রাতের বাসে অথবা লঞ্চে- যে মাধ্যমেই কুয়াকাটা যাননা কেন , কুয়াকাটা পৌছাতে পৌছাতে সকাল ৯-১০ টা বেজে যাবে। কুয়াকাটায় গিয়েই প্রথমেই পছন্দমত একটি হোটেল ভাড়া করতে হবে। কুয়াকাটায় প্রচুর সংখ্যক হোটেল এবং রিসোর্ট রয়েছে।দেশের অন্য যেকোনো পর্যটন স্পটের তুলনায় কুয়াকাটাতে তুলনামূলক সবচেয়ে কম দামে ভালমানের রুম পাওয়া যায়। তবে,রুম নেয়ার আগে ভালভাবে দামাদামি করে নিতে হবে। হোটেল সংখ্যা প্রচুর হওয়ার কারনে অফ সিজন অথবা অন সিজিন কখনোই কুয়াকাটাতে হোটেল রিসোর্টের সংকট পরে না। তাই, আগে থেকে বুকিং কনফার্ম না করলেও খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না। তবুও,নিচে কতগুলো হোটেল এবং রিসোর্টের নাম্বার দেওয়া হলঃ
হোটেল | ফোন নম্বর |
হোটেল সানফ্লাওয়ার | ০১৭৩৩ ৬১৮ ২৩৮ |
সাগরকন্যা রিসোর্ট | ০১৭১১ ১৮১ ৭৯৮ |
হোটেল গোল্ডেন ইন | ০১৭১৭ ৬১৬ ৪৫০ |
হোটেল কুয়াকাটা ইন | ০১৭৫০ ০০৮ ১৭৭ |
হোটেল বীচ হ্যাভেন | ০১৭১৮ ৮২৬ ৪৫২ |
এগুলো ছাড়াও কুয়াকাটায় বিভিন্ন শ্রেণির অসংখ্য হোটেল এবং রিসোর্ট রয়েছে।
পশ্চিমপাশের ভ্রমণস্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে –
এসব স্পট বিভিন্নভাবে ঘুরতে পাড়বেন – বাইক, অটো অথবা ইঞ্জিনচালিত ভ্যান ভাড়া করেও ঘুরতে পাড়বেন। তবে, বাইক ভাড়া করে এই স্পটগুলো ঘুরাটাই এখণ পর্যন্ত অধিক জনপ্রিয়। বাইক চালকের সাথে আগেই ভালভাবে আলোচনা করে নিবেন যে, প্রতিটি স্পটে ২০ মিনিটের মত বাইক থামাতে হবে এবং তিন নদীর মোহনা থেকে ফেরত আসার সময় লেবুর চরের ওখান থেকে সূর্যাস্ত দেখে সন্ধ্যায় কুয়াকাটা সৈকতে ফিরবেন। কুয়াকাটা ট্যুর কতটুকু আনন্দদায়ক হবে তা নির্ভর করে বাইক চালকের উপর কেননা কুয়াকাটার বাইক চালকগুলোর ব্যবহার এবং সার্ভিস সম্পর্কে অনেক অভিযোগ রয়েছে । তাই,অবশ্যই ভাল একজন বাইক চালক নির্বাচন করার চেষ্টা করবেন। বাইক ভাড়া করার আগে আপনারা বাইক চালকের সাথে ভালভাবে চুক্তি করে নিবেন। অথবা ,আপনারা যদি সংখ্যায় ৫-৬ জন হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে কুয়াকাটার পশ্চিম পাশ ঘুরার জন্য অটো এবং ইঞ্জিনচালিত ভ্যানও পাওয়া যায় ।
এই যাত্রাপথে প্রথমেই দেখতে পাবেন শুঁটকী পল্লী। সারা বছরই এখানে শুঁটকী তৈরীর কাজ চলে তবে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্জন্ত পুরোদমে শুটকী তৈরীর কাজ চলে। শুটকি পল্লী থেকে কম দামে ভালমানের শুটকী পাওয়া যায়। পছন্দমত কিছু শুটকী কিনে নিতে পাড়েন। তবে,কুয়াকাটা জাওয়ার আগে ঐসময়ে সমুদ্রে মাছ ধরার উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা তা জেনে যাবেন। মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলে শুঁটকী , ফিস ফ্রাই সহ সকল ধরনের মাছের দামই বেশী থাকে।
শুটকী পল্লী থেকে আবার বাইকে উঠে কিছুটা সামনে গেলে সমুদ্রের পাড়ে বিস্তৃর্ণ বেলাভূমিতে লাল কাকড়া দেখতে পাবেন। কুয়াকাটায় দুটিস্থানে লাল কাকড়া দেখা যায়। এখানে এবং গঙ্গামতি চরের পূর্বপাশে লাল কাকড়া দেখতে পাওয়া যায় যেটা ক্রাব আইল্যান্ড নামে পরিচিত। পশ্চিমপাশের এই লাল কাকড়া চর থেকে আবার কিছুটা সামনে গেলে দেখতে পাবেন লেবুর চর তবে, তিন নদীর মোহনায় যাওয়ার পথে লেবুর বনে বাইক থামাবেন না। কারন- লেবুর বন থেকে খুব ভালভাবে সূর্জাস্ত দেখা যায় তাই তিন নদীর মোহনা ঘুরে লেবুর বনে আসবেন। বেশ কিছুক্ষণ সমুদ্রের পাড় ধরে পশ্চিমদিকে বাইকে গেলে দেখতে পাবেন তিন নদীর মোহনা। অসাধারণ একটি স্পট এই তিন নদীর মোহনা। একপাশে সমুদ্র , আরেকপাশে তিন নদীর মোহনা অপরপাশে উপকূলীয় বন সব মিলিয়ে জায়গাটা আসাধারন। তিন নদীর মোহনা থেকে সুন্দরবনের একাংশ দেখা যায় । তিন নদীর মোহনায় কিছূটা সময় থেকে সূর্যাস্ত দেখার জন্য লেবুর বনের উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা শুরু করতে হবে ।
লেবু বনে লেবু গাছ না থাকলেও জায়গাটা অসাধারণ। এখানে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায় । এই লেবুর বনে ফিস ফ্রাই এবং কাকড়া ফ্রাই নামের দুটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এখানে মাছ- চিংড়ি অথবা কাকড়া ফ্রাই খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখতে পারেন ।সূর্যাস্ত এর পরে বাইকে চড়ে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টে চলে আসবেন। এছাড়াও মৌসুমে কুয়াকাটা সৈকত থেকে ‘সুন্দরবন ডেল্টা’ নামের একটি প্যাকেজ পাওয়া যায় । এই প্যাকেজে ট্রলারে এবং স্পিডবোটে করে কুয়াকাটার ভ্রমনস্পট গুলো ঘুরিয়ে কুয়াকাটার অন্যতম আকর্ষণ ফাতরার চরে নিয়ে যাবে । এই প্যাকেজে ছাউনিযুক্ত ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৩০০ টাকা এবং স্পীডবোটে ৫০০ টাকা। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় লাল কাকড়া চর,তিন নদীর মোহনা ঘুরিয়ে সুন্দরবনের একাংশে নিয়ে যাবে । কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিমপাশের নদী পাড় হলেই সুন্দরবনের শ্বাসমুলীয় বনাঞ্চলের ফাতরার বণ দেখতে পাবেন। এই বনে কোনও হিংস্র প্রাণী নেই।
কুয়াকাটা ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয় হচ্ছে সূর্য-উদয় দেখা। সূর্য-উদয় দেখার জন্য ভোর সকালে গঙ্গামতি চর যেতে হবে। এক্ষেত্রে গতকাল যেই বাইকে পশ্চিম পাশ ঘুরেছেন ঐ বাইক চালকের সার্ভিস যদি আপনার পছন্দ হয় তাহলে ঐ বাইক চালকেই আজকে দিনের জন্য রেখে দিবেন। আর তা না হলে,রাতেই অন্য কোনও বাইক চালকের সাথে আজকে দিনের জন্য কথা বলে রাখবেন। ভোর সাড়ে চারটার দিকে বাইক চালক আপনার হোটেলের সামনে এসে আপনাকে নিয়ে গঙ্গামতি চরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে গঙ্গামতি চর ১০ কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত। ভোর সকালে গঙ্গামতি থেকে সূর্য উদিত হওয়ার দৃশ্য আপনি কখনো ভুলতে পাড়বেন না। তবে, শীতকালের মাঝামাঝি সময়ে আসলে কুয়াশার কারনে ভালভাবে সূর্য উদয় দেখতে পাড়বেন না।
গঙ্গমতির পূর্বপাশে রয়েছে ক্রাব আইল্যান্ড অর্থাৎ, লাল কাকড়া চড়। লাল কাকড়া চড়ে অসংখ্য লাল ককড়া দেখতে পাবেন- যেগুলো সকালে রোদ পোহাতে বের হয়েছে। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই কাকড়াগুলো গর্তে ঢুকে যায়। তাই,একসাথে অনেক ককড়া দেখতে হলে কুশলী হতে হবে। লাল কাকড়া চর থেকে ভেরীবাদ সড়ক পাড় হয়ে একটু ভিতরের দিকে গেলে দেখতে পাবেন মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ বিহার। মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ বিহার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পবিত্র স্থান। ধারনা করা হয় বৌদ্ধ মন্দিরের মূর্তিটি উপমহাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় মূর্তি। রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা এই মৃর্তিটিকে দেবতা মনে করেন। মিশ্রিপাড়া সীমা বৌদ্ধ মন্দির ঘুরে বাইক চালককে সোজা আপনাদের হোটেলে ফেরত দিয়ে আসতে বলবেন এবং বাইক চালককে বিদায় দিয়ে দিবেন। এরপর হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর পরবর্তী গন্তব্য কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের সাথেই অবস্থিত কুয়াকাটার কুয়া,শতবর্ষী নৌকা, শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ মন্দির এবং কেরানিপাড়া। তবে, হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় আপনারদের ব্যাগগুলো সাথে নিয়ে হোটেল রুম খালি করে দিবেন কেননা হোটেলগুলোতে সকাল ১০-১১ টার দিকে চেক আউট করতে হয়। তা না হলে, আরও একদিনের রুম ভাড়া গুনতে হবে।
কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে বামদিকের রাস্তা ধরে কিছুটা সামনে গেলেই দেখতে পাবেন শতবর্ষী নৌকা। ২০১২ সালে সমুদ্র সৈকতের ভাঙনের ফলে সন্ধাণ মেলে ৭২ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২৪ ফুট প্রস্থের কাঠের তৈরী নৌকার। ধারনা করা হয়, ২০০ বছর আগে রাখাইনরা এই নৌকায় করে কুয়াকাটায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল। কুয়াকাটায় দুটি বৌদ্ধ মন্দির আছে। একটি মিশ্রিপাড়ায় এবং অপরটি কুয়াকাটার প্রচীন কুয়াটির সামনে অবস্থিত।এই মন্দিরটি শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার নামে পরিচিত। এই মন্দিরে রয়েছে প্রায় ৩৭ মন ওজনের অষ্ট ধাতুর তৈরী ধ্যাণমগ্ন বৌদ্ধের মূর্তি।
বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে থেকে কেরাণিপাড়াইয় রয়েছে প্রাচীণ কূপগুলোর মধ্যে একটি কূপ। কুয়াকাটা নামকরণের পিছণে যে ইতিহাস রয়েছে সেই ইতিহাসের সাক্ষী কুয়াটি এখনো রয়েছে। জনশ্রুতি আছে,১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা রাখাইনদ্র মাতৃভূমি আরকান দখল করলে বহু রাখাইন যায়গাটি ছেড়ে নৌকাযোগে আশ্রয়ের খোঁজে বেড়িয়ে পরেন। চলতি পথে বঙ্গোপসাগরের তীরে রাঙ্গাবালী দ্বীপের খোঁজ পেয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। সাগরের লবনাক্ত পানি ব্যবহারের অনুপযুক্ত লেমিষী পানির সণদ্ধানে তারা এখানে একটি কূপ খনন করেন । এরপর থেকে জায়গাটি কুয়াকাটা নামে পরিচিত। বৌদ্ধ মন্দিরেরে সামনে থেকে শুরু হয়েছে রাখাইন আদিবাসীদের পল্লী কেরাণিপাড়া। এখাণকার রাখাইন নারীরা কাপড় বুননের কাজ করেন । রাখাইনদের তৈরী কাপর এবং চাদর অনেক আকর্ষনীয়। কুয়াকাটা ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনেও যদি বাইকে চরতে না চান তাহলে – চড় গঙ্গামতি এবং লাল কাকড়া চড় এই দুটি স্পট বাদ দিয়ে সকাল বেলা সূর্যোদয় দেখার জন্য ঝাউবনে চলে যাবেন । এখানে সারিসারি ঝাউগাছের মধ্যে সকালে সূর্য উঠার আগে স্মরণিয় কিছু সময় কাটাতে পাড়বেন।
এই বনটি সরকার বনায়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তৈরী করেছেন। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে পায়ে হেটে ঝাউবনে যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ আধাঘণ্টা এবং ভ্যানে যেতে সময় লাগবে ১০ মিনিট। ঝাউবন উপভোগ করার পর যদি মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ বিহার যেতে চান- সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে আলীপুর বাজার হয়ে মিশ্রিপাড়া যাওয়ার জন্য ভাল পাকা রাস্তা রয়েছে। এ পথে অটো অথবা ইঞ্জিনচালিত ভ্যানে মিশ্রিপাড়া যেতে পাড়বেন। কুয়াকাটার হোটেল গুলোতে সকাল ১০-১১ টার মধ্যে চেক আউট করতে হয় এক্ষেত্রে চর গঙ্গামতি-লাল কাকড়া চর অথবা ঝাউবন ঘুরে আসতে যদি সকাল ১০ টা বেজে যায় তাহলে তখনই হোটেল রুম খালি করে দিবেন এবং ব্যাগগুলো আপনাদের সাথে নিয়েই কুয়াকাটার কুয়া, শতবর্ষী নৌকা এবং রাখাইন পল্লী ঘুরে দেখবেন।