বেশির ভাগ প্রবাসী মুসলিম বাসার বাইরে কোথাও খাবার খেতে গেলে আগেভাগেই জানতে চান খাবারটি হালাল কি না। হালাল না হলে তারা খান না। হালাল খাবার ও হালাল মাংস না হলে যত দামি রেস্টুরেন্ট কিংবা পছন্দের খাবারের আইটেমই থাক না কেন, তারা খান না, ফিরে যান।
পরিবারের কাউকেও খেতে দেন না। এ রকম বহু নজির রয়েছে। যেসব মুসলিম হালাল খাবার ছাড়া খান না, তাদের ও অন্যান্য সব মানুষের জন্য হালাল খাবারের সমারোহ ঘটিয়েছে জ্যাকসন হাইটসের ‘জমজম গ্রিল’। গত বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে চারজন প্রবাসী বাংলাদেশির উদ্যোগে আপনা বাজারের উল্টো দিকে স্থাপিত হয় এই রেস্টুরেন্ট। অল্প দিনের ব্যবধানে এই রেস্টুরেন্টটি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে।
পাশাপাশি মজাদার, মুখরোচক খাবার, দেশি, মেডিট্রেরিয়ান, আফগান, তার্কিশসহ বিভিন্ন দেশের খাবার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে তৈরির মাধ্যমে মানুষের মনে কেড়ে নিয়েছে। একবার তাদের রেস্টুরেন্টে যারা যাচ্ছেন, তারা আবার ফিরছেন একাধিক খাবারের জন্য।
সৌদি আরবের বাদশাহ কিং ফাহাদ হাসপাতাল, দুবাইয়ের গালফ এয়ারের ক্যাটারিং, হোটেল পূর্বাণীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শেফ আশিক রহমান কাজ করছেন জমজম গ্রিলে। তিনি অত্যন্ত যত্নসহকারে মানুষের জন্য খাবার তৈরি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মানুষকে খাইয়ে তৃপ্তি বোধ করি। আমি বাংলাদেশ থেকে পুরো পরিবার নিয়ে এখন এখানে আছি। রিটায়ার্ড লাইফ কাটাচ্ছিলাম। সেখান থেকে আমাকে ইউসুফ ভাই রেস্টুরেন্টের জন্য নিয়ে আসেন।’ তিনি বলেন, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, সাবেক মন্ত্রী মীর নাসির, কণ্ঠশিল্পী ডলি সায়ন্তীসহ দেশের অনেক বিখ্যাত মানুষের জন্য রান্না করেছেন। তার রান্না করা খাবার একবার যিনি খেয়েছেন, তার রান্নার ভক্ত হয়ে গেছেন। ২০১৯ সালে তিনি দারুল উলুম মাদ্রাসায় নিউইয়র্ক সিটির মেয়র বিল ডি ব্লাজিওর জন্য রান্না করেছেন। তার হাতের রান্না ও সালাদ খেয়ে বিল ডি ব্লাজিও তাকে টিপস দিয়েছিলেন বলে জানান।
রেস্টুরেন্টের চার মালিকের দুজন হলেন মো. ইউসুফ ও জহিরুল হক। তারা দুজন সময় দেন, বাকি দুজন মাঝেমধ্যে আসেন। তারা সবাই এই কাজের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবসায় সম্পৃক্ত রয়েছেন। তবে তারা সবাই ভোজনরসিক। নিজেদের পছন্দের খাবারের কারণেই প্যান্ডামিকের মধ্যেও একটি রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন।
এ ব্যাপারে মো. ইউসুফ বলেন, ‘প্যান্ডামিকের আগে এখানে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। প্যান্ডামিকের সময় সেটি টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আমি এই জায়গাটি খালি দেখে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে রেস্টুরেন্টটি ভাড়া নিই। চারজন মিলে যাত্রা শুরু করি। মূলত করোনার সময়ে নতুন একটি রেস্টুরেন্ট করা কঠিন ছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘জমজমে পাঁচতারকা হোটেলের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক থাকায় সুবিধা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি নিজস্ব আইটেম দিয়ে শুরু করার। রেস্টুরেন্টটি শুরু করার আগে পছন্দের সব খাবার রান্না করিয়েছি। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যরা মিলে প্রতিটি খাবার সাত দিন ধরে ট্রাই করেছি। সাত দিন খাওয়ার পর যেটা যেটা ভালো লেগেছে, সেগুলো আমরা রেস্টুরেন্টে রাখছি ও তৈরি করাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সমুচা একেবারে অন্য রকম। এই সমুচার রিভিউ দেখে চ্যানেল সেভেন থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। সোমবার এর শুটিং হয়েছে। এটি চ্যানেল সেভেনে প্রচারিত হলে বাংলাদেশি একটি খাবারের আইটেম আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম অর্জন করবে। গুগলে আমাদের ওই সমুচার রিভিউ দেখে চ্যানেল সেভেনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এর ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য বলেন। এরপর তারা এসে রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখে যান এবং পরে শুটিং করেন। আমরা আসলে চেষ্টা করছি বাংলাদেশি খাবারের পাশাপাশি মেডিট্রেরিয়ান খাবারের সমন্বয় ঘটাতে। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাবারের আইটেম রয়েছে। বাংলাদেশের ফুচকা, সমুচা, শিঙাড়া, চটপটি, কালো ভুনা, মেজবানি, কাচ্চি বিরিয়ানি, কাবাবও আছে। আমাদের শেফের তৈরি কাচ্চি বিরিয়ানি, কালো ভুনা, মেজবানির মাংস, গ্রিল কাবাব, আফগান খাবারসহ অনেক খাবার রয়েছে। যেগুলো অনন্য, অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।
ল্যাম্প কাবাবও অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।’ইউসুফ আরো বলেন, ‘আমি প্যান্ডামিকের মধ্যে রেস্টুরেন্ট করার কথা চিন্তা করেছি, কারণ দেখলাম একটি শতভাগ হালাল খাবারের রেস্টুরেন্ট প্রয়োজন। করোনার মধ্যে অনেক রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় মানুষের হালাল খাবার সংগ্রহ করতে কষ্ট হয়েছে। রেস্টুরেন্ট খোলা রাখতে না পারলেও অনলাইনে অর্ডার নেওয়া ও খাবার সরবরাহ করা সম্ভব। এ ছাড়া জ্যাকসন হাইটসে সব দেশের মুসলমানরা আসেন। এখানে শতভাগ হালাল মাংস এবং জাবিয়াহ সার্টিফায়েড রেস্টুরেন্ট দিলে চলবে। জাবিয়াহ কর্তৃপক্ষ তিন মাস আমাদের এখানে এসেছে, পর্যবেক্ষণ করেছে। আমরা তাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তারা জাবিয়াহ হালাল সার্টিফিকেট দিয়েছে। আমাদের সব খাবার ফ্রেশ। প্রতিদিন এখানে হালাল উপায়ে হাতে জবাই করা মাংস আসে। আমরা সব সময় ফ্রেশ খাবার সরবরাহ করছি। খাবারের মান যেমন ধরে রেখেছি, সেই সঙ্গে শতভাগ হালাল দিচ্ছি। এখানে দামও খুব কম।’
তিনি রমজান মাসের জন্য ৬.৯৯ ও ৭.৯৯ ডলারে ইফতারির বিশেষ প্যাকেজ থাকবে। এ ছাড়া মসজিদের জন্য অনেক কম মূল্যে বিশেষ প্যাকেজ থাকবে। যেকোনো মসজিদ তাদের কাছ থেকে খাবার নিতে পারবে। তারা অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার রান্না ও সরবরাহ করেন। রান্না করা খাবারের পাশাপাশি তারা ক্যাটারিংও করছেন। যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য কমপক্ষে ৫-৭ দিন আগে অর্ডার দিলে যত বড় পার্টিই হোক, খাবার সরবরাহ করতে পারবেন। সম্পূর্ণ হালাল মাংস দিয়ে ফ্রেশ খাবার সরবরাহ করবেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা খাবারের কোয়ালিটির ব্যাপারে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ করি না। সার্ভিস কোয়ালিটিও নিশ্চিত করি।’
মালিকদের পরিকল্পনা রয়েছে জ্যামাইকা, ব্রুকলিন ও ম্যানহাটনে জমজম গ্রিলের শাখা করার। এ জন্য জায়গাও দেখছেন তারা। ভালো লোকেশন পেলেই তা শুরু করবেন। এ ছাড়া খাবারের বিভিন্ন আইটেম দিয়ে তারা ফ্র্যাঞ্চাইজিও দিতে চাইছেন। কেউ ফ্র্যাঞ্চাইজি নিতে চাইলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। তারা খেবসাও তৈরি করেন। প্রতি শনিবার এটি হয়।
রেস্টুরেন্টটির ইন্টেরিয়র ডিজাইনও করেছেন মো. ইউসুফ। ভেতরে নান্দনিকতা রয়েছে। ইউসুফ মূলত রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করতে সুবিধা হয়েছে। তারা যে চারজন এই রেস্টুরেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা সবাই দেশের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জমজম গ্রিল প্রতিদিন বেলা ১১টায় খোলা হয় আর বন্ধ হয় রাত ১২টায়। আগামীতে এটি সকাল আটটা থেকে চালু করার চিন্তা করছেন উদ্যোক্তারা।