বান্দরবন জেলার থানচি উপজেলার একটি মারমা অধ্যুসিত এলাকা। মারমা ভাষায় খুম শব্দের অর্থ হচ্ছে ঝর্না বা জলপ্রপাত বা জলপতন। পাথুরে পথ বেয়ে নামতে নামতে দারুণ এক প্রাকৃতিক জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে রেমাক্রি খালের পানি। এই পানিতে নাফা নামক এক ধরণের মাছ পাওয়া যায়। সম্ভবত: এর থেকেই এই ঝর্ণার নাম নাফাখুম হয়েছে।
কর্মব্যস্ত জীবন থেকে প্রকৃতির মাঝে কিছু সময় কাটাতে ভ্রমনে যেতে পারেন নাফাখুম। এতে মন ভাল হওয়ার পাশাপাশি এক অন্যরকম প্রশান্তি পাওয়া যাবে। যা আপনাকে আবার নতুন উদ্যমে কাজ করতে সাহায্য করবে।
দেশের যে কোন জায়গা থেকে বাসে করে যেতে হবে বান্দরবন। নাফাখুম যেতে সম্ভাব্য ট্র্যাক হবে, বান্দরবন, থানচি, তিন্দু, রেমাক্রি ও সবশেষে নাফাখুম।
বান্দরবন থেকে থানচি
সাঙ্গু নদীরে তীরে অবস্থিত থানচি বান্দরবানের সর্বদক্ষিণের উপজেলা। বান্দরবান শহর থেকে এর দূরত্ব ৮২ কিঃমিঃ। রিজার্ভ চাঁদের গাড়ীতে বান্দরবান থেকে থানচি যেতে সময় লাগবে প্রায় ৪ ঘন্টা, পর্যটন মৌসুমে ভাড়া নেবে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। কম খরচে বাসেও যাওয়া যায়, তবে সময় লাগবে প্রায় ৫ ঘণ্টা, ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১৯০ টাকা। পাবলিক বাস বলিপাড়ায় কিছুক্ষন যাত্রা বিরতি দিয়ে থেকে। বান্দরবন থেকে সকাল ৮টা, ১০.৩০টা, ১২.৩০ এবং ২.৩০ এবং থানচি থেকে সকাল ৮টা, ১০টা, ১২টা, ২টায় বাস ছাড়ে।
থানচি হতে রেমাক্রী
এখানে থেকে নৌপথে আপনাকে পৌছতে হবে রেমাক্রী। থানচি ঘাটে নৌকাচালক সমিতি হতে নৌকা ভাড়া নিতে হবে এবং সাথে অবশ্যই নিতে হবে গাইড সমিতির তালিকাভুক্ত একজন গাইড। গাইড সমিতির সেবা মূল্য ১০০ টাকা এবং থানচি হতে রেমাক্রী পর্যন্ত গাইডকে দিতে হবে ৫০০ টাকা প্রতিদিন।
থানচিতে বিজিবি চেক পোস্ট রয়েছে, অত্র পাহাড়ি অঞ্চলে ভ্রমনের আগে এখানে আপনাকে অনুমতি নিতে হবে। সাদা কাগজে সব টুরিষ্টদের নাম, ঠিকানা, পিতার নাম, ফোন নাম্বার, মাঝির নাম, গাইডের নাম ও জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি ইত্যাদি জমা দিয়ে নাফাখুম যাবার অনুমতি নিতে হবে।
বর্ষায় ইঞ্জিনবোটে থানচি থেকে তিন্দু যেতে সময় লাগবে আড়াই ঘন্টা। তিন্দু থেকে রেমাক্রি যেতে লাগবে আরও আড়াই ঘন্টা। এই পাঁচ ঘন্টার নৌ-পথে আপনি উজান ঠেলে উপরের দিকে উঠতে থাকবেন। বর্ষা মৌসুমে তিন দিনের জন্য ইঞ্জিনবোটের ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা।
শীতের সময় নদীতে যথেষ্ট গভীরতা না থাকায়, তখন ঠ্যালা নৌকাই একমাত্র বাহন। ঠ্যালা-নৌকার ভাড়া পড়বে প্রতি দিনের জন্য ১০০০ টাকা।
থানচি থেকে বড় সাইজের পলিথিন (পিস ২০-২৫ টাকা) এবং রশি কিনে নেবেন। পলিথিনে আপনাদের ব্যাগগুলা ঢেকে নিবেন যাতে পানি না লাগে। আর রশি লাগবে নাফাখুম যাবার সময়। লাইফ জ্যাকেট নিতে পারেন ৫০ টাকা/দিন।
এখানে প্রকৃতি অভাবনীয় সুন্দর আর নির্মল। নদীর দুপাশে পাথুরে পাহাড়। কোন কোন পাহাড় এতই উচু যে তার চূড়া মেঘে ঢেকে আছে। সবুজে ঘেরা এই পার্বত্য অঞ্চলে মাঝে মাঝে দেখতে পাবেন দু একটি উপজাতি বাড়িঘর।
কখনো নদীগুলোর গভীরতা এতই কম যে পানির নিচে পাথর দেখা যায়। কোথাও বা নদীর মাঝেই উচু হয়ে আছে বিশাল বিশাল পাথর। যেখানে নদী ঢালু হয়ে গেছে সেখানে প্রচন্ড স্রোত। গমগম করে নেমে যাচ্ছে পানির ঢল।
তিন্দুতে একটি বিজিবি ক্যাম্প আছে। নাফাখুম যাবার পথে থানচি না থেকে তিন্দুতে এসে রাত্রিযাপন করতে পারেন। এখানে থাকার জন্য কিছু ঘর ভাড়া পাওয়া যায়।
তিন্দু হতে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই বড় পাথর। এখানেও শীত মৌসুমে নেমে হেটে যেতে হয়। এখানে বিশাল আকারের পাথর সহ ছোট বড় অনেক পাথর নদীর মাঝে পড়ে আছে। ধারনা করা হয় বহু বছর আগে ভুমিকম্পের কারনে পাথুরে পাহাড় হতে এই বিশাল আকারের পাথরের টুকরো গুলো নদীর মাঝ খানে এসে পড়েছে, আর নদের আয়তন কমে এখানে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে।
রেমাক্রী বাজারের পৌছার কিছুটা আগে ছোট একটা জলপ্রপাত আছে, নাম রেমাক্রীখুম। প্রায় ৪/৫ ফুট উচু হতে ধাপে ধাপে পানি সাঙ্গু নদীতে পরছে। দুচোখ জুড়িয়ে যাবার মত দৃশ্য। আসলে কষ্টকর এই নদী ভ্রমনটা না থাকলে নাফাখুম দর্শনটা একেবারেই সাধামাটা হয়ে যেত।
রেমাক্রী বাজারটা খুবই ছোট। বাজারের মাঝখানে বিশাল একটা উঠান আর চারদিকে দোকান। পেছনে থাকার ব্যবস্থা আর সামনে দোকান। আর তার পাশেই আছে একটি বিজিবি ক্যাম্প। রাতে রেমাক্রীতে বাজারে থাকতে পারেন। রেমাক্রি চেয়ারম্যানের একটা রেস্ট হাউজ আছে; এক রুমের ভাড়া ৫০০ টাকা; ১০-১২ জন থাকা যায়। তাছাড়া মারমাদের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই খুব অল্প টাকায় থাকা-খাওয়ার সুবিধা রয়েছে। তিনবেলা খাওয়ার খরচ পরবে জনপ্রতি ২০০ টাকা; এক্ষেত্রে থাকার জন্যে কোন খরচ দিতে হবে না।
রেমাক্রী হতে নাফাখুম
রেমাক্রী হতে নাফাখুম পর্যন্ত আর কোন বাহন আপনি পাবেন না। ওই পথটা আপনাকে হেটে যেতে হবে। এখানে পূর্বের গাইডকে রেখে আবার নতুন গাইড নিতে হবে। পূর্বের গাইড ও নৌকা্র মাঝি আপনার জন্য রেমাক্রিতে অপেক্ষা করবে। নাফাখুমে রওনা হওয়ার পূর্বে আবারও আপনাকে নাম ঠিকানা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্প হতে অনুমতি নিতে হবে।
রেমাক্রী বাজার হতে নদীর কুল ঘেষে প্রায় ২/৩ ঘন্টা হেটে পৌছবেন নাফাখুম। নদীর তীরটা পাথুরে এবং বালুকাময়; এখানে জনবসতি একেবারেই কম, মাঝে মাঝে দু একজন উপজাতীদেরকে মাছ ধরতে দেখা যায়। এই পথে বেশ কয়েক বার বুক সমান গভীর নদী পার হতে হয়।
দীর্ঘ পথ পারী দিয়ে নাফাখুম পৌছবেন, ক্লান্ত পা ঝর্ণার পানিতে ভেজানোর সাথে সাথে সব ক্লান্তি দুর হয়ে যাবে নিমিষেই। আর অসাধারন সব দৃশ্যাবলী দেখে মনে হবে আপনি হলিউডের কোন সিনেমার দৃশ্যে ঢোকে পড়েছেন।
৬ জনের একটা গ্রুপ বান্দরবন থেকে নাফাখুম ঘুরে আসতে প্রায় ১৫,০০০ টাকা খরচ হয়ে থাকে, অর্থাৎ জনপ্রতি প্রায় ২,৫০০ টাকা। এর সাথে যুক্ত হবে আপনার ভ্রমণের স্থান থেকে বান্দর পর্যন্ত যাতায়াতের খরচ।
মশা প্রতিরোধক ক্রীম, কয়েক জোড়া মোজা, প্যারাসিটেমল জাতিয় ঔষধ, এন্টিসেপ্টিক ক্রীম, খাবার স্যালাইন, কলম, জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি, ম্যাচ, শুকনো খাবার ও পানি। এছাড়াও, ইলেকট্রনিক গেজেট রিচার্জার সঙ্গে নিতে ভুলবেন না।
পার্বত্য অঞ্চলের সব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই। থানচি পর্যন্ত টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাবেন। তিন্দুতে বাঁশের এ্যন্টেনা লাগানো সেট থেকে হয়ত যোগাযোগ করতে পারবেন। কিন্তু রেমাক্রি পৌঁছালে আপনি একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।