‘অনৈতিক আচরণের’ জন্য সুখ্যাতি ছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদের। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আলোচিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
এ সময়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বে থেকে প্রভাব খাটিয়ে পর্দার আড়ালে থেকে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে অবৈধ উপায়ে তার এসব সম্পদ অর্জনের তথ্য উঠে এসেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক এই ডিবিপ্রধানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কেবল রাজধানীর উত্তরাতেই নামে-বেনামে অন্তত ১৮টি সম্পত্তির (জমি ও ভবন) মালিক হারুন। এসব সম্পত্তির প্রায় সবই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এজেন্সির কাছে, এবং হোটেল ও মার্কেট হিসেবে ভাড়া দেওয়া রয়েছে।
এর বাইরেও গাজীপুর, সাভার ও টেকনাফে হারুনের আরও প্রায় ডজনখানেক সম্পত্তি রয়েছে বলে জানা গেছে।
এরইমধ্যে হারুন ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তারের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
এসব সম্পত্তির বিষয়ে জানতে টিবিএস একাধিকবার হারুনের ফোন নম্বরে কল করলেও তিনি সাড়া দেননি।
উত্তরার ৩ নং সেক্টরের ২০ নং রোডের মাথায় একটি আটতলা বাড়ির ৮ম তলায় সপরিবারে থাকতেন হারুন। সোমবার (২৬ আগস্ট) টিবিএসের প্রতিনিধিরা গিয়ে দেখতে পান, ১০ কাঠার ওপর নির্মিত বাড়িটির নেমপ্লেট খুলে রাখা হয়েছে। আটতলার ওপরে ডুপ্লেক্সের আদলে বাড়িটি করা হয়েছে। বাড়িটি এখন অনেকটার সুনসান।
টিবিএসের প্রতিনিধিরা বাড়িটিতে ঢুকতে পারেননি। তবে স্থানীয়রা জানান, হারুনের মালিকানাধীন ২৬/এফ নং বাড়িটির প্রতি তলায় দুটি করে ইউনিট আছে। এরমধ্যে কয়েকটি ছাড়া সব ইউনিটই বিদেশি কোম্পানির কাছে ভাড়া দেওয়া। তবে ভাড়া তুলত কে, তা বলতে পারছিলেন না কেউ।
সর্বশেষ বাড়িটিতে হারুন এসেছিলেন ৩ আগস্ট রাতে। ৫ তারিখ শেখ হাসিনার পতনের পর ৫, ৯ ও ১৬ আগস্ট মোট তিন দফায় বাড়িটিতে হামলা চালায় স্থানীয়রা। তার ফ্ল্যাট ভাঙচুর ও সিকিউরিটি গার্ডকে মারধর করা হয়।
হারুনের সঙ্গে যুক্ত সম্পত্তি উত্তরা ৩ নং সেক্টরের ৯ নং রোডের ১৪ নং বাড়ি। এ বাড়ির নাম হা-মীম। তবে সেখানে এখন কেউ থাকেন না।
ওই বাড়িতে কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষী কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি জানান, বিল্ডিংয়ের মালিক ব্যবসায়ী গোলাম হাসনাইন। বাড়িটি হারুনের কি না জানতে চাইলেও তিনি কিছু বলেননি।
দুদক সূত্রে জানা যায়, হিরণ নামে এক ব্যক্তির কাছে ৩২ কোটি টাকায় বাড়িটি বিক্রি করেন হারুন।
২০ নং রোডে প্রাইম লেক ভিউ নামক একটি ভবনে জিআর মিট ও গ্রিট নামের একটি ট্রাভেল এজেন্সি ও হোটেল রয়েছে, যা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। তবে ভবনটির মালিক গোলাম হাসনাইন বলে জানান রিসেপশনে থাকা কর্মকর্তা।
রিসেপশন থেকে হাসনাইনে ফোন নম্বর নিয়ে তাকে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে হোসাইনপুর গ্রামে প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট-এর মালিকানায় রয়েছেন হারুনের ভাই এ বি এম শাহরিয়ার।
অভিযোগ রয়েছে, ভাইয়ের নামে হলেও এ রিসোর্টটি হারুনের। ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর রিসোর্টের পরিবেশগত ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হলেও তা আর পরে নবায়ন করা হয়নি।
উত্তরার ৩ নং সেক্টরের ৭ নং রোডে ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি ১০ তলা মার্কেট আছে হারুনের। মার্কেটের নিচতলায় বেবি শপ নামে একটা বাচ্চাদের কাপড়ের দোকান রয়েছে। ২য় তলা থেকে ১০ম তলা পর্যন্ত খালি।
এছাড়া উত্তরার ৩ নং সেক্টরের ৯ নং রোডে ৭.৫০ কাঠার বাণিজ্যিক প্লট এবং ১৫ নং রোডে ৭.৩৪ কাঠা জমির ওপর নির্মানাধীন ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবনের সঙ্গেও যুক্ত সাবেক ডিবিপ্রধান।
উত্তরায় হারুনের অন্যান্য সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে—৫ নং সেক্টরের ৬ নং রোডের ১০ কাঠার দুটি প্লট, ১০ নং সেক্টরের ১১ নং রোডে একটি ৫ কাঠার প্লট এবং ১২ নং রোডের ৪ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় হারুনের কথিত মামা জাহাঙ্গীরের অফিস ও সোনারগাঁও জনপথ রোডে একটি ৬ তলা বাড়ি (২১ নং)।
এছাড়া উত্তরার ১১ নং সেক্টরের উত্তরা স্মৃতি কেবল টিভি লিমিটেডের পাশে একটি ৫ কাঠার প্লট আছে হারুনের। ওই প্লটটি স্টার কার সিলেকশন নামক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া।
এর বাইরে উত্তরার ১৩ নং সেক্টরের ৩ নং রোডে ইন্ডোরা নামক ৫ তলা বাড়ি, শাহ মখদুম এভিনিউয়ে প্লট নং-১২, সোনারগাঁও জনপথ রোডের ৭৯ নং হোল্ডিংয়ের জমির মালিকও হারুন। ৭৯ নং হোল্ডিংয়ের জমিটি জজ মিয়া নামক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেওয়া।
এছাড়া জমজম টাওয়ারের পাশে উত্তরা ১৩ নং সেক্টরে হারুনের কয়েক ডজন ফ্ল্যাটের মালিকানা রয়েছে। ১৪ নং সেক্টরের ২০ নং রোডের ১৭ ও ১৯ নং প্লট চারটি কোম্পানির শোরুম হিসেবে ভাড়া দেওয়া রয়েছে।
হারুনের উত্তরার বেশিরভাগ বাড়িই বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। পুলিশ ও দুদক সূত্রে জানা যায়, ‘বিপদে পড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এসব সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল’ করা হয়। এসব সম্পত্তি নামে-বেনামে অর্জন করেন হারুন।
গাজীপুরের সবুজপাতা রিসোর্টের মালিকানা, নিকুঞ্জের ৩ নং রোডে রিক্রুটিং ও ট্রাভেল এজেন্সিসহ অন্যান্য ব্যবসা ও সাভারের নন্দন পার্কেও হারুনের মালিকানা রয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বনানী কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে ২০ কাঠার প্লট দখল করে একটি কোম্পানির কাছে ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন হারুন
এছাড়া হারুনের মালিকানাধীন টঙ্গীর ২৭ মৌজায় ৮ বিঘা জমিতে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে জেএক্স জিওটেক্স লি. নামক প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীর আশুলিয়া মৌজায় ছায়াকুঞ্জ-৫ আবাসিক প্রকল্পের ভেতর ১২ বিঘা জমিতে রয়েছে নির্মাণাধীন আবাসিক হোটেল।
টেকনাফের রাজারছড়া এলাকায়ও হারুনের নামে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে জমি থাকার কথা জানা গেছে।
অর্থপাচারের অভিযোগ
সাবেক ডিবিপ্রধানের বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে। ডিএমপির একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনারেরর (এডিসি) সহায়তায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করতেন তিনি। ওই কর্মকর্তা এখনও ডিবিতে কর্মরত বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
রাজধানীর নয়াপল্টনে ওই ডিবি কর্মকর্তার ভাইয়ের মানি এক্সচেঞ্জের দোকান ও দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান আছে বলেও দুদক সূত্রে জানা গেছে। দুদক ওই এডিসির বিষয়ে অনুসন্ধান করবে বলে জানিয়েছে সূত্র।
হারুনের স্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্রে পাচারকৃত ১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এফবিআই কর্তৃক আটক করা হয়েছে বলেও টিবিএসকে জানিয়েছে দুদক সূত্র।