ম্যুরাল দুটির নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসনের অংশ থেকে। সেতু বিভাগ সূত্রের দাবি, তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশেই বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্সকে ম্যুরাল নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ওবায়দুল কাদের আত্মগোপনে রয়েছেন। বক্তব্য জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ হোসেন গত বুধবার বলেন, তিনি মাওয়া উদ্বোধনী কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে ৫২ কোটি টাকার চুক্তি ছিল। ম্যুরাল নির্মাণে আরো কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে বলে দাবি করেন তিনি।
আসিফ হোসেন আরো বলেন, চাপের মুখে ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছে। ৯ মাসের কাজ আড়াই মাসে শেষ করেছেন। বেশি ব্যয়ের বিষয়টি ঠিক নয়।
মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘বালিশ-কাণ্ড’ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলের ছাদধসের ঘটনায় আলোচিত। ২০১৯ সালে রূপপুর প্রকল্পে আবাসিক ভবনের জন্য ‘অস্বাভাবিক’ দামে বালিশ কেনার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তখন ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিলেন মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ হোসেন। ওই কাজের অন্যতম ঠিকাদার ছিল মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন। এতে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয় ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। একেকটি বালিশ ভবনে তোলার মজুরি দেখানো হয়েছিল ৭৬০ টাকা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ১০ তলাবিশিষ্ট শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান হলের একাংশ গত ৩০ জানুয়ারি ধসে পড়ে। এই কাজের ঠিকাদারও মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন।
এদিকে ম্যুরাল নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা সেতু বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ রজব আলী বলেন, যেখানে ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি ছিল নিচু। মাটি ভরাট ও পাইলিং করতে হয়েছে। এ জন্য ব্যয় বেশি। বিতর্কিত ঠিকাদার নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ দিতে গেলে কাজটি ছয় মাস পিছিয়ে যেত। উদ্বোধনের তাড়াহুড়ার মধ্যে ঠিকাদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য তাড়াহুড়ার নামে জনগণের টাকা অযৌক্তিকভাবে খরচের কোনো সুযোগ নেই। উন্মুক্ত দরপত্র করা হলে খরচ অনেক কম হওয়ার সুযোগ ছিল বলে মনে করেন অনেকে।
ম্যুরাল ও অন্যান্য স্থাপনার কাজ চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। মাটি ভরাট, নকশা, স্থাপনা নির্মাণ ও ম্যুরাল তৈরি। দেখা গেছে, নকশা ও ম্যুরাল নির্মাণ বাবদ প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তা মোট ব্যয়ের সামান্য অংশ। নকশাকারী পেয়েছেন ৯৫ লাখ টাকা। ম্যুরাল শিল্পী জানিয়েছেন, তিনি প্রতি বর্গফুটে পেয়েছেন দুই হাজার টাকা। হিসাব করে দেখা যায়, এতে ব্যয় দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
ম্যুরালসহ উদ্বোধনী কমপ্লেক্সের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজ তদারক করেন স্থপতি ফজলে করিম শিশির। তিনি বলেন, তাঁদের নকশায় নদীতীরে সৌন্দর্যবর্ধনসহ আরো অনেক কিছু ছিল। সময় স্বল্পতার জন্য কাজ কমানো হয়েছে। তিনি জানান, পদ্মা সেতুর দুই পারে উদ্বোধনী কমপ্লেক্সের জন্য ছয় লাখ বর্গফুট জায়গা পাকা করা হয়েছে।
জাজিরা প্রান্তে ম্যুরাল তৈরির কাজ করেছে নক্ষত্র নামের ভাস্কর্য ও মৃৎশিল্প খাতের একটি প্রতিষ্ঠান। শিল্পী আশরাফুল আলম ও মো. অহিদুজ্জামান সিরামিকের টুকরা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পুড়িয়ে রং টুকরা টুকরা করে ম্যুরাল তৈরি করেন। আশরাফুল আলম বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রতি বর্গফুটের জন্য তাঁরা দুই হাজার টাকা করে নিয়েছেন।
ম্যুরাল নির্মাণে ১১৭ কোটি টাকা ব্যয় কতটা যৌক্তিক, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল খ্যাতিমান শিল্পী ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের সহসভাপতি (জাতীয় বিষয়াদি) ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নাকীর কাছে। তাঁরা দুজনই ব্যয়ের পরিমাণকে অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন।
হামিদুজ্জামান খান বলেন, পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের দুটি ম্যুরাল তিনি দেখেছেন। তাঁর মতে, এ ধরনের কাজ কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে হলে ভালো।
অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী নাকী বলেন, একটি ভবনের নির্মাণশৈলী বা একটি শিল্পকর্ম ভালো হলে এবং সারা বিশ্বে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লে মূল্য অনেক বেশি হতে পারে। কিন্তু শিল্পকর্মটি তৈরি করার ব্যয় নির্দিষ্ট দরেই হওয়ার কথা। তিনি বলেন, ম্যুরাল বা শিল্পকর্ম তৈরিতে প্রতি বর্গফুটের একটা বাজারদর আছে। সেটা ঠিকাদার বা নির্মাণকারী ভেদে কিছুটা কমবেশি হতে পারে। এতটা অস্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ নেই।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিপুল ব্যয়
জাতীয়ভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকার মাওয়া ও জাজিরায় মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। মাদারীপুরে হয় সুধী সমাবেশ, যা রাজনৈতিক সমাবেশে রূপ নেয়। এর বাইরে প্রতিটি জেলায়ও বড় পর্দায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখানো ও আতশবাজি ফাটানোসহ নানা কর্মসূচি ছিল। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে এই উদ্যাপনের পুরো ব্যয় ৮৯ কোটি টাকা বহন করা হয়েছে। কেনাকাটা কিংবা অনুষ্ঠান আয়োজনে ঠিকাদার বা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নিয়োগ দেওয়া হয় উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভেন্যু (অনুষ্ঠানস্থল) তৈরি, সাজসজ্জা ও অনুষ্ঠানের পুরো কাজটি করেছে ইভেন্ট টাচ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। তাদের পেছনে ব্যয় হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বাড়তি আরও ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা দাবি করেছিল। তবে সে টাকা দেওয়া হয়নি।
বিগত সরকারের আমলে বড় বড় অনুষ্ঠানের অনেকগুলোই ইভেন্ট টাচের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে দেখা যায়। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা বঙ্গবন্ধু টানেলের একটি টিউবের কাজ শেষ হওয়ার পর যে অনুষ্ঠান হয়, সেটিও ইভেন্ট টাচ করেছিল। ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়কের নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিল ইভেন্ট টাচ। সব কটিই সেতু বিভাগের অধীন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীন পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও তারা করেছে।
ইভেন্ট টাচের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেজর (অব.) এস এম মইনুল হাসান বলেন, যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবেই ইভেন্ট টাচ কাজ পেয়েছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে তারা ১৫ কোটি টাকার কিছু বেশি পরিমাণ অর্থের কাজ করেছে। সারা দেশে আতশবাজিসহ বিভিন্ন খরচের বিল তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল।
পদ্মা সেতু প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উদ্বোধনের দিন প্রতিটি জেলায় উদ্যাপনের জন্য প্রকল্প থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। বেশির ভাগ জেলা ১০-১৫ লাখ টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি, প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল মাদারীপুরের জন্য। পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে ক্রোড়পত্র ও স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশসহ অন্যান্য খাতে কিছু ব্যয় হয়েছে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের আগে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। তখন সেতু উদ্বোধনে বিপুল ব্যয় না করে বন্যার্তদের সহায়তায় সরকারকে জোর দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। সমালোচনা হয়েছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যয় নিয়েও।
প্রশ্ন তোলা হবে না, ‘জানত সবাই’
পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে যখন পদ্মা সেতু প্রকল্প নেওয়া হয়, তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। গত জুনে পদ্মা সেতু প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। তখনো এক দফা সমাপনী অনুষ্ঠান হয়। তখন এতে ব্যয় হয় ৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে যেসব অনুষ্ঠান হতো, সেগুলোর খরচ নিয়ে কোনো নিরীক্ষা কিংবা প্রশ্ন তোলা হবে না—এটা সবাই জানত। এ সুযোগটাই নিয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, ঠিকাদার কিংবা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
তিনি বলেন, দুটি ম্যুরাল নির্মাণে ১১৭ কোটি টাকা খরচ করার বিষয়টি মনে হয় বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বের অনেক দেশ মিলিয়ে রেকর্ড হবে। এ ধরনের নানা খরচ যুক্ত হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে অবকাঠামোর নির্মাণ ব্যয় অনেক দেশের চেয়ে বেশি।
সূত্র : প্রথম আলো