প্রতিবেশী দেশ ভারতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে আমাদের আকর্ষণ মূলত দার্জিলিং, মেঘালয়, সিকিম, হিমাচল প্রদেশ, কাশ্মীর, গোয়া কিংবা আগ্রার তাজমহলের প্রতি। এদের কোনো কোনোটি আবার ব্যয়বহুল হওয়ায় সীমিত আয়ের অনেকেই যেতে পারেন না।
সেসব ভ্রমণপিপাসুর জন্য একটি আদর্শ গন্তব্য হতে পারে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা। রাজ্যটির সঙ্গে স্থল সীমান্ত আছে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার অবস্থান আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া স্থলবন্দরের খুব কাছে। বাংলাদেশ থেকে যে কেউ আগরতলায় গেলে অবাক হবেন শহরবাসীর কথা বলার ঢং ও আচার-আচরণে। কারো কারো হয়তো মনেই হবে না যে, এটি বাংলাদেশের বাইরের একটি শহর।
বাংলাদেশিদের জন্য সেখানে অভ্যর্থনা ও আন্তরিকতার কোনো কমতি হয় না। এই আগরতলা শহর ও এর বাইরে আছে চমৎকার সব দর্শনীয় স্থান। আর এগুলোতে বেড়ানোর উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত।
উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ
আগরতলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রায় আধা মাইল এলাকাজুড়ে দ্বিতল প্রাসাদটি অবস্থিত। মিশ্র স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত প্রাসাদটির তিনটি গম্বুজ ঘিরে আছে মুঘল আমলের খাঁজকাটা নকশা যার মাঝেরটি ৮৬ ফুট উঁচু। ১৮৯৯ সালে এই সুদৃশ্য ও মনোরম প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ও শেষ হয় ১৯০১ সালে।
তখনই এর নির্মাণ ব্যয় ছিল ১০ লাখ ভারতীয় রূপি। মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুর উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ নির্মাণের মূল উদ্যোক্তা। প্রধান ভবনটির দু’পাশে দুটি দীঘি। দীঘির পাড়ে সেগুন, শিরিষ, কড়ই আর শাল গাছের সাজানো অরণ্য। প্রাসাদের প্রবেশ পথের ঠিক মাঝখানে আছে ফোয়ারা আর ভাস্কর্যসমৃদ্ধ একটি চমৎকার বাগান। প্রাসাদের ভেতরে সারি সারি কক্ষ।
এগুলোর প্রতিটির আছে আলাদা আলাদা নাম- শ্বেতমহল, লালমহল, সদর বাড়ি, তহবিল খানা, আরাম ঘর, পান্থশালা প্রভৃতি। এই প্রাসাদের নামকরণ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভবনটিতে অনেকদিন ত্রিপুরা রাজ্য বিধানসভার কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এখন এটি স্টেট মিউজিয়াম বা রাজ্য জাদুঘর।
কুঞ্জবন প্রাসাদ
উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের এক মাইল উত্তরে মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্যের নির্মিত (১৯০৯ থেকে ১৯২৩ সালে) ছবির মতো সুন্দর কুঞ্জবন প্রাসাদ হচ্ছে আগরতলার আরেকটি চমৎকার স্থাপত্যকর্ম। এ প্রাসাদটি আসলে তৈরি করা হয়েছিলো বিভিন্ন মহারাজা ও তাদের অতিথিদের অবকাশ যাপন ও নির্জনবাসের জন্য।
১৯২৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগরতলায় তার সপ্তম ও শেষ সফরে কুঞ্জবন প্রাসাদের পূর্বদিকের অ্যাপার্টমেন্টে অবস্থান করেন। এই পূর্বাংশের সঙ্গে সংযুক্ত গোলাকার বারান্দার শেষ সীমানা থেকে বড়মুড়া পাহাড়ের দূরবর্তী দৃশ্য দেখা যায়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটি ত্রিপুরার রাজভবন ছিলো যা পরে স্থানান্তরিত হয়।
প্রাসাদটিকে বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ের সাংস্কৃতিক জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ চলছে। কুঞ্জবন প্রাসাদের উত্তর-পূর্বদিকেই আছে বিলাসবহুল রিসোর্ট ওে মানিক্য শাসনামলের ত্রিপুরা রাজাদের বিশ্রামাগার মালঞ্চ নিবাস। এখানে ভূ-গর্ভস্থ কক্ষও আছে।
সিপাহীজলা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি
আগরতলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান এই অভয়াশ্রমের। বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত অভয়াশ্রমে আছে নজরকাড়া সব পাখি ও বানর। এখানে আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, লেক ও বিপুল প্রজাতির বৃক্ষ। অভয়াশ্রমটি সারা বছরই ঘন সবুজ বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত থাকে।
সাধারণ বানরের পাশাপাশি এখানে দেখা যাবে ক্ষুদ্র লেজবিশিষ্ট বানর, ক্যাপড লেঙ্গুর, চশমাপরা লেঙ্গুর প্রভৃতি। বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রমের পাশাপাশি এখানে একটি গবেষণা কেন্দ্রও আছে। ১৫০ প্রজাতির স্থানীয় ও অতিথি পাখির কলকাকলি আপনার চোখে মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেবে।
অভয়াশ্রমের বিভিন্ন অংশের মধ্যে রয়েছে একেক প্রকার প্রাণী ও পাখির জন্য একেক প্রকার আবাসস্থল। যেমন- স্তন্যপায়ী প্রাণী, মাংসভোজী প্রাণী ও কুমিরের আবাসস্থল, পক্ষীশালা প্রভৃতি। অভয়াশ্রমটির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এখানকার লেকগুলো। আবাসারিকা ও অমিত সাগর লেকে রয়েছে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধা।
কমলাসাগর লেক
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি একটি বিশাল লেক যা পঞ্চদশ শতাব্দীতে খনন করেছিলেন মহারাজা ধন্য মানিক্য। এই লেকের সীমানায় ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত বিখ্যাত কালি মন্দির অবস্থিত।
প্রতিবছরের এপ্রিল ও আগস্ট মাসে মন্দির প্রাঙ্গণে বিশাল মেলা অনুষ্ঠিত হয় যা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমান অনেক ভক্ত ও পর্যটক। নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য কমলাসাগর লেক সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যের সেরা পিকনিক স্পটগুলোর একটি।
ধর্মীয় কারণে এটি ভারত ও ভারতের বাইরের পূণ্যার্থীদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। আগরতলা শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
নীরমহল
অনেকের মতেই ত্রিপুরা রাজ্যের সেরা পর্যটন কেন্দ্র হলো নীরমহল। এখানে না গেলে কিন্তু পুরোপুরি বৃথা যাবে ত্রিপুরা ভ্রমণ। রাজধানী আগরতলা থেকে প্রায় ৫৩ কিলোমিটার দূরে মেলাঘর নামক স্থানে এর অবস্থান। রুদ্র সাগর নামে একটি লেকের ঠিক মাঝখানে রূপকথার রাজপ্রাসাদের মতো দাঁড়িয়ে আছে নীরমহল।
নৌকায় চড়েই আপনাকে পৌঁছতে হবে স্বপ্নের নীরমহলে। সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের একমাত্র জলবেষ্টিত প্রাসাদ এটি। সাগরমহল নামে একটি সরকারি পর্যটক নিবাস রয়েছে রুদ্র সাগরের পূর্ব তীরে যার অবস্থান একেবারে নীরমহলের মুখোমুখি। নীরমহল প্রাসাদ ও রুদ্র সাগর কোনোটিই সৌন্দর্যের বিচারে কারো চেয়ে কম নয়।
আর রাতের নীরমহলের সৌন্দর্য তো এককথায় অতুলনীয়। দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন কল্পলোকের স্বপ্ননগরী। পুরো ভবনে এমনভাবে আলোকসম্পাত করা হয়েছে যে, মনে হবে পানিতে ভাসছে দক্ষ শিল্পীর হাতে গড়া কোনো সোনালি রাজহাঁস। আর জোছনা রাত হলে তো কথাই নেই।
রুদ্র সাগরে নৌবিহার আপনার ভ্রমণের আনন্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবে। জায়গাটির নাম নীরমহল কেন হলো এমন প্রশ্ন আসতে পারে যে কারো মনে। চতুর্দিকে ‘নীর’ অর্থাৎ পানির মধ্যে প্রাসাদটির অবস্থান বলেই এর নাম হয়েছে নীরমহল। নির্মাতা মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য এই নামকরণ করেন।
এখানে একরাত না থাকলে কিন্তু সৌন্দর্যের আসল স্বরূপ উপভোগ করা যাবে না। থাকা-খাওয়ার জন্য সাগরমহল পর্যটক নিবাসের ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় খরচটাও খুব বেশি নয়।
ডাম্বুর লেক
আগরতলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে ডাম্বুর লেকের অবস্থান। চোখজুড়ানো বনানীতে আচ্ছাদিত ৪১ বর্গকিলোমিটারের এই জলাভূমির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এর মধ্যে অবস্থিত ৪৮টি দ্বীপ।
বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে অতিথি পাখির কলকাকলি আর বিভিন্ন জলক্রীড়ার সুবিধা। এই লেকের কাছাকাছি গোমতী নদীর উৎসমুখে (তীর্থমুখ) আছে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এখানে প্রতি বছরের ১৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বিখ্যাত ‘পৌষ সংক্রান্তি মেলা’।
ডাম্বুর লেকে এসে মিলিত হয়েছে আলাদা দুটি নদী- রাইমা ও সারমা। শীতকালে এখানে জড়ো হয় বিচিত্র প্রজাতির অতিথি পাখি। প্রাকৃতিক ও চাষ করা মাছের এক বড় মজুদও এই লেক।
জাম্পুই হিলস
অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর শীতল আবহাওয়ার জন্য জাম্পুই হিলস হয়ে উঠেছে ত্রিপুরা রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর একটি। আগরতলা থেকে প্রায় ২১৮ কিলোমিটার দূরে এলাকাটির অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় তিন হাজার ফুট।
এর উত্তর পাশে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ ও দক্ষিণ পাশে চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থান। জাম্পুই রেঞ্জ পড়েছে দুই প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা ও মিজোরামের মাঝখানে। জাম্পুই হিলসের স্থানীয় অধিবাসীরা হলো ত্রিপুরার আদিবাসী রিয়াং ও সিকাম সম্প্রদায়।
সিকামরা আবার আবাস গেড়েছে দশটি গ্রামে যেগুলোর নাম হলো ফুলডাং সাই, চাবওয়াল, থিয়াং সাং, বাংলা বান, বেহাং চিপ, ভাং মুন, লক্ষ্মী, মুনপুই, মুং হুয়াং ও ভাই সুম। এসব গ্রাম পাহাড়ের বিভিন্ন উচ্চতায় অবস্থিত। পরিপাটি ও অতিথিপরায়ণ মিজোরা রাজ্যের অন্যান্য আদিবাসীদের চেয়ে শিক্ষিত ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
জাম্পুই হিলস এলাকায় উন্নতমানের কমলা উৎপন্ন হয়। চমৎকার স্বাদ ও রসের কারণে বাজারে এর যথেষ্ট চাহিদা আছে। এখানকার মিজোদের বিখ্যাত বাঁশনৃত্য এক নিমেষে আপনার কর্মব্যস্ত জীবনের সব একঘেয়েমি দূর করে মনকে করে তুলবে সতেজ ও প্রাণচঞ্চল।
জাম্পুই হিলসের বেল্টিং সিব হলো সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যের উচ্চতম স্থান। এখানে দাঁড়িয়ে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলে কখন যে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাবেন টেরই পাবেন না। এখানে একটি শিবমন্দির দেখতে পাবেন যা ১৪০০ বছর আগে নির্মাণ করেছিলেন ত্রিপুরা রাজারা। ত্রিপুরাবাসীর কাছে এটি একটি পবিত্র স্থান।
যাতায়াত
দেশের যেকোনো স্থান থেকে ট্রেনযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্টেশনে নেমে রিকশায় পৌঁছে যাবেন সীমান্ত চেকপোস্টে। চেকপোস্টের আনুষ্ঠানিকতা সেরে অটোরিকশায় করে সোজা আগরতলা।
থাকা-খাওয়া
আগরতলায় থাকার মতো ভালোমানের অনেক হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জিঞ্জার হোটেল, হোটেল সোনার তরী, হোটেল সিটি সেন্টার, হোটেল সমরাজ রিজেন্সি, হোটেল গ্রিন টাচ, হোটেল এক্সিকিউটিভ ইন, রয়্যাল গেস্ট হাউস, হোটেল জয়পুর প্যালেস, হোটেল প্যালেস ইন প্রভৃতি।
ডাম্বুর লেকের কাছাকাছি রয়েছে জতনবাড়ি অমরপুরস্থ রাইমা ট্যুরিস্ট লজ। জাম্পুই হিলস এলাকায় ইডেন ট্যুরিস্ট লজই প্রধান ভরসা। তবে সিট কম হওয়ায় অগ্রিম বুকিং দিতে হয়।