পুব আকাশে ভোরের সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে লাল রঙে ছেয়ে যায় চারপাশ। প্রথমে দেখলে মনে হবে হাওরের বুকে বিস্তীর্ণ এলাকায় লালগালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে। একপাশে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, অন্যপাশে শাপলা ফুলের লালগালিচা। সেইসঙ্গে সকালের শিশিরভেজা মিষ্টি রোদ, শাপলা ফুলের সুমিষ্ট গন্ধ।
এই দৃশ্য সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বড়দল ইউনিয়নের কাশতাল গ্রামের পাশেই বিকিবিলের। হাওরের বুকে লাখ লাখ লাল শাপলার সুধা পান করতে ছুটে আসছেন ভ্রমণপিপাসুরা। তবে এই দৃশ্য শুধু বিকিবিল হাওরে নয়, সুনামগঞ্জের প্রায় হাওরের দৃশ্যই এখন এমন।
তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওর, শহীদ সিরাজ বা নীলাদ্রি লেক ও শিমুল বাগানের সৌন্দর্য দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে অনেক আগে। এ বছর সেই সৌন্দর্যে যোগ হয়েছে শিমুল বাগানের পাশে বিকিবিল হাওরের শাপলা বিল। গোটা এলাকাজুড়ে এখন লাল শাপলার অপরূপ দৃশ্য ফুটে উঠেছে। বর্ষার শুরুতেই এখানে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশিরভেজা রোদ মাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়বে শাপলার বাহারি রূপ, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রাতে ফোটা শাপলা সূর্যোদয় থেকে সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত লাল শাপলার সৌন্দর্য দেখা যায়। পরে আবার ফুল মুজে যায়। আর এর সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন অনেক পর্যটক পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসছেন বিকিবিলের শাপলার হাওরে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাহিরপুর উপজেলার বিকিবিলে প্রায় দুই হাজার একর জায়গাজুড়ে শুধু শাপলার বিলকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে পর্যটকরা বলছেন, সুনামগঞ্জের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত করা গেলে আরো বেশি পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। টাঙ্গুয়ার হাওর ও শিমুল বাগানের মতো এ লাল শাপলার বিকিবিলও হয়ে উঠতে পারে পর্যটনে সম্ভাবনাময় একটি জায়গা।
বিকিবিলের শাপলা দেখতে আসা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আক্তার জাহান সাথী জানান, সুনামগঞ্জ অপরূপ সৌন্দর্যের অপার সম্ভাবনার এক জেলা। এই জেলা একের ভেতর ১০। সুনামগঞ্জে এলে একসঙ্গে অনেক কিছু দেখা যায়। একই সঙ্গে হাওর, হিজল-করচ গাছ, সবুজ ধানক্ষেত, মাছ, পাহাড়, পাখি সবই আছে। সেইসঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে শাপলার বিল। এই বিল অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু পর্যটকদের কাছে অজানা ছিল। স্থানীয় প্রশাসন সাংবাদিকদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আবিষ্কার’ করে পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছে। যে কেউ একনজর দেখে গেলে মন ভরে যাবে।
বিকিবিলের শাপলার লাল বাগিচা দেখে কামরুজ্জামান কামরুল নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ‘অসাধারণ, ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এত সুন্দর। প্রকৃতি লালে লাল হয়ে আছে। মনটাই ভালো হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে গেছি। আবার পরিবার নিয়ে যাব।’
আরেক দর্শনার্থী নাসরীন আক্তার বলেন, ‘আমরা খবর পেলাম শহরের পাশেই একটা শাপলার বিল আছে। তাই খুব ভোরে উঠে আসি। শাপলার বিল দেখে মনটাই ভরে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি অনেক জায়গায় গেছি। কিন্তু এই শাপলার বিল অনেক বড়, বিস্তৃত, অনেক সুন্দর। আর পুরো বিলে হাজার হাজার লাখ লাখ শাপলা ফুটে আছে। চমৎকার দৃশ্য। যদিও ভোরের আলো ফোটার পরে খুব অল্প সময় ফুলগুলো ফুটে থাকে। কিন্তু ওই সামান্য সময়ও আজীবন মনে ধরে রাখার মতো।’
তবে বেশির ভাগ দর্শনার্থী অভিযোগ করে বলেন, সুনামগঞ্জ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গ হলেও এখানে আসতে অনেক কষ্ট হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। খুব দুর্গম।
জামসেদুল করীম নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ‘এক জায়গায় একসঙ্গে পাহাড়-হাওর, পানি, মাছ, শাপলার বিল। সব মিলে অসাধারণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত নয়। মানুষের আসতে অনেক কষ্ট হয়। সেইসঙ্গে জেলার কোথাও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার জায়গা নেই। যদি এই কিছু সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায়, তা হলে সুনামগঞ্জের প্রতি মানুষের আরো আগ্রহ বাড়বে।’
বাদাঘাট কলেজের সহকারী শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু বিকিবিল নয়, তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বেশ কিছু হাওর আছে, যেখানে লাখ লাখ শাপলা ফুল ফুটে থাকে। গত বছর মানুষ বিকিবিলের সন্ধান পেয়েছে। এ বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ প্রতিদিনই আসছে।’
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ বলেন, ‘সুনামগঞ্জ জেলা অন্যান্য জেলা থেকে একটু আলাদা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুনামগঞ্জকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে কোনো হয়রানি ছাড়া ঘুরে যেতে পারেন, সে জন্য উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে বিকিবিলকে পর্যটন জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমি নিজেও আমার প্রশাসনের লোকজন নিয়ে বিকিবিল ভ্রমণ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে এই বিলকে দেশ-বিদেশে পরিচিত করতে কাজ করছি। আগামী এক মাস পর্যন্ত এই সৌন্দর্য দেখা যাবে।’
বিকিবিলে যাওয়ার উপায় ও খরচ :
ঢাকার সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে যেতে হবে সুনামগঞ্জ শহর। ভাড়া ৫৫০ টাকা। শহর থেকে সরাসরি মোটরসাইকেলে করে যেতে হবে তাহিরপুরের বাদাঘাট বিকিবিলের হাওর। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১২০ টাকা। প্রতি মোটরসাইকেলে দুজন যাত্রী ওঠানো হয়। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ শহর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ভেঙে ভেঙে বিকিবিল যাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে প্রথমে যেতে হবে তাহিরপুরের মিয়ারচর বাজারে। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৭০ টাকা। এরপর পাঁচ টাকা দিয়ে খেয়া পার হতে হবে। যাদুকাটা নদী পার হওয়ার পর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা মোটরসাইকেল নিয়ে বিকিবিল যাওয়া যায়। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২৫ টাকা। এরপর বিল ঘুরে দেখার জন্য নৌকাভাড়া নিতে হবে। ঘণ্টাপ্রতি ভাড়া পড়বে ১০০ থেকে ২০০ টাকা।