তাহলে বন্ধুরা চলুন, গ্রিস সম্পর্কে আরো কিছু জানা-অজানা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
১। বর্তমান গ্রিকদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে এক সময়ের পৃথিবী বিজয়ী প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা, বাইজান্টাইন সম্রাজ্য এবং প্রায় ৪ শতাব্দীর অটোমান সম্রাজ্য। এই দেশ পশ্চিমা বিশ্বের জ্ঞান বিজ্ঞানের সূতিকাগার এবং গণতন্ত্রের জন্মদায়ক স্থান হিসেবে সুপরিচিত। গ্রিসের আরও কিছু বৃহৎ অবদান হচ্ছে পশ্চিমা দর্শন, অলিম্পিক গেম্স, পশ্চিমা সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং নাটক। সব মিলিয়ে গ্রিসের সভ্যতা সমগ্র ইউরোপে এক সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী সভ্যতা হিসেবে পরিগণিত হত। বর্তমানে গ্রিস একটি উন্নত দেশ এবং ১৯৮১ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য।
২। ১ লাখ ৩১ হাজার ৯৫৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ মানুষের বসবাস।
৩। দেশটির সরকারী ভাষা হচ্ছে “গ্রিক”। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম লিখিত ভাষা। ভাষাটি প্রায় ৫০০০ বছরেরও বেশি পুরনো।
৪। দেশটির শতকরা প্রায় ৯৩ ভাগ মানুষ খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নয় এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ শতাংশ। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ২ শতাংশ।
৫। প্রশাসনিকভাবে গ্রিসে মোট ১৩ টি প্রশাসনিক অঞ্চল রয়েছে। এরা আবার সর্বমোট ৫৪টি আলাদা আলাদা অঞ্চলে বিভক্ত।
৬। গ্রিসের রাজধানী এবং সর্ববৃহৎ শহর হচ্ছে এথেন্স। এথেন্স একইসাথে বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে অন্যতম। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানব সভ্যতার নিদর্শন এথেন্স শহরের সর্বত্র জুড়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভ্রমন পিপাসুদেরও কাঙ্ক্ষিত দর্শনীয় স্থান এ নগরী। গ্রিসের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের উপর বাস করেন এথেন্সে এবং তাঁদের বেশির ভাগই থাকেন অ্যাপার্টমেন্টে। শহরের প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় দেখা যায় ফুল, লতাপাতার বাহার!
৭। যেমনটি বললাম, এথেন্স গ্রিসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর সেই প্রাগৌতিহাসিক কাল থেকেই। আর এথেন্সের মূল আকর্ষণগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম শহর অ্যাক্রোপোলিস অন্যতম। অ্যাক্রোপোলিস এর কথা যখন উঠলোই তখন এর সম্পর্কে বিস্তারিত না বললে অন্যায় করা হবে। গ্রিসের স্বর্নালী যুগের অন্যতম ধারক ও বাহক অ্যাক্রোপোলিস শহরটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে মনোরঞ্জন করে চলেছে পর্যটকের।
একটি চুন-পাথরের পাহাড়ের উপর নির্মিত এথেন্স তথা গ্রিসের প্রাচীনতম শহরকেই বলা হয় অ্যাক্রোপোলিস। যেখানে রয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়, নগরদূর্গসহ তৎকালীন রাজার বাসস্থান। একে প্রাচীন গ্রিসের দেব-দেবতার বাসস্থান বললেও অত্যুক্তি হবে না। এখানকার মূল উপাসনালয়টি দেবী এথেনাকে উৎসর্গ করে বানানো হয়। এ ছাড়াও রয়েছে অনেক ছোট ছোট উপাসনালয়ের ধ্বংসাবশেষ।
অ্যাক্রোপোলিসের উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৬০০ ফুট এবং আয়তন ৩০ হাজার ৫০০ বর্গমিটার। অ্যাক্রোপোলিসের নির্মাণ কাজ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭ অব্দে।
৮। এই অ্যাক্রোপোলিস শহরে আবার আছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ পার্থেনন মন্দির। ইউনেস্কো পার্থেননকে ‘ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। তবে পার্থেনন নিয়ে গবেষণা এখনো চলছে। গবেষকদের ধারণা এই মন্দির বানাতে ২২ হাজার টন মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। বিশাল দৈত্য আকৃতির ৫৮টি পিলারগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৩ হাজার মার্বেলের টুকরো, ভূমিকম্পেও যেগুলোর নড়চড় হবে না। মন্দিরের পিলারের উপরের কারুকাজ করা এক একটি মার্বেলের ওজন ১০ টন। ‘ডরিক’ শৈলীতে তৈরি ৩১ মিটার চওড়া, ৭০ মিটার লম্বা এবং ২০ মিটার উঁচু এই বিশাল মন্দির পুরোটাই মার্বেলের। মন্দিরের মাঝখানে ছিল হাতির দাঁত, মূল্যবান কাঠ এবং স্বর্ণ নির্মিত ১২ মিটার উঁচু এথেনা দেবীর মূর্তি। তবে সে মূর্তি এখন নেই।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে গ্রিস বিভিন্ন বিদেশি রাজ্যের অধীনে ছিল। তাই পার্থেনন কখনও গির্জা, কখনও মসজিদ আবার কখনো দুর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
৯। বারবার যখন দেবি এথেনার নাম চলে আসছে তখন চলুন তার সম্পর্কেও কিছুটা জেনে নেয়।
প্রাচীন গ্রিক ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে এথেনা হচ্ছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বীরত্ব, শক্তি, যুদ্ধ, জ্ঞান ও শহরের দেবী। কথিত আছে দেবতা জিউসের মাথা থেকে এথেনার জন্ম এবং জন্মের সময়ই এথেনা ছিলেন যুদ্ধবর্ম পরিহিতা প্রাপ্তবয়স্ক তরুণী। তার কোনো মা নেই। জিউসের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান এথেনা। হোমার ‘ইলিয়ডে’ এথেনাকে দেখিয়েছেন একজন বীরযোদ্ধা হিসেবে।
১০। পার্থেনন দেখে পাহাড় থেকে নামবার সময় চোখে পড়বে দু’টি প্রাচীন থিয়েটার— ডাইওনিসাস ও হেরোডিয়ন। ২৪০০ বছরের পুরনো ডাইওনিসাস থিয়েটারের বিশাল ধ্বংসাবশেষ দেখে অবাক হতেই হয়। এখানে ১৬ হাজার দর্শকাসন আছে। প্রাচীন গ্রিসে নাটকের খুব চল ছিল। সে সময়ের বেশির ভাগ গ্রিক নাটকই ছিল বিয়োগাত্মক। ইউরিপিডিস, সফোক্লিস, আরিস্টোফেনিস প্রভূতরা ছিলেন গ্রিসের বিখ্যাত নাট্যকার। ১৮০০ বছরের পুরনো ‘আউটডোর থিয়েটার’ হেরোডিয়নে ১২০০ দর্শকাসন আছে।
১১। গ্রিসকে পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্মভূমি বলে মনে করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গণতন্ত্রের জন্ম দেশটির বর্তমান রাজধানী এথেন্সেই।
১২। এই দেশেই যুগে যুগে অনেক দার্শনিক ও চিন্তাবিদ জন্মেছিলেন। তাদের মধ্যে সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের নাম উল্লেখযোগ্য— যাঁরা রাজনীতি ও দর্শনে পাশ্চাত্য সভ্যতার উপর গভীর ছাপ রেখে গেছেন। প্লেটোর লেখা বই ‘রিপাবলিক’ এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে সারা পৃথিবী জুড়ে পড়া হয়।
১৩। আধুনিক অলিম্পিক গেমসের জন্মস্থান কিন্তু এই গ্রিস। ১৮৯৬ সালে প্রথম আধুনিক অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয় এথেন্সের ‘পান-এথেনাইকো’ স্টেডিয়ামে, মাত্র ১৪ টি দেশকে নিয়ে। ১০৮ বছর পর আবার অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় গ্রিসে, ২০০৪ সালে। তবে সে বার যোগ দিয়েছিল প্রায় ২০০টি দেশ।
১৪। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০০ এরও বেশি দ্বীপ আছে গ্রিসে। তার মধ্যে মাত্র ১৭০ টিতে জনবসতি আছে। বেশ কিছু দ্বীপ পর্যটকদের ভিড়ে জমজমাট। তাদের মধ্যে মিকনস এবং রোডস দ্বীপের সমুদ্রতট খুব বিখ্যাত।
১৫। প্রাচীন কাল থেকেই গ্রিকরা সমুদ্র-পটু। এখনও তারা নৌ-বাণিজ্যে এগিয়ে। গ্রিসের ওনাসিস এবং নিয়ারকোস জাহাজ দুনিয়ায় দুই কিংবদন্তী নাম।
১৬। গ্রিক সঙ্গীতের প্রধান বাদ্যযন্ত্রের নাম ‘বুজুকি’, যা খানিকটা ম্যান্ডোলিনের মতো দেখতে, এটি তিন বা চার তারের যন্ত্র, তবে এর স্বর অনেকটাই গিটারের মতো।
১৭। গ্রিক খাদ্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং অত্যন্ত সুস্বাদু।
১৮। গ্রীষ্মকালে দেশটিতে পর্যটকের সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়।
১৯। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এবং নেতাদের মধ্যে একজন। তিনি কিন্তু একজন গ্রিক ছিলেন।
২০। ফুটবল গ্রীসের জাতীয় খেলা।
২১। গ্রিসের অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটন নির্ভর।
২২। গ্রিসের সরকারী মুদ্রা ইউরো।
২৩। দেশটির মোট জিডিপি প্রায় ২২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবং মাথাপিছু আয় প্রায় ২১ হাজার মার্কিন ডলার।
২৪। গ্রিসের ডায়ালিং কোড হচ্ছে +৩০।