বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি ও নকশিকাঁথা শিল্পকে এবার সোজাসুজি ‘পশ্চিমবঙ্গের’ বলে দাবি করলো ভারতের একটি শীর্ষস্থানীয় বিমান সংস্থা ‘এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস’!
ভারতের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম এয়ারলাইন ‘এয়ার ইন্ডিয়া’র সম্পূর্ণ মালিকানাধীন এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস একটি লো-কস্ট বা বাজেট বিমান সংস্থা হিসেবে পরিচিত। তবে তাদের বহরেও রয়েছে ৯০টিরও বেশি বিমান। প্রতি সপ্তাহে ভারতে ও ভারতের বাইরে তারা ৪৫টিরও বেশি ডেস্টিনেশনে দু’হাজারেরও বেশি ফ্লাইট চালায়।
এহেন জনপ্রিয় এয়ারলাইনটি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাদের নতুন দুটি রুট চালু করা উপলক্ষে ‘পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা’কে সম্মান জানিয়েছে জামদানি ও কাঁথার ‘জন্মভূমি’ হিসেবে ভারতের ওই রাজ্যটিকে স্বীকৃতি দিয়ে!শুধু তাই নয়, এই উপলক্ষে তাদের দুটি ব্র্যান্ড নিউ এয়ারক্র্যাফটের ‘টেইল ফিন’ (বিমানের লেজের দিকের অংশ) সাজানো হয়েছে জামদানি আর কাঁথা আর্টের মোটিফে।
এয়ারলাইনের পরিভাষায় বিমানের গায়ে এ ধরনের শিল্পকলাকে বলে ‘টেইল আর্ট’– আর এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের অন্তত দুটি বিমান তাদের শরীরে ‘পশ্চিমবঙ্গের’ বলে দাবি করা সেই শিল্পের স্বাক্ষর বহন করছে।
জামদানি মোটিফের টেইল-আর্ট সমন্বিত বিমানটি যখন এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের ফ্লিটে যুক্ত করা হয়, সে দিন ওই বিমান সংস্থার কর্মীরা সাবেকি বাঙালি পোশাকে সেজে কলকাতা বিমানবন্দরের টারম্যাকে এসে সমবেতভাবে উদযাপনও করেছিলেন।
তবে এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস যা-ই বলুক, জামদানি ও কাঁথা (বিশেষ করে নকশিকাঁথা) যে একান্তভাবে বাংলাদেশেরই নিজস্ব সম্পদ, সেই তথ্য আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত।
জামদানির বুননকে জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো প্রায় এক দশক আগেই ‘মানবতার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক সম্পদ’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এর জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) ট্যাগও পেয়েছে বাংলাদেশ।
জামদানির যে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ইউনেসকো তাদের ওয়েবসাইটে তুলে ধরেছে সেখানেও ঢাকা ও তার আশেপাশে এই বিশেষ ধরনের শাড়ির উৎপত্তি বলে জানানো হয়েছে– পশ্চিমবঙ্গের কোনও উল্লেখ সেখানে ঘুণাক্ষরেও নেই!
আর নকশিকাঁথার শিল্পও যে বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতেই বিকশিত হয়েছে, তা নিয়েও কোনও দ্বিমত নেই। পল্লীকবি জসীমউদ্দিন তার কবিতার মধ্যে দিয়ে এই নকশিকাঁথাকে অমর করে গেছেন, ফলে বাংলাদেশের লোকশিল্প আর সাহিত্যেও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে এই ঐতিহ্যবাহী পরম্পরা।
পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও এলাকাতেও নকশিকাঁথা বোনার রীতি আছে এ কথা ঠিকই, কিন্তু প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে তা কোনও তুলনাতেই আসবে না। বস্তুত কাঁথার জন্ম বাংলার এই প্রান্তে, এমন দাবি সেই রাজ্যের শিল্প সমঝদার বা গবেষকরাও করেন না!
প্রশ্ন হলো, তাহলে কীসের ভিত্তিতে এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস জামদানি ও কাঁথাকে পশ্চিমবঙ্গের সম্পদ বলে দাবি করছে?
ব্র্যান্ড কনসালটেন্ট রিখিয়া মজুমদারের ধারণা, ‘যেহেতু ওই এয়ারলাইনটি পশ্চিমবঙ্গে তাদের বিজনেস এক্সপ্যান্ড (সম্প্রসারণ) করতে চাইছে, তাই ওই রাজ্যের মানুষের আবেগে সুড়সুড়ি দিতেই জামদানি ও নকশিকাঁথার মতো প্রিয় দুটো প্রোডাক্টকে সেখানকার নিজস্ব জিনিস বলে তুলে ধরা হচ্ছে!’
‘এখন এটা ভালো মার্কেটিং বা বিপণন স্ট্র্যাটেজি হতে পারে, কিন্তু সঠিক গবেষণা বা ইতিহাসের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য নয় তা তো বোঝাই যাচ্ছে!’, বলছিলেন রিখিয়া মজুমদার।
একই প্রশ্ন বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের কাছেও করা হয়েছিল। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত সেই ই-মেইলের কোনও জবাব আসেনি।
প্রসঙ্গত, এ বছরের গোড়ার দিকে ‘টাঙ্গাইল’ শাড়ির জন্ম কোথায়, ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি ফেসবুক পোস্টের পর তা নিয়ে তীব্র আন্তর্জাতিক বিতর্ক হয়েছিল।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওই পোস্টে ভারত সরকার দাবি করে, টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি ঐতিহ্য। এরপর বহু বাংলাদেশি সামাজিক মাধ্যমে সেই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানান, টাঙ্গাইল যে বাংলাদেশের একটি জেলা সে কথাও তারা মনে করিয়ে দেন। পরে বাংলাদেশ সরকারও কূটনৈতিক স্তরে ভারত সরকারের কাছে তাদের আপত্তির কথা তুলে ধরে।
এরপর টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই ট্যাগ যাতে বাংলাদেশ পায়, সে জন্যও সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এখন ভারতের একটি এয়ারলাইন জামদানি ও কাঁথার মালিকানাও ‘বেহাত’ করে ফেলার পর সীমান্তের দু’পারে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, সেটাই দেখার!