শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:২৯ পূর্বাহ্ন

চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলে ২ দিন

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

সকাল ৮টা। মফস্বল শহরের চারপাশের চিত্রটা বদলাতে সময় লাগলো কেবল এক পায়ের মতো। খানিক আগেও একেবারেই ছিমছাম শহরটা এখন চায়ের রাজধানী। শ্রীমঙ্গল শহরের কলেজ রোড ধরে যখন এগুচ্ছি ভাড়াউড়া চা বাগানের দিকে, তখন চারপাশ বদলাতে ওইটুক সময়ই যথেষ্ট। আমার সঙ্গে ছিলেন শ্রীমঙ্গলের স্থানীয় এক তরুণ। তার মুখের মুচকি হাসি যেন বলতে চাইলো এ তো কেবল শুরু। 

এই স্থানীয় ব্যক্তিটি বর্তমানে প্রবাসী। ক্যাম্পাস জীবন থেকেই তার সঙ্গে দারুণ সখ্যতা। তিনি দেশে আসছেন, সেই সুবাদেই বললেন, শ্রীমঙ্গল যেতে। যাত্রার শুরুটা ওই আহ্বান থেকে। ঢাকা থেকে যাত্রা একাকী হলেও সেখানে আরও ৩ জন সঙ্গী জুটেছিল। দুজন সেখানকার। আর একজন যোগ দিয়েছিলেন কেবল শনিবারের ভ্রমণে।

ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের যাত্রা

আমার যাত্রা বৃহস্পতিবার। বিকেল ৩টায় ট্রেন ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে। একটা রেলস্টেশনের নাম কেন ‘বিমানবন্দর’ সেটা নিয়ে নিজ মনে রসিকতা করতে করতেই ট্রেন হাজির। আর সঙ্গে একঝাঁক মানুষের সঙ্গে লড়াই। ট্রেন ভ্রমণটা বেশ ভালোই লাগবে। ‘কালনী এক্সপ্রেস’ মাঝে কোনো বিরতি দিচ্ছে না, তাই যাত্রীর চাপ খানিক কম। ট্রেন যাত্রার জন্য তাই কালনী এক্সপ্রেস বেছে নিতে পারেন। আর বাসে হলে, মহাখালী থেকে এনা পরিবহনের বাস থাকবে আপনার অপেক্ষায়।

আদি নীলকণ্ঠ টি-কেবিনের পাশে

আজমপুরে কিছুটা সময়ের জন্য ট্রেন থাকবে। সম্ভব হলে এখানকার সিঙারা মুখে পুরে দেখতে পারেন। স্বাদ মন্দ তো নয়ই। বরং শ্রীমঙ্গল যাওয়া পর্যন্ত আপনার ক্ষুধাকে কিছুটা দমিয়ে রাখবে।

শ্রীমঙ্গলে খাবেন কী?

স্টেশনে নামার পরেই হোটেলের দিকে যাত্রা শুরু। পরের দুদিনের নিবাস ছিল কলেজ রোডের গ্রিন লিফ গেস্ট হাউজ। থাকার জায়গা নিয়ে খুব বেশি ভাবনা ছিল না। ট্যুরের ক্ষেত্রে আবাসন খরচ যতটা কমিয়ে রাখা যায় ততই ভালো। যেহেতু একা ট্যুর, তাই কিছুটা সাশ্রয়ী হতে পারলে তা আপনার পকেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখবে।

আর খাওয়া-দাওয়ার জন্য বেশ কিছু জায়গায় নির্ভর করতে পারেন। শ্রীমঙ্গল শহরের কলেজ রোড এবং গুহ রোডের সংযোগে ‘রসই ঘর’ রেস্টুরেন্টে খেতে পারেন। কিছুটা খরচা বেশি হতে পারে। তবে যদি গিয়েই থাকেন, বাঁশের ভেতরে রান্না করা মুরগি নিতে পারেন। একটু ভিন্ন স্বাদ পাবেন। আর সাধারণ খাবারের জন্য টি-ভ্যালি রেস্টুরেন্টইই বেশ ভালো।

চুমুক রেস্টুরেন্টের কথা আলাদা করে বলতে হচ্ছে। যদি শুটকির গন্ধ সহ্য করার মানসিকতা থাকে তবে এখানে স্পেশাল মুন্ডি খেয়ে দেখতে পারেন। পাহাড়ি এই খাবার নিশ্চিতভাবেই আপনাকে আলাদা একটা ফ্লেভার দেবে। এর বাইরে, এখানে চা খেয়ে তৃপ্ত হতে পারেন আপনি।

ভাড়াউড়া চা বাগানে লেখক

ভাড়াউড়া, শাপলা বিল এবং ট্রেন

এবার আসা যাক মূল আলাপে। হাতে সময় দুইদিন। কোথাও যাব আর কী দেখব– তা নিয়ে স্থানীয় সেই বড়বোনের সঙ্গে আলাপ হলো বেশ কিছুটা সময়। যেহেতু শহরের ভেতরেই অবস্থান, কলেজ রোড ধরে এগিয়ে চলে গেলাম ভাড়াউড়া চা বাগানের দিকে। একেবারেই সকালে যেতে পারলে এই চা বাগান আপনাকে ভিন্নরকমের এক সৌন্দর্য হয়ে ধরা দেবে। এখানে অবশ্য দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে চা বাগান। হাতের বামে গেলে দেখবেন শাপলা, আর ডানে গেলে পাবেন ট্রেন।

বাম পাশের বাগানের অংশে প্রবেশ করে চায়ের বাগান অনেকটা পথ পর্যন্ত। এরইমাঝে স্থানীয়দের কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছালাম শাপলা বিল পর্যন্ত। অবশ্য শীতকাল বলে সেই বিলের পানি অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে। তবে শাপলা আছে। গোলাপি রঙের শাপলা সকালের আলোতে অপূর্ব এক অনুভূতির জন্ম দেবে, এটুক বলা যেতে পারে।

ভোরের চা-বাগানে ব্যস্ততা

হাতের ডানের অংশে গিয়েছিলাম অন্য একদিন। রোববার সকালের সেই ভ্রমণের গল্পটাও বলা যাক। আমাদের শখ ছিল, পাহাড়ের মাঝে ছুটে আসা ট্রেন দেখার। সেই উদ্দেশ্যে রেললাইন ধরে হাঁটা শুরু। আমাদের কেবল জানা ছিল, নাগ মন্দির টিলা থেকে এই দৃশ্যটা ধরা দেবে দারুণভাবে। কিন্তু সেই মন্দির আমাদের চেনা নেই। একটার পর একটা টিলা পেরুচ্ছি, নিচে রেললাইনের দিকে তাকাচ্ছি। চোখ ভরলেও মন ভরেনি। এদিকে সময় এগুচ্ছে। সাড়ে ৮ টায় ট্রেন এই টিলা আর বনের মাঝ দিয়ে যাবে।

তিনটা টিলা পেরুনোর পর সিদ্ধান্ত নিলাম, আরও সামনে যাওয়া উচিত আমাদের। আগ্রহী পাঠকদের কেউ এই পথে হাঁটতে চাইলে সতর্ক থাকবেন, কারণ অনেকটা পথ জুড়েই রেললাইনের পাশে সরে যাওয়ার উপযুক্ত জায়গা নেই। কাজটা তাই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ট্রেন আসার কয়েক মিনিট আগেই নিরাপদে সরে যেতে হবে।

এরইমাঝে স্থানীয় দুজন শ্রমিক আমাদের মাঝপথে এসে জানালেন, আরও অনেকটা এগুলে দেখা যাবে নাগ মন্দিরটাকে। দূর্ভাগ্য এই, নির্দিষ্ট টিলায় ওঠার অল্পক্ষণ আগেই ট্রেন চলে এসেছিল। তবু যাত্রা শেষ করে নাগ মন্দির টিলায় যখন উঠেছি, তখন শ্রীমঙ্গলের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটাই আমার চোখের সামনে ধরা দিয়েছে। নিচে ঝিরির পানি বয়ে যাওয়ার পথ। একটা ছোট রেলসেতু। দুপাশে চায়ের বাগান। একটু পেছনে রাবার বাগান। মাঝে রেললাইন… ছবিটা নিচে দেয়া থাকলো।

আদি নীলকণ্ঠ টি-কেবিন

শ্রীমঙ্গল যাচ্ছেন, আর সাতরঙা চা খাওয়া হবে না… এটা মেনে নেয়া কিছুটা কষ্টের। নানা রঙের এই চা নিয়ে বহু মন্তব্যের পরেও সিদ্ধান্ত নিলাম, এটা না খেয়ে ওঠা যাবে না। শুক্রবার বিকেলে ব্যাপক ভিড়ের পরেও আমরা বসলাম চায়ের আসরে। তবে নীলকণ্ঠের এই আবেদন আসলে রাস্তার উল্টোপাশে।

সাধারণত চা-বাগানে প্রবেশ অধিকার সীমিত। পর্যটকদের বিভিন্ন আচরণের সুবাদে চা বাগান কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু জায়গায় চলাচল সীমিত করেছে। এরমাঝে আদি নীলকণ্ঠের বিপরীতে খানিকটা হেঁটে গেলে চা বাগানে একেবারেই সহজে প্রবেশ করা যায়। সেখানে বেশ অনেকটা সময় ছবি তুলে কিংবা কেবল প্রকৃতি দেখেই পার করা যায়। সূর্যাস্তের সময়টা এখানে অনেক বেশি মায়াবি।

ভাগ্য ভালো থাকলে কেউ হয়ত আপনাকে চা-পাতা বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে হাজির হবে। আবার আদি নীলকণ্ঠের ভেতরেও কিছুটা কেনাকাটা করার সুযোগ আপনি পাবেন।

লাউয়াছড়ায় লেখক এবং তার সঙ্গীরা

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও মাধবপুর লেক

শুক্রবার পুরো দিন পার হয়েছিল ভাড়াউড়া এবং শ্রীমঙ্গল শহর দেখে। সাধারণ মানুষের সহচর্য বরাবরই উপভোগ্য। বিভিন্ন জায়গায় চা খেয়ে, মানুষ দেখে দিব্যি পার করে দেয়া যায় সময়। এরইমাঝে শনিবারের যাত্রা লাউয়াছড়ার দিকে।

লাউয়াছড়া যাওয়ার সময়েই পুরো দিনের জন্য গাড়ি বা জিপ বুকিং করে নিতে পারেন। লাউয়াছড়ায় তিন রকমের ট্রেইল করা যেতে পারে। আমি সঙ্গে থাকা বাকিদের নিয়ে ছুটলাম সবচেয়ে বড় ট্রেইলের দিকে। রেললাইনের সামনে এসে অবশ্যই থামতে হলো। ‘Around the world in 80 days’ কিংবা ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রের শ্যুটিং হয়েছিল সেখানে। খানিক থামতেই হচ্ছে।

লাউয়াছড়ার পুরো যাত্রার পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল খাসিয়া পুঞ্জি পর্যন্ত যাওয়া। এরমাঝে একবার পথ ভুল করে গিয়েছিলাম পুরোপুরি উল্টোদিকে। তাতে লাভ হয়েছে বটে। দেখা মিলল একেবারেই গ্রামীণ পরিবেশের এক চা-দোকানের। এরপর উল্টোদিকে হেঁটে দুটো ঝিরিপথ পেরিয়ে, দুপাশের বনাঞ্চল দেখতে দেখতে পা রাখলাম খাসিয়া পুঞ্জিতে।

মাধবপুর লেক

মাঝে সুযোগ পেলে শ্রীমঙ্গলের আনারস খেয়ে দেখতে পারেন। আপনার লম্বা হাঁটার পথে এটা কিছুটা ক্ষুধা নিবারণের কাজ দেবে।

মাধবপুর লেকে গিয়ে কিছুটা হতাশ হতে হয়েছে। প্রথমত, জানুয়ারি মাসে পাতা অনেকটাই ছেঁটে ফেলা হয়েছে। আবার শীতকাল থাকায় লেকের পানিতেও সেই পূর্ণ রূপ দেখা যায়নি। যদি বর্ষাকালে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে অবশ্য দারুণ সৌন্দর্য্য দেখা যাবে এখানে। তবু এই মাধবপুর গিয়েই এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হলো। আর সেটা এই ভ্রমণকাহিনী লেখার মূল কারণ।

একজন চা শ্রমিক এবং একটি প্রতিশ্রুতি

পুরো যাত্রায় আমার সঙ্গী ছিল নিজের ক্যামেরা এবং ব্যাগ। সেই ক্যামেরার সুবাদেই কথা বলার সৌভাগ্য হলো তিন চা-শ্রমিকের সঙ্গে। নিখুঁত সিলেটি টানে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবু তুই কী করিস? আমি সহজভাবেই বলতে চেয়েছি, ‘আমি খবরের মানুষ।’

পরের মুহূর্তেই তিনি খুলে বসেছেন কথার ডালি। দিনের আলো ফোটার পরেই লিকার চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে একটা লম্বা দিনের শুরু করেছেন তারা। কাঁধের ঝোলায় ২৩ কেজি চাপাতা তুলতে হবে, কিংবা ৮০০ গাছ ছাঁটাই করতে হবে পুরো দিনে। এর বিনিময়ে তাদের বেতন হবে ১৭০ টাকার। বর্তমান সমাজে এই ১৭০ টাকায় কী হতে পারে তার আলাপ অর্থনীতির পাঠ্য হতে পারে।

কিছুটা হতাশ হয়েই জানালেন, চলতি মাসের শেষদিকেই সন্তানের স্কুলে ভর্তির টাকা দিতে হবে। কিন্তু সেই ভর্তি ফি তার হাতে নেই। নেই পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা। একরাশ অভিযোগের পর বললেন, ‘বাবু আমাদের বেতন যেন একটু বাড়ায় সেই কথা লিখিস। আমরা আর কিছু চাই না, শুধু বেতন একটু বাড়ালেই হবে।’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তাদের কথা অন্তত একবার লিখে রাখব।

চা শ্রমিকদের সঙ্গে

মহেশ গল্পে অপরাজেয় কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোয়াধ্যায় লিখেছিলেন, ‘অত ক্ষীণকণ্ঠ অতবড় কানে গিয়া পৌঁছায় না’। সাধারণ একটা ভ্রমণগল্পে চা শ্রমিকের বেতনবৈষম্যটাও হয়ত তেমনই। তবু প্রতিশ্রতি রক্ষা করা হলো ভেবেই তৃপ্তি।

বিদায়ের আগে জানিয়েছিলেন, এর আগে আন্দোলন করে ৪ সপ্তাহ কাজ করেননি তারা। পরবর্তীতে কাজে ফিরলেও সেই ৪ সপ্তাহের বেতন পাওয়া হয়নি আর।

শ্রীমঙ্গল যাত্রায় যা কিছু মনে রাখবেন

  • কাঁধের ব্যাগের ওজন যতটা পারবেন হালকা রাখবেন। হাঁটার পথে কাজে দেবে।
  • অবশ্যই পানি রাখবেন সঙ্গে।
  • ভ্রমণের সেরা সময় বর্ষাকাল কিংবা ডিসেম্বর মাস। সময় বিবেচনায় কেডস পায়ে রাখবেন।
  • যত্রতত্র আবর্জনা ফেলবেন না। একটি পর্যটন নগরীর সৌন্দর্য রক্ষার মূল দায়িত্ব পর্যটকদেরই।
  • নিজের আগ্রহের জন্য চা-বাগান এবং চা-শ্রমিকদের ব্যক্তিগত নিয়ম না ভাঙাই উত্তম।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com