নতুন যুগের সূচনার অপেক্ষায় এখন পর্যটন নগরী কক্সবাজার। শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজীপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের প্রথম আইকনিক রেল স্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটির আয়তন ১ লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। নান্দনিক ডিজাইন আর নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি এর বহুমাত্রিক পরিধি নিয়ে গড়ে ওঠা এই স্টেশনই হতে পারে পর্যটকদের বিনোদনের নতুন গন্তব্য। আক্ষরিক অর্থে ঝিনুক না হলেও সমুদ্রদর্শনে এসে প্রথম দর্শনেই যেন সামুদ্রিক একটা আবহ পাওয়া যায় গোটা স্টেশনে। এখানে থাকবে মার্কেট, লকার, ফুড কর্নার, তারকা মানের হোটেল, মসজিদ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথসহ ১৭টি বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
সরেজমিন পরিদর্শন ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আইকনিক এ স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেল স্টেশন ভবনটি আজ দৃশ্যমান। এখন গ্লাস ফিটিংস, ছাদের স্টিল ক্যানোফিসহ নানা ধরনের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। এ স্টেশন হবে এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয় তলাবিশিষ্ট স্টেশন। এটি দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারবে।
রেল স্টেশনের পাশাপাশি রেলপথ নির্মাণের কাজও চলছে পুরোদমে। আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেনের প্রথম ট্রায়াল রান হওয়ার কথা রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ডিসেম্বরে দেশের প্রথম আইকনিক রেল স্টেশন ও ট্রেন চলাচল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পে আমূল পরিবর্তন ও দেশের অর্থনীতির গতি বাড়বে বহু গুণ। হবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।
সড়কপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসতে যেখানে সময় লাগে প্রায় সাড়ে ১১ ঘণ্টা, ট্রেনে আসতে সেখানে লাগবে মাত্র সাড়ে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। কমে আসবে পরিবহন ব্যয়ও। ঢাকা থেকে এসি বাসে যেখানে গড়ে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ হয়, সেখানে ট্রেনের এসি চেয়ারে বসে কক্সবাজার আসতে লাগবে মাত্র ১ হাজার টাকার কিছু বেশি। সড়কপথের দীর্ঘযাত্রার ভোগান্তি ছাড়াই পর্যটনপিয়াসীরা সহজেই ছুঁয়ে দেখতে পারবে সমুদ্রের জল। সুবিশাল চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলা থেকে নামতে হবে ট্রেনের প্ল্যাটফরমে। আর আসার যাত্রীরা বের হবেন নিচ থেকে। স্টেশনের ভেতরেই থাকবে কেনাকাটার ব্যবস্থা। থাকবে হলরুম। আবার চাইলেই নির্দিষ্ট লকারে ব্যাগ রেখে পর্যটকরা ঘুরে আসতে পারবেন পুরো শহর। এছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা। স্টেশনের নিচতলায় থাকছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, লকারসহ নানা সুবিধা। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল ও রেস্তোঁরা। তিন তলায় থাকবে তারকা মানের হোটেল।
দিনের বেলা বাড়তি আলো ব্যবহার করতে হবে না এই রেল স্টেশনে। ওপরের ছাদ খোলা থাকায় থাকবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। এর আধুনিক নির্মাণশৈলীর কারণেই কক্সবাজার রেল স্টেশনকে বলা হচ্ছে গ্রিন স্টেশন। ঝিনুক ও শামুকের গঠনটা বাইরে থাকে, আর বাকি শরীরের অংশটুকু ভেতরে আবৃত থাকে। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে পুরো রেল স্টেশনটাকে একটা ছাউনি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। রেল স্টেশন শুধু যাত্রী যাওয়া-আসার জন্য নয়। এখানে আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে টেকসই করার জন্য নানা ধরনের ব্যবহারকে সংমিশ্রণ করা হয়েছে।
পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধা, রেস্টুরেন্ট, ফুডকোর্ট, মালটিপারপাস হল, হোটেল থাকবে। সুতরাং এটি শুধু রেল স্টেশন নয়; এটি একটি ডেস্টিনেশন। এটি একটি আকর্ষণীয় আর্থসামাজিক মডেল। এখন চারদিকে গ্লাস লাগানো হচ্ছে। এখানে কোনো কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া ছাউনিটা পুরো কাঠামোটাকে ঢেকে রেখেছে। ফলে সব সময় ভবনটি সহনীয় তাপমাত্রায় থাকবে। এতে কুলিং লোড কম হবে। ফলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের লোডও কম হবে। এতে এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।