বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম জাপান। ঝকঝকে শান্ত, সুন্দর, গোছানো দেশের নাম বললে প্রথমেই আসবে জাপানের কথা। যারা প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে আছে প্রায় ২৫ বছর ভবিষ্যতে। তবে এতো উন্নত দেশটিতে জনসংখ্যা যেমন কম তেমনি তারা পরিবার গঠনেও খুব একটা আগ্রহী নন।
আবার এই দেশে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধ মানুষ বসবাস করে তা নিশ্চয়ই জানেন। জাপানের বেশিরভাগ মানুষই একাকীত্বে ভোগেন। এজন্য তারা পরিবার গঠন না করলেও ভাড়া করেন সঙ্গী। কেউ প্রেমিক বা প্রেমিকা ঘণ্টা চুক্তিতে সঙ্গী ভাড়া করে মনের কথা বলতে পারেন। তেমনি চাইলে দাদি বা কোনো বৃদ্ধাকেও ভাড়া করতে পারেন।
আমাদের জীবনে দাদি-নানির গুরুত্ব কতখানি তা হয়তো নতুন করে বলার কিছু নেই। ছোটবেলায় এই মানুষগুলোর কাছ থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি আদর পেয়েছি, যত আবদার ছিল তাদের কাছেই। তেমনি বড় হওয়ার পরও তাদের গুরুত্ব আমাদের জীবন থেকে কমে না একটুও। মন খুলে একটু কথা বলতে কিংবা জীবনের কোনো জটিল সময়ে পরামর্শ নিতে ভরসা দাদি-নানি।
জাপানে তাই তো ষাটোর্ধ্ব নারীরা এই গ্র্যান্ডমা পরিষেবা দিয়ে থাকে অনেক এজেন্সি। ওকে গ্র্যান্ডমা জাপানের একটি ক্লায়েন্ট সার্ভিসেস কোম্পানি। তারাই ক্লায়েন্ট সার্ভিসেস প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর ২০১২ সালে এই পরিষেবাও চালু করেন। সেখানে নিযুক্ত আছেন ১০০ জনেরও বেশি বয়স্ক কর্মী। যারা জীবনের অভিজ্ঞতা, তাদের আবেগ সব কিছু নিয়ে অবদান রাখতে চান এই সমাজে। তাদের মধ্যে কেউ আছেন খুব ভালো রান্না করেন, কেউ ছোটদের যত্ন করতে পারেন, কেউ গল্প করতে পারেন, পরামর্শ দিতে পারে, কারোবা হাতের লেখা খুব ভালো। কেউবা অভাবী কাউকে কেবল সঙ্গ দেওয়ার কাজটিই করেন।
এই ধরনের সার্ভিস সাধারণত নেয় ব্যস্ত বাবা-মা, যারা ছোট বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারেন না, তারা একজন অভিজ্ঞ, স্নেহময় দাদি ভাড়া নেন বাচ্চাদের গল্প শোনানো, খাওয়ানো বা সময় কাটানোর জন্য। অনেকে তাদের প্রয়াত বা দূরে থাকা দাদির অভাব বোধ করেন। তারা একজন বয়স্ক নারীকে ভাড়া করে দাদির মতো মমতা ও সাহচর্য পেতে চান।
আবার যারা জাপানে নতুন এবং পরিবার থেকে দূরে থাকেন, তারাও এ সার্ভিসের মাধ্যমে পারিবারিক উষ্ণতা খোঁজেন। এর মধ্যে অনেকেই আছেন প্রবাসী বা অভিবাসীরা। সিনেমা, নাটক বা ভিডিও কনটেন্ট নির্মাতারাও ভাড়া করেন তাদের। কোনো বিশেষ দৃশ্যে দাদি চরিত্র দরকার হলে এজেন্সি থেকে ভাড়া করে নেন।
আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে কেন এমন সার্ভিস প্রয়োজন হলো? জাপানে দীর্ঘদিন ধরে একাকীত্ব একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। বহু মানুষ জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে একা হয়ে যান। ‘হিকিকোমোরি’ নামে পরিচিত কিছু তরুণ বছরের পর বছর ধরে ঘর থেকে বের হন না। একা, নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকতে থাকতে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
জাপানে পরিবারে সদস্য সংখ্যা কমছে, বৃদ্ধ বাবা-মা অনেক সময় একা থাকেন। শিশুদের বড় করতে দাদি-নানির ভূমিকা কমে যাওয়ায় শিশুরা ‘জেনারেশনাল বন্ড’ হারাচ্ছে। এইসব সমস্যার সমাধানে জাপানে ‘পরিবার বা সম্পর্ক ভাড়া’ নামক ধারণা জন্ম নেয়, যার ভেতরে দাদি ভাড়াও একটি অংশ।
জাপানে এমন সব এজেন্সি রয়েছে যারা মানুষকে ভাড়া দেয়। এর মধ্যে প্রেমিক/প্রেমিকা, বন্ধু ,বাবা-মা, ভাই, বোন এমনকি স্বামী/স্ত্রীও রয়েছে। এছাড়া কান্নার সঙ্গী, কফিনে শুয়ে থাকার পার্টনার, এমনকি বিবাহের অতিথিও ভাড়া পাওয়া যায় জাপানে।
এই সার্ভিসের মানবিক বা বাণিজ্যিক দুই দিকই রয়েছে। মানবিক দিক হচ্ছে এই সার্ভিস অনেকের জীবনে ভালো প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ আত্মহত্যার চিন্তা থেকে ফিরে আসেন, শিশুরা বয়স্কদের ভালোবাসা পান, অনেকে মানসিকভাবে স্থিতিশীল হন।
অন্যদিকে এই সার্ভিস একটি লাভজনক ব্যবসা। ভাড়াকৃত সম্পর্কের জন্য প্রতি ঘণ্টায় ১০০০ থেকে ৫০০০ ইয়েন পর্যন্ত নেওয়া হয় (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭০০-৩৫০০ টাকা)। এজেন্সিগুলো এসব মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠায় এবং পর্যবেক্ষণ রাখে।
যদিও জাপানি সমাজে এই বিষয়টি মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। কেউ এটিকে সামাজিক সংকটের চিত্র হিসেবে দেখে। কেউ বলে, যেখানে সম্পর্ক ক্রয়যোগ্য হয়, সেখানে সম্পর্ক আর সম্পর্ক থাকে না। আবার অনেকে এটিকে বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো আধুনিক সেবা বলেই মানেন।
সূত্র: অডিটি সেন্ট্রাল