শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৪ পূর্বাহ্ন

পাহাড় থেকে সমুদ্র

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

নেগাম্বোর বন্দরনায়েকে বিমান বন্দরে নামলাম ভরা শ্রাবণের ভর সন্ধেবেলায়। বাইরে তখন ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ইমিগ্রেশন ফর্ম জমা দিয়ে অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে টুর অপারেটারের বাসে চড়ে এসে পৌঁছেছি নেগাম্বোর এক হোটেলে। সমুদ্রের ধারে ভারি সুন্দর জায়গায় হোটেলটা। রাতের খাবার খেতে এসে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সাগর বেলায় খোলা আকাশের নীচে লণ্ঠনের আলোয় আজ বুফে ডিনার। দুই সিংহলী দারুণ মিষ্টি সুরে বাঁশি বাজাচ্ছে। সমুদ্র থেকে ভেসে আসছে নোনা হাওয়া। এদের বেশভূষা, আদবকায়দা, খাবারদাবার সবেতেই পর্তুগিজদের প্রভাব। খাবারে ঝাল আর মশলার পরিমাণ বড্ড বেশি! ক্যাশুনাট, দারচিনি, মিছরি, লবঙ্গ আর ডিম দিয়ে তৈরি এখানকার বিখ্যাত খাবার ‘ওয়াত্তালাপাম’ খেতে মন্দ না লাগলেও মাংসের কারি মুখে দেওয়া মাত্র কানমাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এলাম উত্তাল ভারত মহাসাগরের তীরে। এই সকালবেলাতেই অনেকে ‘উইন্ড সার্ফিং’ করছে। কেউ কেউ পালতোলা নৌকোয় ভেসে পড়েছে জলে। জেলেরা দু’ধরনের নৌকো—‘প্যারুভাস’ আর ‘ওরুভাস’ এ চড়ে গভীর সমুদ্রে চলেছে মাছ ধরতে। অনেকে আবার সৈকত ঘেঁষে পোঁতা ত্রিভূজাকার বাঁশের উপর দাঁড়িয়ে ছিপ দিয়ে সার্টিন মাছ ধরছে। শুনলাম, তাদের বঁড়শিতে কোনও টোপ থাকে না। ক্যাডমিয়াম দিয়ে তৈরি বঁড়শি জলের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠলে মাছেরা আকৃষ্ট হয়ে কাছে এসে ধরা পড়ে! সেই মাছ বিক্রি হয় শহরের বাজারে। জলখাবারে শ্রীলঙ্কার আরেক বিখ্যাত খাবার ‘হপার’ নিয়ে বসলাম। ময়দা, ডিম আরর নাকেল দিয়ে তৈরি খাবারটি ভীষণ সুস্বাদু। খেতে হয় সস কিংবা মধু দিয়ে।

একটু বেলা করে রওনা হলাম মধ্য শ্রীলঙ্কার পাহাড়ি শহর ‘ক্যান্ডি’র পথে। রাস্তার পাশে ছোট ছোট জনপদ, নারকেল গাছ, ধানখেত। বিক্রি হচ্ছে ভাঁড়ে সাজানো দই আর মধু। আছে ‘কিং কোকনাট’ যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি মিষ্টি তার জল। বিকেলবেলা পৌঁছলাম ‘ক্যান্ডি’, ‘মাতালে’ আর ‘নুয়ারাএলিয়া’ নিয়ে সেন্ট্রাল প্রভিন্সের রাজধানী এককালের ‘সেনকাডাগালাপুরা’, একালের ‘ক্যান্ডি’তে। দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে ছবির মতো সুন্দর শহরটাকে দেখেই ভাল লেগে গেল। শহরে ঢোকার মুখে সুবিশাল এক বুদ্ধমূর্তি। আসলে শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ মানুষই তো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আর এখানেই তো আছে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ সেই বিখ্যাত ‘টুথরেলিক টেমুল’ বা ‘দালদ্দামালিগাওয়া।’ যেখানে গৌতম বুদ্ধের একটি দাঁত সংরক্ষিত আছে। শোনা যায়, কুশীনগরে মহাপ্রয়ানের পর গৌতমবুদ্ধের শেষ কৃত্যের সময় তাঁরা ওপরের পাটির বাঁদিকের একটি ছেদন দাঁত তুলে নেন আরাহাত ঘোমা নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুনী।

তারপর নানান হাত ঘুরে তা শ্রীলঙ্কায় পৌঁছায় মহারাজা কীর্তি শ্রীমেগাভেন্নার আমলে। তিনি অনুরাধাপুরায় একটি সুদৃশ্য বিহার নির্মাণ করে দাঁতটি প্রতিষ্ঠা করেন। ক্যান্ডিতে দাঁতটি নিয়ে আসেন কপিতিয়ে দিয়াওয়াদানা রালা ও দেবাঙ্গলা রত্নলংকারা থেরা ৩১৩ খ্রীষ্টাব্দে। বর্তমান মন্দিরটি রাজা বীরা নরেন্দ্র সিনহার তৈরি। দাঁতটিকে মনে করা হয় গৌতম বুদ্ধর জীবন্ত প্রতিনিধি।  এই মন্দিরে নিরাপত্তার ভীষণ কড়াকড়ি। এখানে শার্টপ্যন্ট, স্লিভলেস জামা ও মিনি স্কার্ট পরে ঢোকা মানা। দু’পাশে দু’টি প্রবেশদ্বার। মূল প্রবেশদ্বার ‘মহাওয়াহা লকাতা’ এক সময় এলটিটিই’র বোমা বিস্ফোরণে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে নতুন করে আবার গড়া হয়েছে। দু’পাশে পাথরের হাতি। জুতো, মোজা খুলে ঢুকলাম চত্বরে। বিশাল ময়দানের প্রান্তে প্যাগোডাশৈলীর মন্দির।

সাদা দেওয়াল, মাথায় লাল ছাদ। ভিতরে কাঠ ও হাতির দাঁতের কার্ভ করা সুন্দর কারুকর্য। দেওয়াল জুড়ে ভগবান বুদ্ধের জীবনীচিত্র। গোটা মন্দির জুড়েই ছোট ছোট কুলুঙ্গি। উৎসবের দিনে সেখানে মোমবাতি জ্বালানো হয়। দোতলা মন্দিরের নীচের তলার নাম ‘পাল্লেমালায়া’, উপরের তলার নাম ‘উদুমালায়া’ বা ‘হিতিনা ম্যালিগাওয়া’। এই উদুমালায়ার যে গৃহে দাঁতটি রাখা সেই ‘হানদুনকুনামা’র হাতির দাঁতের কারুকার্যময় দরজা এখন বন্ধ। দরজার দু’দিকে বড় বড় দু’টি হাতির দাঁত। ওই গৃহে রত্নসিংহাসনে মণিমুক্তো খদিত স্তুপাকৃতি গয়নার বাক্সে স্বণর্পদ্মের উপর পবিত্র সেই দাঁত রাখা আছে। প্রতিদিন তা সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় পুজো করা হয়।

বছরে একবার ওই দাঁত বার কার হয় শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ‘এসালাপেরাহেরা’ উৎসবে। জুলাইয়ের শেষ বা অগস্টের শুরুতে পূর্ণিমার দিন মণিরত্ন খদিত গয়নার বাক্সে দাঁতটি রেখে পাল্কিতে করে সুসজ্জিত হাতির পিঠে চাপিয়ে শোভাযাত্রা শুরু হয়। দু’পাশে থাকে দু’টো ছোট হাতি। তার পিছু পিছু আরও শ’খানেক সুসজ্জিত হাতি চলে সেই শোভাযাত্রায়। সঙ্গে নর্তক-নর্তকী, মিউজিশিয়ান, জাগলার, অ্যাক্রোব্যাট, মশালবহক, আগুনখোর ইত্যাদি। রাতের আকাশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাজির আলোয়। সে-এক দেখবার জিনিস! দিন দশেক চলে ওই উৎসব।

লক্ষাধিক মানুষ জড়ো হয় ‘এসালাপেরাহেরা’ উৎসবে। শেষ রাতে শোভাযাত্রা শহর থেকে আবার মন্দিরে পৌঁছায়। সামনে থাকেন প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি হাতে বৃদ্ধ লামারা। ‘এসালাপেরাহেরা’ উৎসবের পরেই নাকি দেশজুড়ে বৃষ্টি নামে—শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে শ্রীলঙ্কা—এমনই মানুষের বিশ্বাস। এই মন্দিরকে ইউনেস্কো ১৯৮৮ সালে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ বলে ঘোষণা করে। ‘হানদুনকুনামা’র সামনে এক লামা সাদা আর নীল পদ্ম হাতে দাঁড়িয়ে। তাঁর কাছ থেকে একটি নীল পদ্ম নিয়ে মনে মনে তথাগতকে উৎসর্গ করলাম। মূল মন্দিরের পিছনেই ঝাঁ চকচকে নতুন মন্দির। থাইল্যান্ড সরকার সেখানে বিভিন্ন মুদ্রায় বারোটি বুদ্ধমূর্তি দান করেছেন। মন্দিরের উত্তরে রাজা ‘তৃতীয় বিক্রমভানু’ ও ‘সেনাসাম্মাথা’ বিক্রমভানুর তৈরি রাজপ্রসাদ ‘মালিগাওয়া’। সেখানে এখন আর্কিওলজির মিউজ়িয়াম।

মন্দিরের পাশেই ক্যান্ডি লেক। গাছপালাঘেরা সুবিশাল এই সরোবরটি গড়েন সিংহলের শেষ রাজা ‘শ্রীবিক্রমা রাজাসিংহে’। জলে নৌবিহারের ব্যবস্থা আছে। দিন ফুরিয়ে এসেছে। আকাশের মেঘে রঙের আঁচড়। ক্যন্ডি লেকে রঙের হুল্লোড়। পাড়ের রাস্তা ধরে পৌঁছলাম কালচারাল প্রোগ্রাম হলে। সেখানে এই সময় প্রতিদিন লোকগীতি, লোকনৃত্য পরিবেশিত হয়। মানে না বুঝলেও ভিনদেশী নৃত্য দেখতে মন্দ লাগে না। শো-শেষে আগুনখেলা। লম্বা একটি পাত্রে আগুন জ্বালিয়ে তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, আগুন খাওয়া—আরও কত কী! অনেকটা আমাদের দেশের চড়ক উৎসবের মতো। সন্ধেবেলা এসে উঠলাম পাহাড়ের কোলে নদীর ধারে ‘ছায়াসিটাডেল’ হোটেলে। নদীর তীর লাগোয়া লনটি বড় সুন্দর। সেখানেই জমে উঠল সান্ধ্য আড্ডা।


সকালবেলা বেরিয়ে পড়েছি দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার সৈকতাবাস ‘বেনটোটা’র পথে। ক্যন্ডি থেকে ২০০ কিমি দূর। পথে স্পাইস গার্ডেনে খানিক থামা। শ্রীলঙ্কার মশলার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এলাচ, দারচিনি, হলুদ, লবঙ্গ ও অন্যান্য মশলাগাছের পাশাপাশি আয়ুর্বেদিক ওষুধি  গাছও চাষ হয়। স্পাইস গার্ডেনে গাইডের বদান্যতায় নানান মশলাপাতি গাছের সঙ্গে পরিচয় শেষে অদ্ভুত স্বাদের ‘হার্বাল টি’ খেতে মন্দ লাগল না। শ্রীলঙ্কা একদিকে যেমন মশলার জন্য বিখ্যাত, তেমনি আবার মণিরত্ন ও মুখোশের জন্যও বিখ্যাত। ক্যান্ডির ‘প্রেমদাসা জেনস মিউজিয়ামে’ ন্যায্যমূল্যে মণিরত্ন বিক্রি হয়। আর গোটা শ্রীলঙ্কাজুড়েই এয়ারপোর্ট থেকে দোকানবাজার সর্বত্রই মুখোশের রমরমা। কলম্বোর রাস্তা ছেড়ে বাস কালুতারার পথ ধরেছে, পথের ধারেই সাদা রঙের বিশাল এক গুম্ফা। সমুদ্রেও কিনার ঘেঁষে চলেছি। দু’পাশে নারকেল গাছের সারি। ভারত মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। জলের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ। শেষ দুপুরে পৌঁছলাম ‘বেনটোটা’।

এখানে বেনটোটা নদী মিশেছে ভারতমহাসাগরে। শ্রীলঙ্কার প্রথম পরিকল্পনা মাফিক ট্যুরিস্ট স্পট এখানেই গড়ে তোলা হয়। সমুদ্রের তীরে ‘বেনটোটা বিচ রিসর্টে’ ব্যাগপত্র রেখে এলাম সাগরতীরে। ভারত মহাসাগরের নীল ঢেউ লুটিয়ে পড়ছে সোনালি বালুকাবেলায়। সমুদ্রের তীরজুড়ে নারকেল গাছের সারি। উত্তাল হাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকাই দায়! বেলাভূমিটা এখানে একটা ধনুকাকার বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁকের একপ্রান্তে ঝাপসা কালুতরা যেন এক স্বপ্নরাজ্য! দিনের আলোয় ভাঁটার টান লেগেছে। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে ফিরছিল এক জেলে। তার কাছ থেকে জানলাম, এখানে বেনটোটা নদীর মোহনায় আছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সেখানে নাকি হামেশাই দেখা মেলে বিলুপ্তপ্রায় উভচর সরীসৃপ স্যালামান্ডারের। এছাড়া আছে নানান প্রজাতির পাখির আনাগোনা। পর্যটকদের জন্য আছে নৌবিহারের বন্দোবস্ত। শুনে ছুট লাগালাম বেনটোটা নদীর তীরে। ভেসে পড়লাম দাঁড়টানা নৌকোয়। সূর্য অস্ত গেছে খানিকক্ষণ আগে। ক্রমশ সন্ধের অন্ধকার নামছে চরাচর জুড়ে।

ছলাৎছল-ছলাৎছল দাঁড় বেয়ে ঢুকলাম বাইনের জমাট জঙ্গলে। ঝিমধরা অরণ্যে শুধু ঝিঁ ঝিঁর শব্দ। জলের উপর জেগে থাকা শ্বাসমূলগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে গায়ের উপর। বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়িয়ে থাকা বাইনের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে নৌকো আটকে যাচ্ছে শিকড়ে-বাকড়ে। যত ঢুকছি, অন্ধকার ততই ঘন হচ্ছে। ভয়, ভাললাগার রোমাঞ্চকতায় মন বিহ্বল। স্যালামান্ডার অবশ্য দেখতে পাইনি। দেখেছি অনেক পাখি-নিঝুম-সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে নীড়ে। ঘণ্টাখানেক বাদে বেরিয়ে এলাম খাঁড়ি থেকে। রাতে নৈশভোজ সেরে আবার সৈকতে। সাগারবেলায় আলো জ্বেলে সাপ খেলা দেখানো হচ্ছে। আজ শুক্রবার। প্রতি শুক্রবারই নাকি রাত দশটায় মাথাপিছু পাঁচ ডলারের বিনিময়ে সাপ খেলা দেখানো হয়। সাহেব-সুবোদের ভিড় জমেছে বেশ। আমাদের কাছে আর নতুন কি? তাই হাঁটা লাগালাম বেলাভূমি ধরে অন্ধকারের দিকে। রাতের ভারত মহাসাগর বড় বেসামাল, বেশ ভয়ঙ্কর। অন্ধকার আকাশের নীচে সে ফুঁসে চলেছে কোনও এক অজানা আক্রোশে!

সূর্যোদয়ের সময় আবার সে ভীষণ সুন্দর। নীল সাগরের উথাল-পাথাল ঢেউয়ের মাথায় মাথায় দিনের প্রথম আলোর চুম্বনে রঙের ঝরনাধরা। দস্যি-দামাল হাওয়ার মাতনে উড়িয়ে দেওয়ার নেশা। সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে বেশ বড় একটা পাথরের উপর মুগ্ধ নয়নে বসে থেকেছি অনেকক্ষণ। চা, জলখাবার খেয়ে আবার বাসে। চলেছি ৪০ কিমি দূর মধুনদীর মোহনায় জলবিহারে। জেটি থেকে স্পিডবোটে চড়ে ভেসে পড়লাম জলে। শ্রাবণমাস হলেও এখানে আসার পরের দিন থেকেই আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। ভয়ঙ্কর গরম মাথার উপর প্রখর রোদুর। দু’পাশে ম্যানগ্রোভ অরণ্য অনেকটা আমাদের সুন্দরবনের মতো। সুন্দরী, বাইনের পাশে নুইয়ে পড়া নারকেল গাছে বড় বড় ডাব ঝুলছে। নদীর তীরে ছোট ছোট বসতি, কুঁড়েঘর। আমসিংহলীদের প্রাত্যহিক জীবনের রোজনামচা।

জলের মাঝখানে ভাসমান দোকানে মিনারেল ওয়াটার, কিং কোকোনাট, কোল্ডড্রিংক্স বিকোচ্ছে। যত এগোচ্ছি নদী ততই চওড়া হচ্ছে। ছোট ছোট দ্বীপ দাঁড়িয়ে আছে জলে পা ডুবিয়ে। আজকে নৌকো ঢুকলো এক বাইনের জঙ্গলে। গত সন্ধ্যের মতো গা ছমছমে না হলেও বেশ রোমাঞ্চকর। পৌঁছলাম মোহনায়। মধু নদীর কালচে সবুজ জলে মিশেছে ভারত মহাসাগরের নীলে। অপরূপ এই সংগম। ভীষণ স্রোতে নৌকো টালমাটাল। তাই ইচ্ছে থাকলেও বেশিক্ষণ থাকা গেল না। ফিরে এলাম ঘাটে। এবার বাসে চেপে কচ্ছপ প্রজনন কেন্দে। এই কেন্দ্রে চার প্রজাতির কচ্ছপ প্রজনন ও সংরক্ষণ হয়। সমুদ্রের ধার থেকে কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করে আশপাশের গ্রামবাসী এখানে এনে জমা দেয়। কচ্ছপরা বাঁচে বহুকাল। তাই এক সময় সিংহলীরা মনে করত কচ্ছপের ডিম খেলে তাদের আয়ুও বাড়বে। তাই তারা যথেচ্ছভাবে কচ্ছপের ডিম খেতে শুরু করে। ফলে কচ্ছপের সংখ্যা কমে আসে শ্রীলঙ্কায়। তাছাড়া গবেষণায় প্রকাশ পায় যে ওই ডিমে আছে প্রচুর কোলেষ্টেরল। আয়ু বাড়ার বদলে কমার সম্ভাবনা প্রবল। সিংহলীদের স্বার্থে সরকারি উদ্যোগে নিষিদ্ধ হল কচ্ছপের ডিম খাওয়া। চৌবাচ্চার জলে সদ্যোজাত কচ্ছপরা সাঁতার কাটছে। পরিচয় হল নানা প্রজাতির কচ্ছপের সঙ্গে। দেখা পেলাম বিরল প্রজাতির কচ্ছপ অলিভ রিডলের।

বাইরে এসে দাঁড়ালাম নারকেল বনের ছায়ায়। সামনে চিরচঞ্চল ভারত মহাসাগরের নীল জল মিশেছে দিকচক্রবাল রেখায়। তীরে আদুর গায়ে স্থানীয় জেলে বসে উদাসীন। দোল লেগেছে নারকেল গাছের পাতায় পাতায় মাতাল হাওয়ার দুষ্টুমীতে। কারা যেন ছন্দোবদ্ধ পদচিহ্ন সাগরতটে? তবে কি কোনও গহন স্বপন সঞ্চারিণী এ পথে এসেছিল কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করে খানিক আগেই? তারই চরনচিহ্ন আঁকা রয়েছে সোনালি বালুকাবেলায়?

চেকলিস্ট

কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে কলম্বোর সরাসরি উড়ান না থাকায়, প্রথমে চেন্নাই চলে আসাই ভাল। সেখান থেকে বিমানে মাত্র ৫০ মিনিটে কলম্বো। টুর অপারেটারের সঙ্গে ঘোরা যেতেই পারে। কলম্বো-ক্যান্ডি বাস সার্ভিসও আছে। তবে বেনটোটা যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করে নেওয়াই ভাল।

কখন যাবেন

বছরের যে কোনও সময়েই যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন

ক্যান্ডিতে নানা দামের নানান মানের থাকার হোটেল আছে। তবে বেনটোটায় থাকার খরচ বেশি। আছে ‘বেনটোটা বিচ রিসর্ট’, ‘তাজ ভিভান্টা’র মতো রিসর্ট।

মনে রাখুন

শ্রীলঙ্কার স্যাফায়ার, রুবি, চা, মশলা আর মুখোশ বিখ্যাত। খাবারের মধ্যে ময়দা, ডিম আর নারকেল দিয়ে তৈরি ‘এগহপার’ খেতে ভুলবেন না। এছাড়া ‘ওয়াত্তালাপাম’, ‘কিরিবাথ উইথ প্রন্নমিরিস’ও চেখে দেখতে পারেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com