রাষ্ট্রক্ষমতায় পটপরিবর্তনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফরে বাংলাদেশে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদল। চলতি মাসের ১৫ তারিখ ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে প্রতিনিধিদলটির। সফরের সময় আলোচনায় অর্থনৈতিক সহায়তা ও বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দেবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া শ্রম অধিকার, গণতন্ত্র-সুশাসন এবং মানবাধিকারের বিষয়গুলো আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।
প্রতিনিধিদলে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ছাড়াও থাকছেন দেশটির রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সিনিয়র ডিরেক্টর লিন্ডসে ফোর্ড। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তর এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তারা ডোনাল্ড লুর চেয়ে বেশি সময় বাংলাদেশে থাকবেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। মে মাসের পর এটি হবে চলতি বছরে ডোনাল্ড লুর দ্বিতীয় ঢাকা সফর।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। এ ছাড়া পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকের কর্মসূচি রয়েছে তাদের। এ নিয়ে গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের আলোচনা হয়েছে।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বৈঠকের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলটি ঢাকায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নেতা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন বলে জানা গেছে।
এর আগে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে গত বছর ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে ঢাকার সঙ্গে ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা ও অস্থিরতা সৃষ্টির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনার সরকার একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে। গণতন্ত্র আর মানবাধিকার নিয়ে মতপার্থক্যের পরও সম্পর্ক এগিয়ে নিতে মনোযোগী ছিল দুপক্ষ। এজন্য গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র গতকাল কালবেলাকে বলেন, এই দলটা মূলত অর্থনৈতিক সম্পর্ককে সমৃদ্ধ করার বিষয়টাকে সামনে নিয়েই এই সফরটা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের এরই মধ্যে অনেক ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। তারা এখন পর্যন্ত একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে শীর্ষ আমদানিকারক। তারাও বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির কারণে এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এখনো অবশ্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারাই মোটামুটি সামনের সারির দেশ। তবু আমার ধারণা, তারা মনে করে বাংলাদেশে বিনিয়োগের একটা বড় জায়গা আছে।
তিনি বলেন, মার্কিন প্রতিনিধিদলের এই সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয় ছাডাও বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব পাবে। নতুন সরকারের প্রতি অবশ্যই তারা তাদের সমর্থন জানাবে এবং দুপক্ষের দিক থেকেই একটা শুভ প্রত্যাশা থাকবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সফর যে কোনো সময় গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধিদলের প্রথম সফর। খুব স্বাভাবিকভাবেই ভবিষ্যতে দুই দেশের সহযোগিতা কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে।
গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের বিষয়গুলোও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের আলোচনায় আসতে পারে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই করেছে। গুমের ঘটনাগুলোর বিচারে তদন্ত কমিশনও গঠন করেছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বরং মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সংস্কারে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেতে পারে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরে অর্থনৈতিক সহায়তা ও বিনিয়োগের বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার থাকবে। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানাদিক আলোচনায় আসতে পারে। আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নতি, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ফেরত নিতে না পারা, বকেয়া পরিশোধে জটিলতার মতো বিষয়গুলোও সামনে আসতে পারে।
বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠী, যারা অনেক বেশি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আছে, আবার মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বাড়ছে। এসব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের বড় বাজার হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই এখানে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী হবে। বিভিন্ন জায়গায় তারা বিনিয়োগ করতে পারে। তেল-গ্যাস থেকে শুরু করে, কৃষি, আইসিটি, শিক্ষাসহ নানা দিকে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ দেখাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় শ্রম অধিকারের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আসছে। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ কয়েক বছর ধরে গুরুত্বে থাকছে বাংলাদেশের শ্রম অধিকারের বিষয়টি। শ্রম আইন সংশোধনের অগ্রগতি হলেও সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতির উন্নতিতে কিছু ঘাটতি এখনো রয়ে গেছে। এর আগে পরিস্থিতির উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র ১১ দফা সুপারিশ করেছিল। কিন্তু পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন না হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিনিয়োগ ও আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বারবার শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে তাগিদ দিয়েছিল।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি এই বিষয়টা সুরাহা করতে পারে তাহলে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়বে না; বরং ইউরোপের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নে একটা বিরাট ভূমিকা রাখবে। বিষয়টা খুবই সংবেদনশীল, বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে। দুই পক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা জায়গায় আসতে পারে এবং তাদের বুঝাতে হবে যে আমরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং যতটুকু সম্ভব এই সরকার সেটা অব্যাহত রাখবে।
জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. হুমায়ুন কবির কালবেলাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের অগ্রাধিকার আর্থিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় থাকবে বলে আমি মনে করি। আমাদের অর্থনীতি একটা জটিল পর্যায়ে রয়েছে। এতে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের সহায়তা প্রয়োজন। তাদের যে ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) আছে, সেখান থেকে বাংলাদেশ কোনো সাহায্য পায় না। আর এটা না পাওয়ার কারণে বাংলাদেশে উন্নয়ন সম্পর্কিত খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের এখানে খুব কাজে আসতে পারেনি। তারা আমাদের এখানে উন্নয়ন সহযোগী হতে আগ্রহী আছে। কিন্তু জটিলতা হচ্ছে আমাদের এখানে শ্রম অধিকারের বিষয়টি।
তিনি বলেন, এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের ডিএফসি থেকে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে চায়, এর জন্য শ্রম পরিস্থিতির উন্নতি প্রয়োজন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বিনিয়োগের বিষয় আছে। ফলে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরে এসব বিষয় যে প্রাধান্য পাবে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ডিএফসি যদি বাংলাদেশের জন্য ওপেন হয় তাহলে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সুযোগ বাংলাদেশে আছে। যুক্তরাষ্ট্রও এই সফরে বিনিয়োগের দিকটাতে মনোযোগ দেবে। কিন্তু এখানে পূর্বশর্ত হচ্ছে আমাদের লেবার রাইটস বা শ্রম অধিকারের জায়গায় অগ্রগতি করতে হবে। এরই মধ্যে কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। তারা যেমনটা প্রত্যাশা করে, সে জায়গাটিতে আমরা এখনো যেতে পারিনি।