রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:৫৬ অপরাহ্ন

নতুন করে আলোচনায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামানের বিপুল সম্পদ

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৪

ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা দুটি কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারও। এর মধ্যে মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড নামে একটি পরিবহন কোম্পানিতে তার ১০০ টাকা মূল্যের চার হাজার শেয়ার আছে বলে জানা গেছে।

আছাদুজ্জামান ডিএমপি কমিশনার থাকাকালীন রাজধানীর রুট পারমিট কমিটির প্রধানও ছিলেন। সেসময় তিনি মৌমিতা পরিবহনকে রুট পারমিট দেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন কোম্পানিকে অর্থের বিনিময়ে রুট পারমিট দেন।

এছাড়া শেপিয়ার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামের আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান আফরোজা জামান। অথচ তিনি একজন আগাগোড়া গৃহবধূ, যার কোনো নিজস্ব পেশা ছিল না। এই কোম্পানির পরিচালক আছাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত।

আফরোজা জামানের সৎ ভাই অর্থাৎ আছাদুজ্জামানের শ্যালক হারিসুর রহমান সোহান তার ভিজিটিং কার্ডে নিজেকে মৌমিতা পরিবহন লিমিটেড, গুলশান চাকা লিমিটেড, গোমতী পরিবহন লিমিটেড নামে তিনটি কোম্পানির চেয়ারম্যান উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তিনি নিজেকে পিওর গোল্ড লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়েছেন। শ্যালকের এসব ব্যবসায় আছাদুজ্জামানই বিনিয়োগকারী।

তিন ছেলে-মেয়ের নামে বিপুল সম্পদ

আছাদুজ্জামানের একমাত্র মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা। বয়স মাত্র ৩১। তার নামেও প্লট-ফ্ল্যাটের ছড়াছড়ি। এর মধ্যে তার নামে রয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুরের রামচাঁদপুর মৌজায় ৫ কাঠা জমি, সিদ্ধেশ্বরীতে ফ্ল্যাট, পূর্বাচলের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি সড়কে ৩ নম্বর প্লটে ১০ কাঠা জমি।

প্রাপ্ত নথিতে দেখা গেছে, আয়েশা সিদ্দিকা ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ কোটি কালোটাকা সাদা করেছেন। অথচ তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর এবং তখন তিনি ছিলেন শিক্ষার্থী।

বড় ছেলে আসিফ শাহাদাতের নামে ১ দশমিক ৬৫ একর জমি রয়েছে। পূর্বাচল নিউটাউনে ৬ নম্বর প্লটে সাড়ে ৭ কাঠা জমি, আফতাবনগরে ৫ কাঠা ও রূপগঞ্জে ৪ কাঠা ৬ ছটাক জমি রয়েছে। এছাড়া তার জমি রয়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গাতে।

আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীন পড়াশোনা করেন যুক্তরাষ্ট্রে। শিক্ষার্থী হলেও নিকুঞ্জ আবাসিকের ৮/এ রোডের ৬ নম্বর বাড়িটির মালিক তিনি। ছোট ছেলের নামে আমেরিকায় বিপুল সম্পত্তি গড়েছেন আছাদুজ্জামান।

শ্যালক-শ্যালিকা-ভাগনেও সম্পদশালী

আছাদুজ্জামানের এক শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলন। তার নামে গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমি রয়েছে। অথচ, আজীবন গ্রামে থাকা মিলনের নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। তবুও বেকার মিলন কয়েক কোটি টাকা দামের জমির মালিক।

ভাগনে কলমের নামেও গাজীপুরে জমি আছে দেড় একর। কলমও গ্রামের বাসিন্দা। তবুও তিনি বনে গেছেন কয়েক কোটি টাকা দামের জমির মালিক। এই কলম আবার আছাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক।

আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজার সৎ ভাই হারিসুর রহমান সোহানের ৬টি জাহাজ রয়েছে। এছাড়া পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে তার কয়েকশ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। পিওর গোল্ড লিমিটেড নামে স্বর্ণের দোকানও আছে তার।

একাধিক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে বিনিয়োগও আছে সোহানের। মৌমিতা পরিবহন, মধুমতি পরিবহন, গুলশান চাকাসহ বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে সোহানের বিনিয়োগে মূলত আছাদুজ্জামানই অর্থদাতা।

সোহানের নামে রাজধানীর অভিজাত বেইলি রোড, শাহজাহানপুরে ফ্ল্যাট রয়েছে। বনশ্রী ও আফতাবনগরে একাধিক প্লট রয়েছে। এর মধ্যে বনশ্রীর একটি প্লটে বাড়ির নির্মাণকাজও চলছে।

এছাড়া, চলতি বছরের ১৫ মে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌরসভায় তারা মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীর ছেলের কাছ থেকে ৩০ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে সোহানের নামে। ৩ কোটি টাকা দিয়ে ওই জমি মূলত আছাদুজ্জামানই কিনেছেন শ্যালক সোহানের নামে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আছাদুজ্জামানের বাবার সুনির্দষ্ট কোনো পেশা ছিল না। গ্রামে সামান্য কিছু জমিজমা ছিল। সেসব দিয়ে তাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো। অর্থাৎ, বিপুল পরিমাণ জমিজমার মালিক বা অর্থ-বিত্তশালী অবস্থা তাদের ছিল না।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার জহুরুল হক গত জুনের শেষ দিকে বলেছিলেন, ‘আছাদুজ্জামান মিয়ার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেলে দুদক ব্যবস্থা নেবে।’ তবে দেড় মাস পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী আছাদুজ্জামানের অবৈধ সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করতে দুদককে নোটিশও দিয়েছেন। এরপরও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের অবৈধ সম্পদের উৎস অনুসন্ধান শুরু করেনি। কেন করেনি সেই কারণও খুব একটা স্পষ্ট নয়।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, আস্থা নিয়ে পুলিশের উচ্চ পদে আসীন কর্মকর্তাদের এমন কর্মকাণ্ডে বাহিনীটিতে শুদ্ধি অভিযান জরুরি হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ—টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক আশীর্বাদ ছাড়া এ ধরনের দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব নয়। একদিকে প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ অবস্থান অপরদিকে রাজনৈতিক আশীর্বাদ একত্রিত হয়ে তাদের দুর্নীতি এবং অসামঞ্জস্য আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা আইনের সুরক্ষার পরিবর্তে ভক্ষক হয়ে গেছেন। তারা অপরাধ নিয়ন্ত্রক। তার মানে তারা জানেন কোন অপরাধ কীভাবে করতে হয়। এটা জেনে বুঝেই করেছেন।

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, এই ধরনের কর্মকর্তারা যে অপরাধগুলো করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু এক ধরনের সহযোগী আছে। তাদের অনেকেই হয়তো জেনে বা না জেনে অংশীদার হয়েছেন। এ অবস্থায় সব অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া অন্য কোনো ম্যাজিক বুলেট নেই।

আছাদুজ্জামান মিয়ার নানা রকম কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে জোর চর্চা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কেবল দুর্নীতি আর সম্পদ গড়েই ক্ষান্ত হননি আছাদুজ্জামান মিয়া। শেখ হাসিনা সরকারের চাটুকারিতা করে বাগিয়েছিলেন ডিএমপি কমিশনারের পদ।

পুলিশের চাকরির মেয়াদ শেষ হলে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে আছাদুজ্জামানকে নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তাকে নিয়োগের তিন বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।

বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য ও নারী কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস হওয়ার আগেই পালিয়েছেন সুচতুর ধুরন্ধর এই ঘুষ-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহাদিনের নিকুঞ্জের বাড়িতে ভাঙচুর-হামলা চালায়। এছাড়াও ফরিদপুরে আছাদের দখল থেকে বিপুল জমি উদ্ধার করেছে প্রকৃত মালিক এক বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com