নদীপথে পৃথিবীর দীর্ঘতম ক্রুজ সবে দিন চারেক হল ভারতের বারানসি থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ হয়ে আসামের ডিব্রুগড় অভিমুখে রওনা হয়েছে। সে খবর দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে বেরিয়েছেও। তবে বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়াতে এই প্রমোদতরীকে ঘিরে যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরেফিরে আসছে, তা হল এই বিলাসবহুল রিভার ক্রুজ থেকে বাংলাদেশের আদৌ কি কোনও লাভ হবে?
ক্রুজ অপারেটর সংস্থা ‘অন্তরা’ ভারতের, পর্যটকরা সবাই ভারত থেকেই উঠছেন। এমনকী যাত্রা শুরু এবং শেষ হচ্ছে ভারতেই—ফলে এখানে বাংলাদেশের সেভাবে কোনও লাভ নেই বলে সে দেশে অনেকেই মতামত দিচ্ছেন।
তবে ভারতের সরকারি কর্মকর্তা, পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞ এবং ‘গঙ্গা বিলাস’ নামে ওই ক্রুজের যাত্রীরা পর্যন্ত এক বাক্যে বলছেন এই রিভার ক্রুজ যেমন ভারতের, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও বিরাট সুফল বয়ে আনবে।
কেন আর কীভাবে, তা জানতে বাংলা ট্রিবিউন ভারতে কথা বলেছে সংশ্লিষ্ট এমনই বেশ কয়েকজনের সঙ্গে।
রাজ সিং
সিইও, অন্তরা লাক্সারি রিভার ক্রুজেস
বাংলাদেশ এই ক্রুজের যাত্রাপথের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই রুটে যে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রকে কানেক্ট করা হচ্ছে, সেটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে আমরা যেতে পারছি বলেই। বাংলাদেশ এখানে আছে বলেই এটা পৃথিবীর দীর্ঘতম রিভার ক্রুজ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে, নইলে সেটা কখনোই হত না এটা মনে রাখতে হবে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে রিভার ক্রুজ কিন্তু এই প্রথম নয়। ২০১৯ সালে আমাদের কোম্পানিই প্রথম কলকাতা থেকে ঢাকা অবধি আন্তর্জাতিক রিভার ক্রুজ চালিয়েছিল, সেবারও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে আমরা সীমান্ত পেরিয়েছিলাম। সেই ক্রুজ কিন্তু দারুণ সফলও হয়েছিল। কোভিড মহামারি ঠিক এর পরই আঘাত হানে, ফলে সেই উদ্যোগ শুরুতেই একটা হোঁচট খায়। কোভিড না-এলে দেখতেন এতদিনে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহু রিভার ক্রুজ চালু হয়ে যেত, কারণ এই রুটটা সত্যিই দারুণ সম্ভাবনাময়।
আমরা না-হয় ভারতীয় কোম্পানি, কিন্তু একবার এই রুটটা পরিচিতি পেলে আমি নিশ্চিত বাংলাদেশি অপারেটররাও এই পথে ক্রুজ চালাতে উৎসাহিত হবেন। তখন কিন্তু দেখবেন এই প্রশ্নটা আর উঠবে না যে বাংলাদেশের এতে কী লাভ?
সুমিত ব্যানার্জি (ট্র্যাভেল কিউরেটর, দিল্লি)
কলকাতা/হলদিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশের চিলমারি পর্যন্ত এই যে নদীপথের অংশটা এটারই নাম হল ‘ইন্দো বাংলা প্রোটোকল রুট’ বা আইবিপিআর। বেশ কয়েক বছর হল ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশই কিন্তু পরস্পরকে এই রুট দিয়ে ট্রেড, ট্রানজিট ও ট্র্যাভেলের অনুমতি দিয়েছে। এই যে গঙ্গা বিলাস এখন বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছে, সেটাও যেতে পারছে ওই সমঝোতার অধীনেই।
মোদ্দা কথাটা হল, ভারত যেমন এখন এই পথে রিভার ক্রুজ চালাচ্ছে – তেমনি বাংলাদেশ সরকারের সম্মতিক্রমে সে দেশের কোনও সংস্থারও এই রুটে ক্রুজ চালানোর পূর্ণ এক্তিয়ার আছে। ভারত সরকারেরও এখানে বাংলাদেশের কোনও কোম্পানিকে নিষেধ করার কোনও কারণ নেই।
আমি এটাও জানি, বাংলাদেশেও একাধিক কোম্পানি আছে যারা নদীপথে বিলাসবহুল ক্রুজ চালাতে সক্ষম। এখন সেই ক্যাপাসিটি কাজে লাগিয়ে তারা কবে আইবিপিআর রুটের সুফল নিতে পারে, সেটা দেখাটাই এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আন্দ্রে হেকনার (সুইস পর্যটক, ক্রুজের যাত্রী)
সত্যি কথা বলতে কি, ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসেবে পশ্চিমের দেশগুলোতে বাংলাদেশের পরিচিতি খুবই কম। আমি একাধিকবার কাজে ও বেড়াতে বাংলাদেশ গেছি বলে জানি সেটা কী দারুণ এক্সোটিক লোকেশন, কিন্তু এটাও সত্যি কথা যে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে খুব কম বিদেশি পর্যটকই বাংলাদেশে যান। আশেপাশের দেশ থাইল্যান্ড, মিয়ানমার বা ভারতেও তুলনায় এর চেয়ে অনেক বেশি পর্যটক আসেন।
এখন গঙ্গা বিলাস ক্রুজ আন্তর্জাতিক স্তরে যে ধরনের কাভারেজ পেয়েছে তাতে আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের পর্যটনের এই ছবিটা পাল্টাবে। আমি নিজেই এই ক্রুজ থেকে বিখ্যাত ট্র্যাভেল ম্যাগাজিন ‘কন্ড নেস্ট ট্র্যাভেলার’ ও লন্ডনে বিবিসির নিউজআওয়ার প্রোগ্রামের জন্য সাক্ষাৎকার দিয়েছি। সেখানে বলেছি, বাংলাদেশের প্রকৃতি ও কান্ট্রিসাইড দেখার জন্য আমরা সবাই কতটা উন্মুখ হয়ে আছি।
তা ছাড়া এই ক্রুজটা বাংলাদেশেও তো দশ-বারোটা নদীবন্দরে ভিড়বে। সুন্দরবন, মোংলা, বরিশাল কিংবা সোনারগাঁওতে যাত্রীরা নামবেন, নানা দর্শনীয় বস্তু দেখবেন, নানা জায়গায় কেনাকাটাও করবেন। সব মিলিয়ে এতে যে বাংলাদেশের পর্যটনের ‘প্রোফাইল’ অনেক বাড়বে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই ক্রুজে একটা দেশের লাভ, আরেকটা দেশের ক্ষতি বিষয়টাকে আমি অন্তত সেভাবে দেখছি না কোনও মতেই।
সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় (চেয়ারম্যান, ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটিজ অব ইন্ডিয়া)
এই নদীপথে যে রিভার ক্রুজ চালানো হচ্ছে, সেটা একটা আন্তর্জাতিক ক্রুজ। এটা এককভাবে ভারত বা বাংলাদেশ কোনও দেশেরই নয়, বরং উভয়েরই। আর উভয় দেশই এটা থেকে লাভবান হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
যেমন, এখন বাংলাদেশে শুকনো মৌসুমে নদীর যে সব জায়গায় চড়া পড়ে নাব্যতার সমস্যা হচ্ছে, সে দেশের সরকার কিন্তু ড্রেজিং করে সে সব জায়গায় নদকে ক্রুজ চালানোর উপযুক্ত করে তুলছে। একইভাবে বাংলাদেশের কোনও জাহাজ যখন ভারতে আসবে আমরাও ঠিক একই দায়িত্ব পালন করবো।
পুরো প্রকল্পটাই আসলে বাস্তবায়িত হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। দুদেশের বন্দরেই ক্রুজ থামবে, সেখানে বিদ্যুৎ, পানীয় জল-সহ সব ধরনের লজিস্টিকাল সাপোর্ট দেবে সে দেশের সরকার। তার জন্য নির্দিষ্ট হারে মাশুলও পাবে তারা। বিদেশি পর্যটকদের ‘ফুটফল’ হলে স্থানীয় অর্থনীতিও লাভবান হবে, পর্যটনের মাধ্যম হিসেবে ‘রিভার ক্রুজ’ও নদীমাতৃক এই অঞ্চলে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। ফলে এটা দুদেশের জন্যই ‘উইন উইন’ হবে, সেটা কিন্তু জোর দিয়েই বলা যায়।