এই প্রথমবারের মত খুব সকালে (দিনের আলো বিচ্ছুরিত হওয়ার পর) পৃথিবীর ক্রস রোডস নামে পরিচিত টাইমস স্কয়ারে শত কণ্ঠে বাংলা গান গেয়ে বাঙালিরা বরণ করলেন নতুন বছরকে। বাংলাদেশের বাঙালিরা যেমন দেশের অভ্যন্তরেই বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ, লালন, পালন এবং বিকশিত করে চলেছেন শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও, তেমনই নিউইয়র্কের বাঙালিরা নিজেদের ঐতিহ্যমন্ডিত সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক বলয়ে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াসে লিপ্ত। মাত্র কয়েক বছর আগে সকালে অর্থাৎ নতুন বছরের শুরুতে নিউইয়র্কে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে। আর প্যানডেমিকের কন্টকাকীর্ণ মৃত্যু-ভয়াল পথ পাড়ি দিয়ে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি এবং সাদা পাঞ্জাবি পরে এ বছর বসন্তের সকালে বাঙালি চেতনায় দৃপ্ত বাংলাদেশের ইমিগ্রান্টরা টাইমস স্কয়ারে সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়ে উঠল ‘এসো হে বৈশাখ’।
শুক্রবার কাজের দিন, হাজার হাজার মানুষ কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে, অসংখ্য পর্যটক হাঁটতে বেরিয়ে এই দৃশ্য দেখে নিশ্চয় বিস্মিত হয়েছেন। তারা ফোনে ছবি তুলেছেন। এনআরবি ইন্টারন্যাশনালের এই আয়োজনে সম্মুখভাগে ছিলেন বাংলাদেশের তিন দিকপাল- বাংলা লোকসংগীতের প্রবীণ শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, বাংলাদেশের নাচের প্রবীণ শিল্পী এবং প্রশিক্ষক লায়লা হাসান এবং এ সময়ের রবীন্দ্রসংগীতের সেরা শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। তারা গান গেয়েছেন এবং নেচেছেন। মহীতোষ তালুকদারের অনির্ব্যচনীয় পরিচালনায় এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল এই কংক্রিটের নাগরিক প্রকৃতিতে ভাস্বর। একবারও মনে হয়নি টাইমস স্কয়ারে পরিবেশিত বাংলার শাশ্বত গানগুলো বেমানান। বাংলার লোকসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত চিরায়ত আবেদনসম্পন্ন গান। টাইমস স্কয়ারে তা আবারো প্রমাণিত হলো। পরের দিন শনিবার জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় আবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমে ওঠে বর্ষবরণের উৎসব। নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক এডামস সশরীরে এসে যোগ দেন। তাকে উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয়, উত্তরীয় স্কন্ধে রেখেই বক্তব্য রাখেন। সহ¯্রাধিক মানুষ এই মেলায় একদিনের জন্য উজাড় করে দেন বাংলা নববর্ষকে।
এই বর্ষবরণের চারদিন পরেই বৃহস্পতিবার ছিল এ বছরের রমজানের শেষ দিন। দুপুর থেকেই জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, ওজোন পার্ক, চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড এবং পার্কচেস্টারের বাংলাবাজার ওয়ের সাইডওয়াক ভরে ওঠে চাঁদরাতের মেলায়। একদিকে মেহেদী আঁকা, অন্যদিকে বেচাকেনা সেই সাথে গানবাজনা, আতশবাজি জ্যাকসন হাইটসকে করে তোলে উৎসবমুখর। মানুষের ¯্রােতে থমকে যায় এলাকা। ঈদের আগের রাতের এই উৎসব নিউইয়র্ক টাইমসের মত বিশ্ববিখ্যাত সংবাদপত্র তাদের রিপোর্টারকে এসাইনমেন্ট দেয় কভার করার জন্য। ঈদের দিন, শুক্রবার নামাজ পড়েই নিউইয়র্কের বাঙালিরা সেরা উপহার পান নিউইয়র্ক টাইমসের চাঁদরাতের সচিত্র প্রতিবেদনটি।
বাঙালি বংশোদ্ভুত আমেরিকান (নিউইয়র্ক টাইমসের) সংবাদকর্মী সাদিবা হাসান এই প্রতিবেদনটি লেখেন। তিনি অবশ্য এই উৎসবকে দক্ষিণ-এশীয় উৎসব বলেছেন। কারণ প্রথমত জ্যাকসন হাইটসে সবচেয়ে সরব বাংলাদেশী ইমিগ্রান্টরা হলেও অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ীও রয়েছেন। সেই সাথে এই এলাকায় ব্যবসা করেন পাকিস্তানি, নেপালি, তিব্বতিরা। তবে চাঁদরাতের এই উৎসব মূলত বাংলাদেশীদের। বাংলাদেশী ইমিগ্রান্টরা এই এলাকায় শুধু যে জমজমাট ব্যবসা করেন তা নয়, প্রায় প্রতিদিনই এই এলাকায় আয়োজিত হয় নানাবিধ কর্মসূচী। যে কারণে জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশী ইমিগ্রান্টদের সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্র (নানা কারণে, বাজার-সওদা, রেস্টুরেন্টে খেতে আসা, সাইডওয়াকে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়া, বন্ধু পরিজনদের দেখাতে নিয়ে আসা, এবং অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বা দর্শক হিসাবে আসা) হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালিরা আছেন তারা জানেন জ্যাকসন হাইটসের নাম। তারা নিউইয়র্কে এসে জ্যাকসন হাইটসে আসবেন না তা হতেই পারে না।
সাদিবা হাসান এই বিষয়গুলো জানেন বলেই নিউইয়র্ক টাইমস এত গুরুত্ব দিয়ে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদক অনেকের সাথে কথা বলেছেন, বলেছেন ৭৩ স্ট্রিটের নতুন নাম বাংলাদেশ স্ট্রিট করার কথা, বাংলাদেশ স্ট্রিটের সাইনের একটি ছবিও ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম সাউথ এশিয়ান মুসলিমস হেরাল্ড ঈদ আল- ফিতর উইথ আ নাইট অব কম্যুনাল রিভালরি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে জ্যাকসন হাইটসে প্রায় ১৮০,০০০ মানুষের বাস, তারা ১৬৭টি ভাষায় কথা বলে, এটা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ডাইভার্স নেবারহুড এবং দক্ষিণ এশীয়দের উজ্জ্বল গন্তব্য।
অতএব নিউইয়র্কের মত এমন কসমোপলিটন সিটিতে দেড় শতাধিক দেশের ইমিগ্রান্টদের মাঝে বাংলাদেশীরা যে অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত তা নিউইয়র্ক টাইমসের মত কুলীন পত্রিকার নজর কাড়া দেখেই বোঝা যায়। বোঝা যায় বাংলাদেশীরা এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নিল পদচ্ছাপ রেখে। তাদের উপস্থিতি এখন আর গৌণ কোনো বিষয় নয়।