বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে পাহাড় আর মেঘের অসাধারণ মেলবন্ধন যেখানে, তার নাম সাজেক ভ্যালি। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত, যা ভ্রমণপিপাসুদের স্বপ্নের ঠিকানা হয়ে উঠেছে। শহরের ব্যস্ততা, ধুলোবালি আর কোলাহল থেকে কিছুটা দূরে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে চাইলে সাজেকের তুলনা নেই।
সাজেক ভ্যালি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১,৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। মজার বিষয় হলো, যদিও এটি প্রশাসনিকভাবে রাঙ্গামাটির অন্তর্ভুক্ত। তবে সেখানে পৌঁছতে হয় খাগড়াছড়ির দীঘিনালা হয়ে। রাস্তা ধরে সাজেকের দিকে যেতে যেতে মনে হবে পাহাড়ের বুকে আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চলেছেন কোনো রহস্যময় রাজ্যের দিকে। পথিমধ্যে ‘হাওরাচড়া ঝরনা’ ও ‘দীঘিনালা সেনানিবাস’ চোখে পড়ে। যা ভ্রমণের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে।
সাজেকে প্রবেশের পরই মেঘের রাজ্য আপনাকে স্বাগত জানাবে। সকাল-সন্ধ্যা পাহাড়ের কোলঘেঁষে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। কখনো পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আপনি নিচের মেঘের ঢেউ দেখতে পাবেন। কখনোবা মনে হবে মেঘের মাঝে ডুবে আছেন। রুইলুই পাড়া এবং কংলাক পাড়া—দুই পাহাড়ি গ্রাম সাজেকের হৃদয়। এখানে বসবাস করে লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা আদিবাসী সম্প্রদায়। যারা সরল জীবন আর অতিথিপরায়ণ মনোভাব দিয়ে পর্যটকদের মন জয় করে নেয়।
সাজেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই আলাদা সৌন্দর্য বহন করে। ভোরবেলা ‘হেলিপ্যাড’ এলাকায় দাঁড়িয়ে সূর্য ওঠার দৃশ্য যেন এক অনন্য অভিজ্ঞতা। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা সাদা মেঘের মাঝে লাল-কমলা রঙে রাঙানো সূর্য যখন উদিত হয়, তখন মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। অপরদিকে বিকেলে কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় বসে সূর্যাস্ত দেখার অনুভূতিও চিরস্মরণীয়।
খাবারের দিক থেকেও সাজেক ভ্রমণ স্মরণীয় হয়ে থাকে। এখানে পাওয়া যায় পাহাড়ি মোরগের ঝাল ঝাল ঝোল, স্থানীয় সবজি এবং বাঁশের ভেতরে রান্না করা ভাত। ছোট ছোট রেস্টুরেন্টগুলোতে আদিবাসী খাবারের স্বাদ নিতে পারেন। কেউ চাইলে আগুন জ্বালিয়ে রাতে বারবিকিউ পার্টির আয়োজনও করতে পারেন। যা সাজেকের হিমেল রাতে অন্যরকম আনন্দ দেয়।
থাকার ব্যবস্থাও এখানে এখন অনেক উন্নত হয়েছে। রুইলুই পাড়ায় বেশ কিছু রিসোর্ট ও কটেজ গড়ে উঠেছে। বাঁশ আর কাঠের তৈরি বাড়িগুলো সাজেকের পরিবেশের সাথে মানানসই। সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু রিসোর্ট হলো রুনময় রিসোর্ট, সাজেক রিসোর্ট, মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট। যারা একটু কম বাজেটে থাকতে চান, তাদের জন্য হোমস্টের সুবিধাও আছে।
সাজেক ঘুরতে গেলে কেবল প্রকৃতি নয়, মানুষের আন্তরিকতাও মনে দাগ কেটে যায়। এখানকার মানুষগুলো নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তাদের জীবনধারা, পোশাক, ভাষা সব কিছুতেই একটা নিজস্বতার ছাপ রয়েছে। তবে সাজেকে ভ্রমণের সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখা উচিত। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক তুলনামূলক দুর্বল। তাই আগেভাগে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করে নেওয়া ভালো। পানি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সাথে রাখা উচিত। কারণ অনেক জায়গায় দোকান সহজে পাওয়া যায় না।
শেষ কথা হলো, সাজেক কোনো কোলাহলের ভ্রমণ গন্তব্য নয়। এটি প্রকৃতির সাথে নিজেকে একাকার করে দেওয়ার জায়গা। গ্রীষ্মের খরতাপে ক্লান্ত প্রাণ যদি কিছু শান্তির খোঁজ করে। তবে সাজেক ভ্যালির মেঘের মাঝে হারিয়ে যাওয়াই হতে পারে জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা।
তাই মে মাসের প্রথম তিনদিনের সরকারি ছুটিতে ঘুরে আসুন সাজেক ভ্যালিতে। যারা ঢাকা থেকে সাজেক ভ্যালি যেতে চান; তারা ট্রাভেল গ্রুপের সাথে খুব কম খরচেই যেতে পারেন। ফেসবুকে ট্রাভেল গ্রুপ বিডি লিখলেই চলে আসবে বেশকিছু বিশ্বস্ত পেজ বা গ্রুপ। তিন রাত দুই দিনে জনপ্রতি খরচ পড়বে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ টাকা। গ্রুপভেদে ও একদিনের ট্যুরে খরচে কিছুটা তারতম্য হতে পারে।