ও সবুজসহ), উটির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ দোদাবেত্তা (২৬২৩ মিটার), উটি লেক, কালাহাটি জলপ্রপাত, ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ নীলগিরি মাউন্টেন রেল স্টেশন প্রভৃতি জায়গা। এখানে বিখ্যাত টয়ট্রেনও রয়েছে।

স্টারলিং ফার্ন হিল রিসোর্টের কর্মকর্তা মাহতাব উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, উটিতে মানুষ বেড়াতে আসার অন্যতম কারণ এখানকার আবহাওয়া। সারা বছরই এখানে সহনীয় তাপমাত্রা থাকে। দেশের অন্য জায়গায় যত গরম পড়ুক উটির তাপমাত্রা কম থাকে। দক্ষিণের তিন রাজ্যের সংযোগ হওয়ায় এখানে দক্ষিণের লোকই বেশি আসে। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী আসে ঘুরতে, জানতে ও পড়তে।

উটি হাতে তৈরি ট্র্যাডিশনাল চকোলেট, চা পাতা, কফি, টোডাদের তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্পের জন্য নামকরা। এ ছাড়া শীতপ্রধান জায়গা হওয়ায় শীতের শাল, জ্যাকেট, সোয়েটার পাবেন বেশ সস্তায়। তাদের ট্র্যাডিশনাল পোশাক ছেলেদের লুঙ্গি, সাদা জামা, বেল্ট ও পাগড়ি বা ওড়নাও পাবেন মোটামুটি সস্তায়। খুব ভাল মানের সব ধরনের মসলা পাবেন এখানে। কেনাকাটার জন্য মার্কেট রয়েছে সব পর্যটন স্পট ঘিরে। তবে লোকাল মার্কেটে দাম কম। কোন অটোওয়ালাকে বললে তিন-চার ঘণ্টায় পুরো শহর ঘোরাবে মাত্র হাজার রুপীতে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com