চীনের মহাপ্রাচীর, মানুষ্যতৈরী একমাত্র স্থাপত্য যা মহাশূন্য থেকে দেখা যায়। এটা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও এটা যে চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থাপত্য তা নিয়ে দ্বিমত নেই। লক্ষ লক্ষ দাস, শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রম এবং সম্রাটদের অত্যাচারের নিদর্শন আজকের এই চীনের মহাপ্রাচীর। তো চলুন দেখে নেই চীনের সেই মহাপ্রাচীর সম্পর্কে।
চীনের মহাপ্রাচীর আজকাল কের পর্যটন আকর্ষণ হলেও, ইতিহাস বা গড়ে উঠার কারণ এতো সুখকর নয়। এটা হাজার বছর পুরনো ধারণা, যখন মানুষ অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য লড়াই করছিল প্রকৃতি, বন্যপশু এবং খোদ মানুষের কাছ থেকে। ইতিহাস সম্পর্কে এক কথায় বলতে গেলে, প্রাচীন যাযাবর জাতি, বিশেষত, যাযাবর মঙ্গোলিয়ানদের থেকে বাচানোর জন্য চীনা সম্রাটরা যে প্রাচীর নির্মাণ করেন তাই আজকের চীনের মহাপ্রাচীর। চীনের মহাপ্রাচীর যেমন বিস্তৃত তেমন এর ইতিহাস বিস্তৃত। কয়েকধাপে, কয়েকশ বছর ধরে, কয়েক সম্রাজ্যের চীনাদের দান The Great Wall of China.
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, মানে আজ থেকে প্রায় দুই হাজার আটশত বছর আগে,তৎকালীন চৈনিক সভ্যতার উত্তর প্রান্তে বেশ কয়েকটি ছোট বড় রাজ্য ছিলো, আরো উত্তরে ছিলো যাযাবর মঙ্গোলিয়ানদের বাস। এই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি নিয়মিত বিরতিতে আক্রমণ করত উত্তর সীমানার গ্রাম শহর গুলোতে। চলত হত্যা, লূন্ঠন। তারা ছিলো উত্তরের ত্রাস এবং তাদের বেপরোয়া আক্রমণ গুলো অর্থনৈতিক কাঠামো ধংস করে দিচ্ছিলো। এবং তাদের আক্রমণ ঠেকাতেই শুরু হয় নির্মাণ হয় মানব সভ্যতার সর্ববৃহত প্রকল্প।
প্রথম দিকে ছোট করে মাটি, পাথর দিয়ে নির্মাণ শুরু হতে খাকে প্রাচীর। তবে ২২০ থেকে ২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনের সম্রাট ছিন শি হুয়াং প্রাচীরের সবচেয়ে দীর্ঘ অংশ নির্মাণ করেন। তিনিই আজকের এক চীনের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি উত্তরের রাজ্যগুলো দখলে নেন এবং প্রাচীর নির্মাণ করতে থাকেন অসংখ্য দাসদের দ্বারা যা আজকের মত ইট সিমেন্ট দিয়ে তৈরীর মতো সহজ ছিলোনা। তারপর সম্রাট শি হুয়াং এবং ছিন, হান এবং সুই রাজবংশের বিভিন্ন সম্রাটরাও প্রাচীরের নানা অংশ নির্মাণ করেন বা মেরামত করেন। তারা বিভিন্ন সময়োপযোগী পরিবর্তন আনেন। আজকের মহাপ্রাচীর অনেক অংশের, বিভিন্ন অঞ্চলের সমষ্টিমাত্র। মধ্যযুগে মিং সম্রাটরা এই প্রাচীর উন্নতি এবং পুনর্নিমাণ করেন ক্ষতিগ্রস্থ অংশগুলো।
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্থাপনাতে তৎকালীন সেরা প্রকৌশলীদের অবদান সত্যিই প্রসংশার যোগ্য এবং তাদের দেখানো পথ এখনো ব্যাবহার হয়ে আসছে। সাধারণ কিছু হাতিয়ার দিয়ে এতো দীর্ঘ প্রাচীর নির্মাণ শুধু চৈনিক সভ্যতার দ্বারা সম্ভব ছিলো। তাদের হাতিয়ার বলতে ছিলো কোদাল, খুরপি, হাতুড়ি, বাটালি, ছেনি শাবল এসব। একদল কাঠের ফ্রেম বানাতো, একদল মাটি, পাথর ভরে দিতো এবং শেষের দল তা চাপ দিয়ে শক্ত করতে। বাহিরের দিকে ছিলো পোড়ামাটি বা ইট যা প্রাচীরকে করত দূর্ভেদ্য। তাতে থাকত টাওয়ার, যা থেকে তার পাহারা দিতো এবং শত্রু আসলেই প্রত্যকে টাওয়ার থেকে ধোয়ার সংকেত দিত এবং তা পলকেই গোটা বাহিনী জেনে যেতো। এটাই ছিলো তাদের প্রধান অস্ত্র।
কিন্তু সব যায়গাতে মাটি ছিলোনা। তখন প্রাচীন ইঞ্জিনিয়াররা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলো। তার একটি উদাহরণ মরুভুমি। যেখানে টনকে টন মাটি নিয়ে গিয়ে প্রাচীর নির্মাণ অসম্ভব। তাই তারা প্রাচীর না করে নির্মান করলো খাল এবং ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করলো খাগড়া এর স্তুপ দিয়ে, তা এখন টিকে আছে সময়ের সাথে যুদ্ধ করে। তেমনি খাড়া পাহাড়, জংগল বা জল আটকাতে পারেনি কিছুই।
কতো বড় আসলে এই মহাপ্রাচীর?
উত্তর: ২১,১৯৬ কিলোমিটার।
বর্তমানে টিকে থাকা সব রাজাদের প্রাচিরের এর যোগফল। যেখানে মিং দের অবদান সর্বোদীর্ঘ। যা দিয়ে মিয়ামী থেকে উত্তর পোলে যাওয়া সম্ভব। বলা হয় ১/৩ অংশ গায়েব হয়ে গেছে। সুতরাং আরো দীর্ঘ হয় যদি অবাক হওয়ার কিছু নাই। কারণ এখনো গবেষণা চলছে। এর উচ্চতা, প্রস্থ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম। কিন্তু যে বিষয়টা কমন তা হলো এর দূর্ভেদ্যতা।
আর এমন এক বিস্ময়কর ও ঐতিহাসিক স্থাপনা নিয়ে চীন গর্ব করতেই পারে।