পশ্চিমের আকাশে সূর্য যখন হেলে পড়ে, তখন লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে পদ্মার বুকজুড়ে। সোনালি কিরণে চিকচিক করে ঢেউখেলা জল। এরপর ধীরে ধীরে দিগন্তে মিশে যায় লাল সূর্য। মোহনীয় এমন দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসছেন শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পদ্মা নদীর তীর রক্ষা বাঁধে। বাঁধের পরিবেশকে নান্দনিক করতে তৈরি করা হয়েছে হাঁটার পথ, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘জয় বাংলা অ্যাভিনিউ’।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পদ্মা নদী শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে, যা চাঁদপুরে গিয়ে মেঘনায় মিশেছে। প্রতিদিন শেষ বিকেলে সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করতে হাজারো মানুষ নড়িয়ার পদ্মাপাড়ে জড়ো হন।
সূর্যাস্তের ওই দৃশ্য কেউ কেউ ভিডিও ধারণ করছেন, কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ডিঙি নিয়ে নদীতে নামছেন। পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব নিয়ে পদ্মার পাড়ে মানুষ আনন্দময় সময় কাটাতে আসছেন। প্রতিদিন কয়েক হাজার লোকের সমাগম হওয়ায় ওই স্থান ঘিরে উদ্যোক্তারা নানা ধরনের ব্যবসা করছেন। সেখানে ছয়টি রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে। নদীর তীর রক্ষা বাঁধের পাশে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করছেন অনেকে।
শরীয়তপুরের ডামুড্যার দারুল আমান থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গত শনিবার নড়িয়ার পদ্মাপাড়ে এসেছিলেন বেলায়েত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকমুখে শুনেছিলাম, নড়িয়ার পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। সে জন্য পরিবার নিয়ে এসেছি। অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি। বাড়ির কাছে এমন মনোরম পরিবেশে সময় কাটাতে পেরে সন্তানরাও খুশি।’
নড়িয়ার ভাঙন ঠেকাতে ২০১৯ সাল থেকে ‘নড়িয়া-জাজিরা পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা বাঁধ এবং ১১ কিলোমিটার নদীর চর খননের কাজ চলছে।
মাদারীপুরের কালকিনির লক্ষ্মীপুর এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জে পদ্মার তীরে ঘুরতে এসেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যস্ততার কারণে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তেমন কোথাও যাওয়া হয় না। আমাদের এলাকার খুব কাছাকাছি পদ্মার তীরে এমন একটি পরিবেশ পাব, ভাবতেও পারিনি। প্রাকৃতিক পরিবেশের এমন দৃশ্য দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। নদীর তীরে সূর্যাস্তের মুহূর্তটি এত অসাধারণ হতে পারে, তা না এলে বোঝা যাবে না।’
নড়িয়া উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নড়িয়ার পদ্মার তীরবর্তী তিনটি ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভার কিছু এলাকায় প্রবল নদীভাঙন ছিল। ওই সময়ে ভাঙনে অন্তত ২০ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়; ৩টি বাজারের অন্তত ৫ শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পদ্মায় বিলীন হয়। সরকারি-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। নড়িয়ার ভাঙন ঠেকাতে ২০১৯ সাল থেকে ‘নড়িয়া-জাজিরা পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা বাঁধ এবং ১১ কিলোমিটার নদীর চর খননের কাজ চলছে।
নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ বাজার থেকে সুরেশ্বর লঞ্চঘাট পর্যন্ত চার কিলোমিটার এই ওয়াকওয়ের নামকরণ করা হয়েছে ‘জয় বাংলা অ্যাভিনিউ’। ওয়াকওয়ের পাশ দিয়ে ঝাউগাছসহ বিভিন্ন গাছ লাগানো হয়েছে। দর্শনার্থীদের বসার জন্য বিভিন্ন স্থানে বেঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। নদীতে নামার জন্য প্রতি ৩০০ মিটার পরপর সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, নড়িয়ায় পদ্মা নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ও দৃষ্টিনন্দন জয়বাংলা অ্যাভিনিউ দেখতে মানুষ আসছেন। তাঁরা সূর্যাস্ত দেখার জন্য সন্ধ্যার আগে থেকেই সেখানে ভিড় করেন। অনেকে রাতের জ্যোৎস্না দেখার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত পদ্মার তীরে জয় বাংলা অ্যাভিনিউতে থাকছেন। উপজেলা প্রশাসন আগত দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ওই এলাকায় সার্বক্ষণিক পুলিশ টহল দিচ্ছে।