ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং কানাডা এই তিনটি দেশে এসে যারা বছরের পর বছর পড়ে থাকে অর্থনৈতিক ভাবে নিজে এবং নিজের পরিবারের জন্য টুকটাক কিছু করতে পারে না মনে করবেন এদের জন্মের দোষ আছে
এরা হয় নাম্বার ওয়ান- অলস, খায় আর ঘুমায়, না হয় যা রুজি করে তা দিয়ে তাদের নেশা পানি ও আখের গোছায়, না হয় রুজির টাকায় নারীবাজী করে, না হয় রুজির টাকায় কাসিনো অথবা জুয়া খেলে। এরা হলো জন্মগত লুজার।
আমি এই তিনটি দেশে একেবারে ভিখারি থেকে শুরু করে উপরের তলার বাংলাদেশী বিভিন্ন মানুষকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। এখানে পরিশ্রমী বাংলাদেশী মানুষদের কাজের অভাব নেই।
বেতন হয়ত কম-বেশ হতে পারে কিন্তু পরিশ্রমী মানুষদের জন্য এই দেশগুলোর সর্বত্রই কাজের চাহিদা আছে। এটি এমন নয় যে কেউ মনেপ্রাণে কোন একটি কাজ খুঁজছে কিন্তু তাকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চেষ্টার পর কোন কাজই মিলছে না। এমনটি হতেই পারে না।
আমি দেখেছি যারা বাংলাদেশ থেকে বড় মাথা নিয়ে এখানে এসে কাজকর্ম খুঁজতে গিয়ে শুধু ভাল ভাল কাজ খুঁজে তাদের ভাগ্যে অনেক সময় কাজই জুটে না। এরা শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারে না।
এই দেশগুলোয় যারা পরিশ্রমী তাদের কর্মক্ষেত্রে বিশাল চাহিদা আছে। আপনি এই দেশগুলোয় এসে যে কোন একটি সেক্টর যেমন রেস্টুরেন্ট অথবা কোন ধরনের প্রডাকশন কোম্পানি অথবা অন্য যে কোন ধরনের একটি ছোটখাটো কাজে ঢুকলেন।
এরপর আপনি যদি খুব পরিশ্রম করেন এবং কাজকর্ম ও টাইমিং-এ কোনধরনের ফাঁকিবাজি না করেন তাহলে দেখবেন কিছুদিনের মধ্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নোটবুকে স্থান করে নিয়েছেন।
সাধারণ বাংলাদেশীরা এসব দেশগুলোয় এসে মুলত রেস্টুরেন্টেই কাজ শুরু করেন। কোন দক্ষতা ছাড়াই অনেকে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ডিসওয়াশার অথবা বাসবয়ের কাজ পান এবং এভাবেই অনেকে ক্যারিয়ার শুরু করেন।
এরপর দীর্ঘ পরিশ্রমের পর, দুচার বছর যেতে না যেতেই দেখা যায় যারা পরিশ্রমী তারা ভাল একটি অবস্থানে চলে গেছেন। কেউ কেউ ডিসওয়াশার দিয়ে শুরু করা ক্যারিয়ার থেকে ধীরে ধীরে ড্রেসিং, কুক, শেফ এবং কেউ কেউ বাসবয় থেকে শুরু করা কেরিয়ার থেকে ধীরে ধীরে ওয়েটার। এমনকি কেউ কেউ বড় বড় রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার হয়ে যান।
এভাবে কেউ কেউ বছরে এভারেজ চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার ডলার দিয়ে শুরু করা চাকুরি থেকে ধীরে ধীরে আশি-নব্বই হাজার ডলার পর্যন্ত বেতনে গিয়ে পৌঁছেন।
আমার পরিচিত আমাদের সিলেটি এক ভাইয়ের আমেরিকার নিউইয়র্কের কাহীনি শুনলে আপনি অবাক হবেন। তিনি সিলেট এমসি কলেজ থেকে বিএ পাশ করে ২০০০ সালে ডিভি লটারি জিতে আমেরিকার নিউইয়র্কে এসেছিলেন।
২০০০ সালে নিউইয়র্কে এসে তিনি ম্যানহাটনের টাইম স্কোয়ারে একটি ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে ডিশওয়াশারের কাজে ঢুকেন। এরপর তিনি তার পরিশ্রম এবং দক্ষতা দেখিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে কিচেনের কাজ ছেড়ে ঐ ফাইভ স্টার হোটেলে ওয়েটারদের এসিস্ট্যান্ট হিসাবে বাসবয়ের কাজ শুরু করেন।
এরপর পাঁচছয় বছরের মধ্যে তিনি বাসবয় থেকে ওয়েটার, ওয়েটার থেকে শিফ্ট সুপারভাইজার এবং সর্বশেষ তিনি ম্যানেজার পদোন্নতি পান।
নিউইর্য়কের টাইমস্কয়ারের প্রাণকেন্দ্রে এক বাংলাদেশী ডিশওয়াশারের কর্মজীবন দশ-বারো বছরের মধ্যে একটি ফাইভ স্টার হোটেলের ম্যানেজারে গিয়ে পৌঁছেছিল। সপ্তাহে ছয়-সাতশত ডলার দিয়ে শুরু করা চাকুরির বেতন শেষ পর্যন্ত সপ্তাহে তার সাতাশ শত ডলারে (২০১৬ ইং) গিয়ে পৌঁছেছিল।
এই ফাইভ স্টার হোটেলেই আমাদের হাসুপা ২০১৬ সালে জাতিসংঘ অধিবেশনে এসে দুইশত সফরসঙ্গী নিয়ে একসপ্তাহ অবস্থান করেছিলেন।
নিউইয়র্ক শহরে এরকম আরো অনেক বাংলাদেশী আছেন যারা দশ-পনেরো বছর আগে ছয়-সাতশত ডলারে চাকুরি শুরু করেছিলেন কিন্তু দীর্ঘ পরিশ্রমের পর ভাল ক্যারিয়ার গড়ে এখন সপ্তাহে দেড়-দুই হাজার ডলার রুজি করেন।
এত গেল পার্মেন্ট জবের কথা। নিউইয়র্ক শহরে যারা পরিশ্রমী তারা রাস্তায় ফলের দোকানে দৈনিক বারো ঘন্টা পরিশ্রম করে দৈনিক দেড়শ থেকে দুই-আড়াইশত ডলার পকেটে ঢুকান।
এছাড়া যারা নিউইয়র্ক শহরে টেক্সি চালান তাদের অনেকে দৈনিক আড়াইশো-তিনশো ডলার রুজি না হলে মড়াকান্না শুরু করেন। কারন বারো ঘন্টার একেকটি শিফ্টের জন্য একেকজন ড্রাইভারকে একশো-দেড়শো ডলার টেক্সির জন্য ভাড়া পরিশোধ করতে হয়।
ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং কানাডা এই তিনটি দেশের চালচিত্র প্রায় সমান। আপনি যদি ভাবেন এই দেশগুলোয় এসে আপনি শুধু ঘুমাবেন আর খাবেন তাহলে মনে রাখবেন আপনি বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন।
এই দেশগুলো হলো পরিশ্রমের দেশ। এখানে এসে আপনি কাজকর্ম ছাড়া শুধু খাবো আর ঘুমাবো এমন ভাবে চলতে চাইলে আপনাকে ভিখিরির মতই চলতে হবে। কাজকর্ম ছাড়া এখানে কারোই ভালো বাড়ি-গাড়ির সৌভাগ্য হয় না।
এই দেশগুলোয় যে যত বেশী পরিশ্রমী সে তত বেশী স্বাবলম্বী হয়। সুতরাং যাদের কাজকর্মে অনীহা এবং যারা মা-বাবার আদরের সন্তান তাদের এই দেশগুলোয় না আসাই বুদ্ধিমানের কাজ।
এই দেশগুলোয় বাংলাদেশের মত স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কেউ কারো জন্য সবকিছু করে রাখে না। এখানে খাবার পরে নিজের প্লেটটা নিজেকেই ধুতে হয়। এখানে বাঁচতে গেলে কাজকর্ম করে আয়-রুজির টাকায় সওদাপাতি কিনে এনে নিজেকেই রান্না করে খেতে হয়।
Like this:
Like Loading...