তথাকথিত ‘গোল্ডেন ভিসা’ ব্যবস্থা বাতিল করার কথা ভাবছে স্পেন। বড় অংকের আর্থিক বিনিয়োগের বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের নাগরিকদের দ্রুততম সময়ে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার একটি মাধ্যম ছিল এই গোল্ডেন ভিসা।
বেশ কিছু দেশ এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, যাতে এবার যোগ দিল স্পেনও।
“নিছক ব্যবসায়িক দিক থেকে চিন্তা না করে আবাসনের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে” এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেন, “আবাসন খাত প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে। আর যারা এদেশে থাকেন ও কাজ করেন তাদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছে”।
অনেক বিনিয়োগকারী এই স্কিম বা ব্যবস্থাকে অন্য কোনও জায়গায় নতুন জীবন শুরু করার কিংবা নিজ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক ঝুঁকি থেকে বাঁচার সুযোগ হিসেবে দেখেন।
কিন্তু অপরাধীরা নিজেদের স্বার্থে এই ব্যবস্থার অপব্যবহার করলে আবাসন খাতের দাম বেড়ে তা স্থানীয়দের সামর্থের বাইরে চলে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন দুর্নীতিবিরোধী প্রচারক ও রাজনীতিবিদরা।
বড় বিনিয়োগের বিনিময়ে ধনী ব্যক্তিদের অন্য দেশে বসবাস এবং কাজ করার অধিকার দেয় ‘গোল্ডেন ভিসা’।
একটি গোল্ডেন ভিসা পাওয়ার জন্য পানামার আবাসন খাতে এক লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে হয় কিংবা ২ কোটি ১৪ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ লুক্সেমবার্গের কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত আকারে জমা রাখতে হয়।
আর তারপরই পাওয়া যায় ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’, যার মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা একটি দেশে আবেদন করে সেখানে কাজ করার এবং ভোট দেওয়ার সুযোগ-সহ নাগরিক হিসেবে সব ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা লাভ করেন।
প্রায় ৬০টি দেশ গোল্ডেন ভিসা দিচ্ছে বলে বিবিসিকে জানান লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক এবং ‘দ্য গোল্ডেন পাসপোর্ট: গ্লোবাল মোবিলিটি ফর মিলিয়নেয়ার’ বইয়ের লেখক ড. ক্রিস্টিন সুরাক।
প্রায় ২০টি দেশ বিনিয়োগের মাধ্যমে আইনি বিধান-সহ নাগরিকত্ব দেয় আর এর মধ্যে অর্ধেক দেশে প্রতি বছর ১০০টিরও বেশি আবেদন পায়, জানান তিনি।
“নাগরিকত্বের সবচেয়ে বড় বিক্রেতা তুরস্ক,” বলেন ড. সুরাক।
তার গবেষণার তথ্যমতে, গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিমে বিশ্বব্যাপী বার্ষিক নাগরিকত্ব বিক্রির প্রায় অর্ধেকই তুরস্কের।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ কর্মসূচির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বসবাসের সুযোগ দেয়া হয় বৈশ্বিক দক্ষিণে (গ্লোবাল সাউথ), বিশেষ করে মালয়েশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোতে।
গোল্ডেন পাসপোর্টের প্রধান ইস্যুকারীদের মধ্যে আরও রয়েছে সেন্ট কিটস, ডোমিনিকা, ভানুয়াতু, গ্রেনাডা, অ্যান্টিগুয়া এবং মাল্টা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গোল্ডেন ভিসাপ্রার্থীদের জন্য সবচেয়ে কাঙ্খিত গন্তব্যগুলোর একটি।
কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনও একটি সদস্য দেশে বসবাস এবং কাজ করার অধিকার পেলে শেনগেন-ভুক্ত দেশগুলোতে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণের অনুমতি পাওয়া যায়৷
উল্লেখ্য, শেনগেন দেশ বলতে ২৯টি ইউরোপীয় দেশকে বোঝায় যারা আনুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বাতিল করেছে।
২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৪টি দেশ গোল্ডেন ভিসা দিয়েছে।
এর মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি অনুমোদন দিয়েছে গ্রীস, লাটভিয়া, পর্তুগাল আর স্পেন। তবে এই দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই এই স্কিম সীমিত করার দিকে এগোচ্ছে।
ধনী বিদেশী নাগরিকরা সম্পদ আনলে তাদের দেশে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার একটি প্রকল্প ২০২২ সালে শেষ করে দেয় যুক্তরাজ্য সরকার।
পরের বছর আয়ারল্যান্ড দেশটির গোল্ডেন ভিসা ব্যবস্থা বাতিল করে। তবে পর্তুগাল বাতিল না করলেও এতে নিজস্ব কিছু পরিবর্তন আনে।
সম্পত্তি ক্রয়ের বিনিময়ে বসবাসের অনুমতি না দিলেও তহবিল এবং গবেষণা কার্যক্রমের জন্য মূলধন স্থানান্তর ও বিনিয়োগের মাধ্যমে এই চর্চা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখে দেশটি।
ভালো ব্যবসার সুযোগ, জীবনধারা, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য সেবা খোঁজা ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে গোল্ডেন ভিসা ও পাসপোর্ট বেশ জনপ্রিয়।
“আজকের বিশ্বে সমস্ত অনিশ্চয়তার আগে দ্বিতীয় আবাস বা পাসপোর্টের প্রয়োজনীয়তা কখনও এতটা জোরালো ছিল না,” গত বছর বিবিসি তুর্কি বিভাগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন লা ভিদা গোল্ডেন ভিসাস নামের যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানির বিপণন ব্যবস্থাপক লিজি এডওয়ার্ডস।
“বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনা আলাদা হয়, তবে আবেদন করার সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা, ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ এবং শিক্ষা ও ব্যবসার সম্ভাবনাসহ বৈশ্বিক সুযোগ বাড়ানো”, জানান তিনি।
ভিসা পাওয়া নির্ভর করে গন্তব্য এবং বিনিয়োগের ধরনের উপর। যেমন, বিদেশিদের মধ্যে যারা চার লাখ ডলার বা তার বেশি মূল্যের আবাসন কেনে তুরস্ক থেকে তাদের গোল্ডেন পাসপোর্ট অফার করা হয়।
লুক্সেমবার্গের মতো কিছু দেশ গোল্ডেন ভিসার জন্য বিভিন্ন ধরনের বিকল্প দেয়।
এই বিকল্পের মধ্যে রয়েছে লুক্সেমবার্গের কোনও কোম্পানিতে কমপক্ষে পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার ডলার বিনিয়োগ থেকে শুরু করে কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২ কোটি ১৪ লাখ ডলার জমা রাখা।
অনেক দেশ গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অনুদান বা বিনিয়োগ নেয়।
এই স্কিমগুলো চালাতে সরকারগুলোর জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রণোদনার একটি হল দেশে পুঁজি স্থানান্তর করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা।
জার্নাল অফ এথনিক অ্যান্ড মাইগ্রেশন স্টাডিজে প্রকাশিত ড. ক্রিস্টিন সুরাক এবং ইউসুকে সুজুকির একটি গবেষণাপত্র অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পর্তুগালের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ এসেছে গোল্ডেন ভিসার মাধ্যমে।
এই অনুপাত লাটভিয়ার জন্য ছিল ১২ দশমিক ২ শতাংশ আর গ্রীসের জন্য তা ছিল সাত শতাংশেরও বেশি।
ক্যাম্পেইনাররা এই স্কিমগুলো নিয়ে দুটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। এর মধ্যে একটি হল দুর্নীতি এবং অন্যটি হলো স্থানীয়দের জন্য আবাসন সংকটকে উস্কে দেয়া৷
একশোরও বেশি দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এই স্কিমগুলোর বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেছে যে স্কিমগুলোতে “আসলে বিনিয়োগ বা অভিবাসন মুখ্য নয় বরং এগুলো দুর্নীতিবাজদের স্বার্থ রক্ষা করছে।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রচারক ইকা রোস্তোমাশভিলির মতে, এই ধরনের কর্মসূচি পরিচালনাকারী দেশগুলোতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এড়ানোর জন্য কিছু ব্যবস্থা রয়েছে, তবে তা সব সময় কাজ করে না।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “দুর্নীতি বা জালিয়াতি পরিকল্পনায় জড়িত থাকার আগে বা পরে গোল্ডেন ভিসা বা পাসপোর্টের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ আবেদনের ঘটনা প্রকাশ্যেও এসেছে।
“স্পষ্টতই, তারা এটিকে (তাদের নিজেদের দেশে) আইন প্রয়োগকারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এক ধরণের বীমা নীতি হিসেবে দেখে”।
ইইউ-এর বিভিন্ন সংস্থাও এর সমালোচনা করেছে। ২০২২ সালে নাগরিক স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং স্বরাষ্ট্র বিষয়ক ইইউ কমিটি গোল্ডেন পাসপোর্ট নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভোট দেয় আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার-সহ তৃতীয় দেশগুলোকে তাদের গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিম শেষ করতে বলে।
যদিও এই স্কিমগুলোর মাধ্যমে অর্থ পাচার করা সম্ভব হলেও “এখানে সহজ এবং সস্তা বিকল্পও রয়েছে” বলে জানান ড. ক্রিস্টিন সুরাক।
“আপনি স্টুডেন্ট ভিসার মাধ্যমেও একই কাজ করতে পারেন, সম্ভবত এটি আরও সস্তা। ব্যবসায়িক ভিসার ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। এই প্রোগ্রামগুলোর জন্য এটি কোনও উদ্বেগের বিষয় না।”, বলেন তিনি।
২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত একটি ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ তদন্তে জানা যায় যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত লিবিয়ার একজন প্রাক্তন কর্নেল এবং তুরস্কে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন তুর্কি ব্যবসায়ী এই স্কিমের মাধ্যমে ডোমিনিকান পাসপোর্ট কিনেছিলেন।
আর ২০২৩ সালে হোম অফিসের কমিশন করা যুক্তরাজ্যের গোল্ডেন ভিসার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, “অল্প সংখ্যক বিদেশি বিনিয়োগকারী দুর্নীতি বা সংগঠিত সম্ভাব্য অপরাধের সাথে জড়িত থাকার উচ্চ ঝুঁকিতে ছিলেন।”
দ্বিতীয় যে প্রধান উদ্বেগটি প্রচারকারীরা তুলে ধরেছেন তা হল আবাসনের উচ্চ মূল্য। বিনিয়োগের জন্য দেশগুলো বিভিন্ন বিকল্প দিলেও বেশির ভাগ আবেদনকারী আবাসনে বিনিয়োগের বিকল্প বেছে নেয়, যা সম্পত্তির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তবে ড. ক্রিস্টিন সুরাকের গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ দেশেই এর প্রভাব সীমিত।
উদাহরণস্বরূপ, স্পেনে প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার আবেদন গ্রহণ করে। তার মতে চার কোটি আট লাখ মানুষের দেশে দুই হাজার আবাসন লেনদেন অত্যন্ত নগণ্য।
কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আবাসন ক্রয়ের বিষয়টি পছন্দসই এলাকাকেন্দ্রিক। বিদেশিদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু শহর এবং আশেপাশের এলাকা জনপ্রিয় হওয়ায় এই জায়গাগুলো অনেক বেশি প্রভাবিত হতে পারে।
দক্ষিণ তুরস্কের উপকূলীয় শহর আন্টালিয়া এগুলোর একটি। রাশিয়ান এবং ইউক্রেনিয় পর্যটকদের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে জনপ্রিয় আন্টালিয়া, ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরুর পর আশ্রয়প্রার্থীসের স্থায়ী কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সেখানে আবাসনেরও দাম বেড়েছে।
বিবিসি