১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট। অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন মেসিডোনিয়ার স্কোপিতে মায়ের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক শিশু। মা–বাবা শিশুটির নাম রাখেন অ্যাগনেস বোইয়াক্সিউ এবং ডাক নাম গোস্কসা। গোস্কসা মূলত একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ ‘কুসুমকলি’। কে জানত, সেই কুসুমকলিই একদিন প্রস্ফুটিত হয়ে সুবাস ছড়াবে পৃথিবীতে। মায়ার বাঁধনে জড়াবে ঘরহারা হাজারো এতিম শিশুকে। হাসি ফোটাবে দুঃখী মানুষের মুখে।
বলছিলাম মাদার তেরেসার কথা। ছোটবেলায় অ্যাগনেস নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর বাবা নিকোলা বোজাহি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। মায়ের নাম দ্রেইন। তাঁরা ছিলেন আলবেনীয় বংশোদ্ভূত। মা–বাবা, ভাই–বোন মিলে অত্যন্ত সুখী পরিবার ছিল তাঁদের।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারান অ্যাগনেস। শুধু বাসস্থানটুকু ছাড়া সর্বস্ব হারিয়ে মহাবিপদে পড়তে হয় পরিবারটিকে। আকস্মিক এই বিপর্যয়ে তাঁর মা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েন। সংসারের সব দায়দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর বড় বোন অ্যাগের ওপর। কাপড় বিক্রি ও এমব্রয়ডারির ব্যবসা দিয়ে তাঁদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হলো। জীবনের এই সংগ্রাম থেকে দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতাকে সাহস ও উদ্দীপনার সঙ্গে গ্রহণ করার কৌশল আবিষ্কার করেন তিনি।
১২ বছর বয়স থেকে সন্ন্যাসিনী হয়ে সৃষ্টিকর্তার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার ইচ্ছা পোষণ করেন অ্যাগনেস। এর প্রায় ছয় বছর পর ১৯২৮ সালে সেই সুযোগ আসে। ১৮ বছর বয়সে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করতে আয়ারল্যান্ডে যান। সেখানে গিয়ে লোরেটা সিস্টারদের সঙ্গে যোগ দেন। ‘সিস্টার্স অব লোরেটো’ মিশনারি মেয়েদের দল। তাঁরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মপ্রচারের কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনিও এই কাজ করতে চান।
সন্ন্যাসজীবনের প্রশিক্ষণ এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য অ্যাগনেসকে আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে পাঠানো হয়। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় ছয় সপ্তাহ শেষে ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর ভারতবর্ষের উদ্দেশে সমুদ্রপথ পাড়ি দেন তিনি। ১৯২৯ সালে ভারতের কলকাতায় পৌঁছান। এরপর সেখানকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।
১৯৩১ সালে অ্যাগনেস সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন। তখন তিনি সাধু সেন্ট তেরেসার নামানুসারে ‘সিস্টার ম্যারি তেরেসা’ নাম গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সেন্ট মেরি হাইস্কুলে ভূগোল, ইতিহাস ও ক্যাথেসিজম বিষয়ে পাঠদান করেন। পাশাপাশি বাংলা ও হিন্দি ভাষা রপ্ত করারও চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে স্কুলের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান।
শিক্ষকতা করার ফাঁকে ফাঁকে প্রতিদিন কলকাতা শহরের বিভিন্ন বস্তিতে ঘুরে বেড়াতেন মাদার তেরেসা। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ সময় পশ্চিমবঙ্গ এক বিশাল হাহাকারের রাজ্যে পরিণত হয়। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এমন অবস্থায় বস্তিবাসীদের অবর্ণনীয় দুঃখ–দুর্দশা নিজ চোখে দেখতে বস্তিতে যেতেন তিনি। চেষ্টা করতেন তাদের সাহায্য করতে।
১৯৪৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মাদার তেরেসা কলকাতা থেকে ট্রেনে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। ওই সময় ট্রেনে বসে তিনি ভারতের মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে ক্ষুধার্ত ও নিঃস্বদের ডাকে সাড়া দিতে কাজ শুরু করেন।
বছর চারেক পরে ১৯৫০ সালে জনহিতৈষী প্রতিষ্ঠান ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ গড়ে তোলেন। যার শাখা বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। ১৯৫২ সালে এই চ্যারিটির অধীনেই গড়ে ওঠে ‘নির্মল হৃদয়’। এটি মুমূর্ষু মানুষের আশ্রয় ও সেবাকেন্দ্র। ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় একটি পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দিরকে এই সেবাকেন্দ্রে রূপান্তরিত করেন। নির্মল হৃদয়ের আদি নাম ‘হোম ফর দ্য ডাইং’। এটি ছিল দরিদ্রদের জন্য নির্মিত দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র। এ ছাড়া কুষ্ঠরোগীদের জন্য গড়ে তোলেন ‘শান্তিনগর’।
এরপর ধীরে ধীরে কলকাতার বাইরেও মিশনারিজ অব চ্যারিটির সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেন মাদার তেরেসা। ১৯৬৫ সালে বিশ্বব্যাপী কাজ করার অনুমতি পান। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে প্রথম শাখা খোলা হয়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে এই চ্যারিটির শাখা রয়েছে।
মানবসেবার স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন মাদার তেরেসা। ১৯৭১ সালে পোপ জন শান্তি পুরস্কার পান। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের চেষ্টাস্বরূপ ১৯৭২ সালে নেহরু পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই বছরই ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ভারতরত্ন পুরস্কার পান তিনি। ১৯৭৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত সাময়িকী ‘টাইম ম্যাগাজিন’ তাঁকে নিয়ে প্রচ্ছদ করে। তিনি ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মোট ৮৪টি পুরস্কার ও সাম্মানিক উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
আর্তমানবতার সেবায় আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তিতে পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, পৃথিবীতে বোমা বা বন্দুক আমাদের দরকার নেই। বরং শান্তি আনতে সবাই একতাবদ্ধ হোন, একে অপরকে ভালোবাসুন। সেই শান্তি আনুন, যা সবাইকে আনন্দ দেয় আর ঐক্যবদ্ধ থাকার শক্তি জোগায়। আর এভাবেই আমরা পৃথিবীর সব মন্দকে জয় করতে পারব।’
ওই সময় মিশন অব চ্যারিটিতে ১ হাজার ৮০০-এর বেশি সন্ন্যাসিনী ও ১ লাখ ২০ হাজার কর্মী ছিলেন। ভারতের ৮০টির বেশি শাখায় ও বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে তাঁরা মানবহিতৈষী কাজে জড়িত ছিলেন।
১৯৮৯ সালে দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর মাদার তেরেসার দেহে কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। এই পরিস্থিতিতে তিনি ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’র প্রধানের পদ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু চ্যারিটির নানরা গোপন ভোটের মাধ্যমে তাঁকে প্রধান থাকার অনুরোধ করেন। অগত্যা তিনি চ্যারিটির প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে শেষমেশ ১৯৯৭ সালে মিশনারিজ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। সিস্টার নির্মলা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর এই মহীয়সী নারী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নেন।
মৃত্যুর পর নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ও ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত মাদার তেরেসাকে কলকাতার মাদার হাউসেই সমাহিত করা হয়।
মৃত্যুর সময় মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে সিস্টারের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার এবং ব্রাদারহুড সদস্য ৩০০ আর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল ১ লাখের বেশি। পৃথিবীর ১২৩টি দেশে মোট ৬১০টি কেন্দ্রে ধর্মপ্রচারের কাজ পরিচালিত হচ্ছিল।
এসব কেন্দ্রের মধ্যে ছিল এইডস, কুষ্ঠ ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসাকেন্দ্র, সুপ কিচেন, শিশু ও পরিবার পরামর্শকেন্দ্র, এতিমখানা ও বিদ্যালয়। মাদার তেরেসা কখনোই জাতি-ধর্ম-বর্ণের সীমানায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। আর্তমানবতার সেবায় তিনি মাতৃস্নেহে যেভাবে পৃথিবীর সব জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের ভালোবাসার টানে আবদ্ধ করেছেন, তেমনি বিশ্ববাসী মাদার তেরেসাকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করে।
মাদার তেরেসার মৃত্যুর দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে তাঁকে ‘সন্ত’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণত এই প্রক্রিয়া শেষ করতে পাঁচ বছর সময় লাগে। ২০০৩ সালের ১০ অক্টোবর পোপ দ্বিতীয় জন পল জানান, সন্ত হওয়ার জন্য মাদার তেরেসা তিনটি ধাপ অতিক্রম করেছেন। এরপর কেটে যায় এক যুগের বেশি সময়। ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মাদার তেরেসাকে সন্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস এ স্বীকৃতি দেন।
পোপ বলেন, সন্ত ঘোষণার পরও ক্যাথলিকদের কাছে তিনি মাদার তেরেসা হিসেবেই থাকবেন। পোপ সন্ত তেরেসার কাজকে ‘দরিদ্রতমদের সঙ্গে ঈশ্বরের নিবিড়তম সখ্যের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা’ হিসেবে অভিহিত করেন।
মাদার তেরেসা দেখিয়ে গেছেন শুধু ভালোবাসা দিয়েই পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন। তাই তো ১১৪তম জন্মদিনে বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে মহীয়সী এই নারীকে।
সূত্র: দ্য নোবেল প্রাইজ, বিবিসি ও হিস্ট্রি