রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৮ পূর্বাহ্ন

জে.কে. রাউলিং: অনাহারী জীবন থেকে হ্যারি পটারের স্রষ্টা

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হ্যারি পটার সিরিজের কথা কে না জানে! এই সিরিজের আয় বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মোট সম্পদের থেকেও কয়েক গুণ বেশি। আর সেই সিরিজের স্রষ্টা তথা লেখিকার নাম জে.কে. রাউলিং। বিশ্বব্যাপী এ নামে পরিচিত হলেও এটি আসলে ছদ্মনাম।

জে.কে. রাউলিং এর প্রকৃত নাম জোয়ান রাওলিং। একজন নারী লেখিকার বই তুলনামূলক কম বিক্রি হতে পারে- এমন আশঙ্কায় তিনি নিজের মূল নামের পরিবর্তে শুধুমাত্র আদ্যক্ষর দিয়ে তার ছদ্মনামটি তৈরি করেন। মূল নামের সঙ্গে কোনো মধ্যবর্তী নাম না থাকলেও দাদী ক্যাথরিনের সম্মানে তিনি ছদ্মনামের সঙ্গে ইংরেজি বর্ণমালার কে অক্ষরটি যোগ করেন।

জোয়ান রাওলিং ১৯৬৫ সালের ৩১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। বলে রাখা ভালো, জে.কে. রাউলিং আর হ্যারি পটারের জন্ম একই দিনে।জোয়ান রাওলিংয়ের বাবার নাম পিটার জেমস রাউলিং এর মায়ের নাম অ্যান রাউলিং। তার বাবা পেশায় ছিলেন এয়ারক্রাফট প্রকৌশলী। এক্সিটার ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করেন।

পৃথিবীর লেখকদের মধ্যে জে.কে. রাউলিংই সর্বপ্রথম বিলিওনিয়ার হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। আর এসবই সম্ভব হয়েছে তার অসাধারণ কল্পনাশক্তি আর গল্প বলার অবাক করা ক্ষমতার কারণে। কিন্তু তার এই সফলতা রাতারাতি আসেনি। সাফল্যের সিঁড়িতে পা রাখার আগে তাকে বেশ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।

পড়াশোনা শেষে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে জে.কে. রাউলিং ১৯৯০ সালে পর্তুগালে পাড়ি জমান। সেখানে তার পরিচয় হয় পর্তুগিজ সাংবাদিক জর্জ আর্নেটসের সঙ্গে। ১৯৯২ সালের ১৬ অক্টোবর তারা বিয়ে করেন। ১৯৯৩ সালের ২৭ জুলাই এ দম্পতির ঘরে জেসিকা নামে একটি মেয়ের জন্ম হয়।

কিন্তু এরপরেই জে.কে. রাউলিংয়ের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। স্বামীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত তার সাংসারিক ঝামেলা লেগেই থাকত। এমনকি স্বামীর কাছে নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর রাউলিংকে নিজের বাড়ি থেকে বের করে দেন জর্জ আর্নেটস। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। ১৯৯৫ সালের জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

বিবাহবিচ্ছেদের পর মেয়ে জেসিকাকে নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে ফিরে এসে নিজের ছোট বোন দাই এর সঙ্গে থাকতে শুরু করেন রাউলিং। স্কটল্যান্ডে ফিরে রাওলিং তার মেয়েকে নিয়ে বেশ অর্থাভাবে পড়েন। মেয়েকে নিয়ে অনাহারে দিন কাটানো রাউলিং যখন জীবনধারণের জন্য যখন অর্থ যোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছেন, তখনই তিনি অর্থ আয়ের জন্য বই লেখা শুরু করেন; যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন ৬ বছর বয়সে।

জে.কে. রাউলিংয়ের লেখালেখির শুরুটাই হয় হ্যারি পটার সিরিজের বই দিয়ে। কিন্তু অবাক লাগলেও সত্যি, রাউলিংয়ের লেখা হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম বইটি প্রকাশ করতে টানা ১২টি প্রকাশনা সংস্থা অস্বীকৃতি জানায়। শেষ পর্যন্ত “অপয়া” ১৩ সংখ্যাটিই তার জীবনে পয়মন্ত হয়ে ওঠে। ত্রয়োদশ প্রকাশক সংস্থা ব্লুমসবেরি রাউলিংয়ের লেখা বইটি প্রকাশ করতে রাজি হয়।

১৯৯৭ সালের জুনে জে.কে. রাউলিংয়ের প্রথম বই “হ্যারি পটার এ্যান্ড দি ফিলোসফার্স স্টোন” প্রকাশিত হয়। এরপরের গল্পটি শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। শিশুতোষ রূপকথার বইটি প্রকাশ হওয়ার পর রাতারাতি আন্তর্জাতিক বেস্টসেলারে পরিণত হয় এবং রাওলিং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত একজন বড় লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পান। পরবর্তীতে হ্যারি পটার সিরিজের আরও ৭টি বই বের হয়।

জে.কে. রাউলিংয়ের লেখা হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলো হলো হ্যারি পটার এ্যান্ড দি ফিলোসফার্স স্টোন, হ্যারি পটার এ্যান্ড দি চেম্বার অব সিক্রেস্টস, হ্যারি পটার এ্যান্ড দি প্রিজনার অব আজকাবান, হ্যারি পটার এ্যান্ড দি গবলেট অব ফায়ার, হ্যারি পটার এ্যান্ড দি অর্ডার অব দি ফিনিক্স, হ্যারি পটার এ্যান্ড দি হাফ ব্লাড প্রিন্স, হ্যারি পটার এ্যান্ড দি ডেথলি হলোস, হ্যারি পটার এ্যান্ড দি কার্সড চাইল্ড। প্রতিটি বইই আগেরটির চেয়ে বেশি সাফল্য লাভ করে। ১৯৯৯ সালে যখন হ্যারি পটারের প্রথম তিনটি বই নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার তালিকার প্রথম তিনটি জায়গা একসঙ্গে দখল করে নেয়।

এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার। হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম বইটি ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হলেও জে.কে. রাউলিংয়ের মাথায় এ সিরিজটির ধারণা এসেছিল ১৯৯০ সালেই। ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনগামী ট্রেন স্টেশনে আসতে যখন চার ঘণ্টা দেরি হয়, তখনই তার মাথায় কল্পকাহিনীর সিরিজটির কথা মাথায় আসে। পরবর্তীতে বইয়ের পাতা থেকে সিরিজটি জায়গা করে নিয়েছিল রুপালি পর্দায়ও। সেখানেও এটি সাফল্যের দেখা পায়। হ্যারি পটার সিরিজের ওপর নির্মিত প্রতিটি সিনেমাই বক্স অফিসে অভাবনীয়ভাবে সফল হয়।

তবে জে.কে. রাউলিংয়ের লেখার গণ্ডি শুধু হ্যারি পটার সিরিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তার লেখা “ক্যাজুয়াল ভ্যাকেন্সি” বই। কল্পকাহিনীর পরিবর্তে ডার্ক কমেডি ঘরানান বইটিতে ছিল নির্মম বাস্তবতার এক অদ্ভূত প্রতিফলন। পরের বছরেই তিনি রবার্ট গ্যালব্রেইথ ছদ্মনাম নিয়ে “কুকুস কলিং” নামের বই লেখেন। একই বছর তিনি চিত্রনাট্যকার হিসেবে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন।

তবে ২০১৬ সালে মঞ্চনাটক “হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড” এবং সিনেমা “ফ্যান্টাসটিক বিস্টস অ্যান্ড হয়্যার টু ফাইন্ড দেম”র মাধ্যমে জে.কে. রাউলিং ঠিকই আবার হ্যারি পটারের ভুবনে ফিরে এসেছিলেন। প্রথমটির গল্প গড়ে উঠেছে হ্যারি পটার সিরিজ শেষ হওয়ার উনিশ বছর পরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, আর ফ্যান্টাস্টিক বিস্ট এর কাহিনী গড়ে উঠেছে হ্যারি পটার সিরিজের ঘটনা শুরুর বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ডা. নেইল মারি নামের একজন চিকিৎসককে রাউলিং বিয়ে করেন। এই দম্পতির দুটি পুত্রসন্তান রয়েছে। বড় ছেলে ডেভিডের জন্ম হয় ২০০৩ সালে এবং ছোট ছেলে ম্যাকেঞ্জির জন্ম ২০০৫ সালে। পরিবার নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে বসবাস করেন।

লেখকদের মধ্যে জে.কে. রাউলিংই সর্বপ্রথম শতকোটি ডলারে মালিক হন। পরবর্তীতে কিছু দাতব্য সংস্থায় দান করার পর বিলিওনিয়ারের তালিকা থেকে তার নাম কাটা পড়ে। তারপরও তার মোট সম্পদের মূল্য এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।

এত এত সাফল্যের পরও রাউলিং খুবই সাধারণ জীবনযাপনের চেষ্টা করেন। রাওলিংয়ের সর্বাধিক প্রশংসিত দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তিনি এত সাফল্যের পরও অতীত ভুলে যাননি। ২০১৫ সালে তিনি লুনোস ইউএসএ নামে একটি দাতব্য সংস্থা চালু করেন। কঠিনতম মুহূর্তে সৃষ্টিশীলতার জাগরণ ঘটিয়ে জীবনের সবচেয়ে সেরা কাজটি করে জে.কে. রাউলিং আজ অনেকেরই অণুুপ্রেরণার আরেক নাম।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com