শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৭ পূর্বাহ্ন

তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অন্তরালে অন্য কিছু নয়ত! বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে মার্কিন কোম্পানি

  • আপডেট সময় শনিবার, ১৩ মে, ২০২৩

একদিকে ঢাকায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের বিরূপ আচরণ, অপরদিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বাংলাদেশ নিয়ে অনেক নমনীয় মনোভাব যখন কোটি কোটি বাংলাদেশীকে দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তখনই খবরটি এলো আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় ফুয়েল কোম্পানি এক্সনমোবিল বাংলাদেশে যেতে চাচ্ছে বঙ্গোপসাগরসহ গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করার জন্য। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে সেই অর্থে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কোনো বিদেশী কোম্পানিকে অনুমতি না দিলেও এবার এক্সনমোবিলকে এই অনুসন্ধানে অনুমোদন দেবে সরকার। যদি বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়, তাহলে এই মার্কিন কোম্পানির তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বাংলাদেশসহ আমেরিকার জন্যও আশীর্বাদ হয়ে আসবে। আর যদি এই অনুসন্ধানের অন্তরালে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চল ভূ-রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কাজে ব্যবহৃত হয় তা হবে দুঃখজনক। ঢাকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা এখানে তুলে ধরা হলোঃ

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনাগ্রহ দেখালেও এবার আগ্রহী হয়েছে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এক্সনমোবিল। সরকারও ইতিবাচক। সব ঠিক থাকলে এ বছরেই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি হতে পারে। জ্বালানি বিভাগের একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্র মতে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশকে ২৬টি বøকে ভাগ করা হয়েছে। অগভীর সমুদ্রে ১১টি এবং গভীর সমুদ্রে ১৫টি বøক রয়েছে। গভীর সমুদ্রে ১৫টি বøকেই তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নকাজ করতে সম্প্রতি পেট্রোবাংলার কাছে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে মার্কিন কোম্পানিটি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রস্তাবটি পাঠানো হলে তিনি তাতে নীতিগত সম্মতি দেন। তবে চূড়ান্ত চুক্তির আগে তার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করার নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। এ নিয়ে ইতিমধ্যে উচ্চপর্যায়ের কমিটি হয়েছে। চলতি বছরেই এক্সনমোবিলের সঙ্গে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) হবে।

প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানে কিছু আন্তর্জাতিক কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়ে পরে চলে যায়। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিদেশী কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে পিএসসি সংশোধন করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এক্সনমোবিলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা আশাবাদী। তারা বাংলাদেশে আসতে পারে জিওপলিটিক্যাল (ভূ-রাজনৈতিক) কারণে। কারণ তারা এক জায়গার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে এসে তারা যদি এখানে কিছু পায় তাহলে তাদের ‘সাপ্লাই চেইনে’ নতুন মাত্রা যোগ হবে। আমার ধারণা, তারা তাদের জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য আনতে চায়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে কখনো জ্বালানি পেতে সমস্যা হলে তাদের সরবরাহে যেন সমস্যা না হয়। ভৌগোলিক কৌশলগত কারণে এক্সনমোবিল বাংলাদেশে আগ্রহী হতে পারে। সব ঠিক থাকলে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে চলতি বছরেই তাদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।’

জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় মার্কিন কোম্পানির এ প্রস্তাবকে সম্ভাবনাময় মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক কারণে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের সাগরে অনুসন্ধানে আগ্রহী। বাংলাদেশের উচিত দ্রæত এ সুযোগ নেওয়া। তবে চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের সাগরে তেল-গ্যাস মজুদের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও এর অনুসন্ধান ও উৎপাদন অলাভজনক বলে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ শুরুর পরও চলে গেছে। আবার সাগরে কী পরিমাণ তেল-গ্যাস মজুদ আছে তা জানতে যে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে দরকার সেটি বাংলাদেশের না থাকায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। এজন্য মডেল পিএসসি সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে। জুন মাসের মধ্যে পিএসসি ২০২৩-এর চূড়ান্ত অনুমোদন হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।

এক্সনমোবিলের সঙ্গে বাংলাদেশ বছর-পাঁচেক আগে থেকেই যোগাযোগ রাখছে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি ওয়াশিংটনে এক্সনমোবিলের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য তাদের উৎসাহিত করেন।

জ্বালানি বিভাগ জানায়, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য ২০১৯ সালের মডেল পিএসসি অনুযায়ী অগভীর ও গভীর সমুদ্রের প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৫ দশমিক ৬ ডলার ও ৭ দশমিক ২৫ ডলার। এই দামে কোনো কোম্পানি জ্বালানি অনুসন্ধানে রাজি না হওয়ায় সরকার পিএসসি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে গ্যাসের দাম ১০ ডলার হতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশের হিস্যা কিছুটা কমতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের এসএলবি ও নরওয়ের টিজিএসকে সাগরে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে করার কাজ দিয়েছে সরকার। গত ৪ জানুয়ারি তারা নিজস্ব অর্থায়নে জরিপ কাজ শুরু করেছে। এতে বিনামূল্যে বাংলাদেশ সাগরের জরিপ তথ্য পাবে। যেসব প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধান করতে চায় তাদের কাছে জরিপের তথ্য বিক্রি করে টাকা তুলবে তারা।

এক্সনমোবিল মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের সঙ্গেও যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবে তারা তিন ধাপে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রথম দুই বছরে পিএসসি চুক্তি সই ও দ্বিমাত্রিক জরিপ করবে। পরবর্তী তিন বছর ত্রিমাত্রিক জরিপ ও শেষ তিন বছর কূপ খনন করবে।

ভূতত্ত¡বিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সাগরে অনুসন্ধান বন্ধ। স্থলভাগেও অনুসন্ধান চলছে ঢিমেতালে। বড় ধরনের গ্যাস সংকট তৈরি হওয়ায় সরকারের আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। এটা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ পরিস্থিতিতে এক্সনমোবিলের অনুসন্ধানের আগ্রহ খুবই ইতিবাচক। তারা আগ্রহী হওয়ায় বিশে^র অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এখানে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবে।’

তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সাগরের সম্পদ দিয়ে তাদের অর্থনীতি সুদৃঢ় করছে। ভারত ও মিয়ানমার সাগর থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস তুলছে। বাংলাদেশের সাগরে তেল-গ্যাস পাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও এখানে স্থবিরতা বিরাজ করছে। গত ২০ বছরে কোনো অনুসন্ধান-পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। এক্সনমোবিল এগিয়ে এসেছে। এটা আমাদের জন্য বিশাল সুযোগ। সুতরাং তাদের সঙ্গে দ্রæত আলোচনায় বসা উচিত। অবশ্য বাংলাদেশের স্বার্থ পুরোপুরি অটুট রাখার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। এমন চুক্তি যেন না হয় যাতে বাংলাদেশের স্বার্থে, সার্বভৌমত্বে আঘাত লাগে।’

গভীর সমুদ্রের সব চেয়ে সম্ভাবনাময় ব্লক-১২-তে অনুসন্ধানর জন্য পেট্রোবাংলার সঙ্গে ২০১৬ সালে পিএসসি সই করে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান পসকো দাইয়ু করপোরেশন। পরে গ্যাসের অস্তিত্ব পেয়ে তারা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিলে চুক্তি অনুযায়ী তার সুযোগ না থাকায় সরকার রাজি হয়নি। পরে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়।

২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তেল-গ্যাস কোম্পানি কনোকো-ফিলিপস গভীর সমুদ্রের ১০ ও ১১ নম্বর বøক ইজারা নিয়ে কাজ শুরু করে। ২০১৪ সালে ব্লক দুটিতে ৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ৮ ডলার দাবি করে তারা। কিন্তু পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী দাম ছিল ৬ দশমিক ৫ ডলার। সরকার দাম বাড়াতে রাজি না হওয়ায় তারা গ্যাস রপ্তানির অনুমতি চায়। এ শর্তেও সম্মতি না পাওয়ায় কনোকো-ফিলিপস চলে যায়।

২০১২ সালে আরেক দরপত্রের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে তিনটি বøকে (১২, ১৬ ও ২১ নম্বর) কাজ করার জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব করে কনোকো ও স্টেট অয়েল। পরে কনোকো সরে যাওয়ায় বøকগুলো আর ইজারা দেওয়া যায়নি। অগভীর সমুদ্রের ৪ ও ৯ নম্বর বøক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি ভিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়া এবং ১১ নম্বর বøকটি সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি ইজারা নেয়। ত্রিমাত্রিক জরিপ করার পর কূপ খনন না করেই সান্তোস কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে অগভীর সমুদ্রের দুটি বøকে ভারতীয় কোম্পানি কাজ করলেও তাদের কাজের গতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বি আইএসএস) গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ মাহফুজ কবীর বলেন, ‘বিশ্বসেরা এক্সনমোবিল ৫০-৬০ বছর আগেও এই এলাকায় ছিল। ৭৫ সালের দিকে তারা চলে যায়। তাদের আবার আসতে চাওয়া বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। তারা কাজ করলে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের নতুন দুয়ার খুলবে। আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কেরও উন্নতি হবে। পাশাপাশি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়বে। সার্বিকভাবে এক্সনমোবিলের সঙ্গে চুক্তি বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক। বাংলাদেশ যেন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে তা-ও খেয়াল রাখতে হবে।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com