শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন

গোল্ডেন ভিসা ও পুঁজি পাচারের মানিকজোড়ে যারা মার খায়

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০২৩

এ ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে অগ্রগামী হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে দুবাইয়ে রেকর্ডসংখ্যক জমি-বাড়ি বেচাকেনা হয়েছে। দেশটির সরকারি নথি অনুসারে, গত বছর দুবাইয়ে মোট ৯০ হাজার ৮৮১টি জমি ও বাড়ি কেনাবেচা হয়েছে। দেশটিতে এক কোটি দিরহাম বিনিয়োগ করা হলে গোল্ডেন ভিসা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের মানুষও পিছিয়ে নেই। দুবাইয়ের সরকারি নথিপত্র ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশিরা দুবাইয়ে ১২ কোটি ২৩ লাখ দিরহাম বা ৩৫৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনেছেন।

সম্প্রতি দুবাইয়ে বসবাসরত এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এক দুবাই শহরে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন প্রায় ৩০টি রিয়েল এস্টেট এজেন্সি আছে। এরা মূলত বাংলাদেশিদেরই বাড়ি কেনায় সহযোগিতা করে থাকে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য বড় শহরেও এমন অনেক এজেন্সি আছে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে এ দেশের কত মানুষ বাড়ি-জমি কিনছেন, তার ইয়ত্তা নেই। আর এসব অর্থ যে অবৈধভাবে নেওয়া হয়, তা বলাই বাহুল্য।

এ ছাড়া কানাডার বেগমপাড়া ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের অনেক নাগরিক বাড়ি কিনেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে এ বিষয়ক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।

অন্য দেশে এভাবে পাড়ি জমানোর ক্ষেত্রে চীনারা সবচেয়ে এগিয়ে। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের হাত থেকে বাঁচতে চীনারা দেশ ছাড়ছেন। আবার অনেক দেশের মানুষ স্রেফ উন্নত জীবনের আশায় বা সন্তানদের ভালো শিক্ষা নিশ্চিত করতে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এই স্কিমের আওতায় গ্রহীতা দেশগুলো মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ পাচ্ছে। অবশ্যই তা গোপন রাখা হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি আয়ারল্যান্ড ও পর্তুগাল গোল্ডেন ভিসা বন্ধ করে দেওয়ায় বোঝা যাচ্ছে, এসব ভিসা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে; বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে।

যে আকাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগের কারণে দেশগুলো গোল্ডেন ভিসা দিচ্ছে, সেই বিনিয়োগ অনেক ক্ষেত্রে সমস্যাজনক হয়ে ওঠে। অধিকাংশ দেশে সম্পদ ক্রয় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এতে স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। পর্তুগাল গোল্ডেন ভিসা বাতিল করেছে আবাসন–সংকটের কারণে। বিদেশিরা বাড়ি কেনায় সেখানে বাড়ির দাম ও ভাড়া আকাশ ছুঁয়েছে। স্থানীয়দের নাগালের বাইরে চলে গেছে আবাসন।

পাঁচ্র লাখ ইউরো বা ৫ লাখ ৩৪ হাজার ডলার বিনিয়োগ বা সমমূল্যের আবাসন ক্রয়ের শর্তে পর্তুগাল গোল্ডেন ভিসা দিয়েছে। আবার যেসব স্থানে জনবসতি কম বা সেখানে এর চেয়ে কম অর্থ বিনিয়োগ করলেও এই ভিসা দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় গত কয়েক বছরে পর্তুগালে ৬০০ কোটি ইউরো বিনিয়োগ হয়েছে। এর বিনিময়ে তারা পাঁচ বছর বসবাসের ভিসা দিয়েছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পর্তুগাল শেনঝেন ভিসারও অংশীদার। এতে গোল্ডেন ভিসা পাওয়া মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বিনা বাধায় ঘোরাফেরা করতে পারেন। তার পাঁচ বছর পর স্থায়ী বসবাস ও নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন। সেটা পেলে ইউনিয়নভুক্ত যেকোনো দেশে বসবাস ও কাজ করা যায়। এখানেই বিপত্তি। যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার এটি অন্যতম কারণ।

ইদানীং ইউরোপীয় কমিশন, কাউন্সিল অব ইউরোপ ও ধনী দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি অভিবাসীদের এই অর্থের উৎস নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। তাদের উদ্বেগ, উন্নয়নশীল দেশের মানুষেরা অর্থ পাচার বা কর ফাঁকির মাধ্যম হিসেবে এই গোল্ডেন ভিসা ব্যবহার করছে। এতে নানা ধরনের জালিয়াতির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালে চীনা নাগরিকেরা গ্রিসে এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এক গ্রিক ডেভেলপার বাজারমূল্যে জমি কিনে সম্ভাব্য চীনা অভিবাসীদের কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন। সেই অর্থের একাংশ আবার চীনা বিনিয়োগকারীদের কমিশন হিসেবে দেয় সেই ডেভেলপার—এমন ঘটনাও দেখা গেছে।

উন্নয়নশীল দেশের বিপদ
উন্নয়নশীল ও কর্তৃত্বপরায়ণ জমানার দেশগুলো থেকে অর্থ পাচার হয় বেশি। কর ফাঁকি দিতেও অনেকে এমন জায়গায় অর্থ পাচার করেন, যেখানে করহার কম। এসবই একরকম পাচার। এতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো অতিপ্রয়োজনীয় রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। জনগণের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারে না তারা। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে, সে জন্য জিডিপির অনুপাতে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণও খুব কম।

সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পুঁজি পাচারের কারণে অর্থনীতিতে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মত, দেশ থেকে যে হারে পুঁজি পাচার হচ্ছে, সে তুলনায় আইএমএফের ঋণের অর্থ তেমন কিছুই না।

তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যাঁর হাতে অর্থ আছে, তাঁকে যদি রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে না পারে যে তাঁর সম্পত্তি ও উত্তরসূরিরা এ দেশে নিরাপদ, তাহলে অর্থ পাচার ঠেকানো কঠিন। এক পদ্ধতি দিয়ে তাদের আটকানো হলে তারা অন্য পদ্ধতিতে পাচার করবে। মানুষ যেখানে নিরাপদ বোধ করবে, সেখানেই যাবে।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আশাবাদী করে তোলা এবং উচ্চবর্গের মানুষকে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত করা জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা। যে দেশে বিচারব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করে না, আইনি কাঠামো কোনো চুক্তি কার্যকর করতে পারে না, সেই দেশে শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিয়ে টাকা পাচার আটকানো যাবে না। বিষয়টি বহুমাত্রিক।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com