ঢাকার কাছাকাছি মনোমুগ্ধকর রিসোর্টগুলো অতি ব্যস্ততায় পর্যুদস্ত নগরবাসীকে দিয়েছে হাফ ছেড়ে বাঁচার উপায়। স্বল্প মেয়াদের ছুটি কাটাতে নিত্য বাড়তে থাকা শব্দ দূষণের শহর ছেড়ে তারা পাড়ি জমান প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে। প্রাত্যহিক জীবনের প্রায় সবগুলো সুবিধা থাকার ফলে প্রতিটি উৎসবেই এগুলোর চাহিদা বাড়ছে। সেদিক থেকে ঈদের দীর্ঘমেয়াদী ছুটি কাটানোর জন্য সেরা উপায় হতে পারে এই রিসোর্টগুলো। চলুন, জেনে নেয়া যাক এবারের পরিবার, আত্মীয় বা বন্ধুদের নিয়ে ঈদে ছুটি কাটানোর মতো ঢাকার কাছাকাছি কয়েকটি আকর্ষণীয় রিসোর্টের খোঁজ।
টঙ্গীর পুবাইলের প্রায় ৯০ বিঘা জমির উপর গড়ে ওঠা এই রিসোর্টটিকে ঢেকে দেয়া হয়েছে বাঁশ, পাটখড়ির বেড়া, দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি ও ছনের ছাউনি দিয়ে। রিসোর্টের নিজস্ব জমিতে ফলানো শাক-সবজি এবং বিলের মাছ রান্না করে পরিবেশন করা হয় দর্শনার্থীদের।
সারা দিন ঘুরে দেখতে খরচ করতে হবে ১৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। আর তাতে রাতে থাকা যোগ করলে মূল্য দাড়াবে ৪৫০০ থেকে ৫৫০০ টাকা। এখানে দর্শনার্থীদের নেয়া হয় গ্রুপে, আর সেই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা কমপক্ষে ১০ জনের হতে হয়।
এখানে আসতে হলে প্রথমে ঢাকা থেকে নরসিংদী কিংবা কালিগঞ্জের পথে পুবাইল কলেজ গেট আসতে হবে। পুবাইল কলেজ গেট থেকে এই রিসোর্টের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার।
গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরের গ্রামের চিনাশুখনিয়াতে অভিনয় শিল্পী-দম্পতি তৌকির আহমেদ ও বিপাশা হায়াত গড়ে তুলেছেন নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট। প্রায় ২৫ বিঘা জমির উপর দাড়িয়ে আছে রেস্তোরাঁ, সুইমিংপুল, কনফারেন্স সেন্টার, এবং প্রাকৃতিক উপকরণে সুসজ্জিত ১১টি এসি কটেজ। সিনেমার শুটিং-এর জন্য প্রসিদ্ধ এই জায়গাটিতে সুব্যবস্থা আছে মুভি থিয়েটার, বাচ্চাদের খেলাধুলা, মাছ ধরা ও নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর।
গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তায় এসে ক্যান্টনমেন্ট হয়ে কাপাসিয়ার দিকে যেতে হবে। এই পথে রাজাবাড়ী বাজারের দিকে প্রায় সাত কিলোমিটার যেয়ে, অগ্রণী ব্যাংক থেকে ডান দিকে দেড় কিলোমিটার পরেই এই রিসোর্ট।
ধরন ভেদে এর আবাসনগুলোতে খরচ পড়বে প্রায় ৬,৫০০ থেকে ২৮,০০০ টাকার মত। একদিনের প্যাকেজে সর্বনিম্ন ১০ জনের জন্য সর্বমোট খরচ বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা। গ্রুপ ছাড়া সাধারণ লোকজন ৫০০ টাকা টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকতে পারেন।
ঈদের ছুটিতে ২০২২-এর ২ মে থেকে ৯ মে পর্যন্ত কটেজ ভাড়ার উপর ২৫ শতাংশ ছাড় থাকছে।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় মেঘনা নদীর তীর ছুঁয়ে গড়ে উঠেছে এই রিসোর্টটি। এর সুইমিং পুলসহ নানা খেলাধুলার সরঞ্জাম ও দোলনার মত সুযোগ-সুবিধাগুলো অনেকটা ম্লান হয়ে যাবে এর প্রকৃতির স্নিগ্ধতার কাছে।
বিলাসবহুল রিসোর্টটির কটেজগুলোর সাধারণ খরচ ১১,০০০ থেকে ২৮,৫০০ টাকা। তবে ডে আউট প্যাকেজে রুম ভাড়া পড়ে সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা। আর রাতে থাকতে হলে ১১,৫০০ থেকে ১২,৫০০ টাকা গুণতে হয়।
যাত্রাবাড়ী পেরিয়ে মেঘনা ব্রিজের আগে হাতের ডানে গোলিতে নেমে চলে যেতে হবে ইসমানীর চর লোহার ব্রিজ। এই ব্রিজের নিচে বাইপাস সড়কটি নিয়ে যাবে সরাসরি সুবর্ণভূমি রিসোর্টে।
গাজীপুরের রাজাবাড়িতে পরিবার নিয়ে সুন্দর সময় কাটানো আরও একটি মনোমুগ্ধকর জায়গা এই সারাহ রিসোর্ট। প্রায় ২০০ বিঘার রিসোর্টটিতে তৈরি হয়েছে একদম স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে। বাংলো ও ভিউ টাওয়ার থেকে শুরু করে একটি শতভাগ নিখুঁত রিসোর্টের জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবি আছে এখানে।
এই বিলাসবহুল রিসোর্টে থাকতে হলে খরচ করতে হবে ৮,৫০০ থেকে ৬৬,০০০ টাকা। সারা বছর ব্যাপি ডে লং প্যাকেজের মূল্য থাকছে ৩০০০ টাকা।
রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজাবাড়ী বাস স্টপ থেকে ডান দিকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার ভেতরে সারাহ রিসোর্ট।
গাজীপুরের প্রখ্যাত ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ঘেঁষে নির্মিত এই রিসোর্টটির জায়গা প্রায় ৫০ বিঘা। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে শহুরে স্পোর্টস জোন, রেস্তোরাঁ, সুইমিংপুল, এমনকি ক্যাম্পিং-এর সুবিধা। এছাড়াও আছে ছনের তৈরী ঘর, ২১ টি কটেজ, মাছ ধরার ও নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা, সবজি ও ফুল-ফলের বাগান এবং গ্রামীণ পিঠার ব্যবস্থা। এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ পাখির কলরব, বাঁদুড়, শিয়ালের হাঁক, জোনাকি আলো এবং ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
ধরন ভেদে কটেজগুলোর ভাড়া ৮০০০ থেকে ১৭,০০০ টাকা। ৭-৮ জনের গ্রুপের জন্য ডে আউট প্যাকেজ জনপ্রতি ২,৫৩০ টাকা।
গাজীপুরের চৌরাস্তায় থেকে গাজীপুর ডিসি অফিস হয়ে তিন কিলোমিটার দূরে আমতলী বাজারের কাছেই ছুটি রিসোর্ট।
গাজীপুরের মাওনার অজহিরচালা গ্রামের প্রায় ১২০ বিঘা জমি নিয়ে তৈরি এই বিশালাকৃতির রিসোর্টটি। বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ, ঔষধি ও বনজ গাছে বিস্তীর্ণ এলাকা পরিণত হয়েছে সবুজের সমারোহে। এখানকার মুল আকর্ষণগুলো হলো ডেইরি ফার্ম, তেলের ঘানি, মৎস্য হ্যাচারি, কম্পোস্ট সার প্লান্ট, বায়োগ্যাস প্লান্ট এবং প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা প্রকান্ড কয়েকটি লেক। শীতকালে এখানকার সর্পিলাকারের তিনটি লেকে ভীড় করে হাজারো অতিথি পাখি।
ক্যাটাগরি অনুযায়ী এখানে থাকার জন্য খরচ হবে ৬,০০০ থেকে ৫৪,০০০ টাকা।
গাজীপুরের মাওনা থেকে পশ্চিমের রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে উত্তরে পাঁচ কিলোমিটার গেলেই পৌঁছানো যাবে ড্রিম স্কোয়ার রিসোর্টে।
মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলাস্থ কান্দিপাড়া গ্রামে পদ্মা পাড় ঘেষে গড়ে উঠেছে আকর্ষণীয় এই পর্যটন কেন্দ্রটি। প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই সারি সারি নারিকেল ও সুপারি গাছ ঘেড়া একটি মনোরম দীঘি স্বাগত জানাবে। পাড়ে বাধা নৌকা শান্ত জলে ভেসে বেড়ানোর হাতছানি দিবে। দীঘির এক পাড়ে আছে একটি ক্যাফেটেরিয়া আর অন্য দিকে রয়েছে ১৮ টি সারিবদ্ধ কটেজ। সেই কটেজগুলোতে যাওয়ার জন্য আছে আবার রঙিন দৃষ্টিনন্দন কাঠের সেতু।
ক্যাটাগরি ভেদে কটেজগুলোর ভাড়া ১৫০০ থেকে ১২,০০০ টাকা। এছাড়া শুধু দিনের অর্ধেক অংশ ঘুরে বেড়ানোর জন্য ৩০ টাকা টিকেট কেটে ঢোকা যায়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সূর্যনারায়ণপুর গ্রামটি অবস্থিত গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার ভাই সৈয়দ আলী মুরাদ এই গ্রামেই গড়ে তুলেছেন অঙ্গনা নামের রিসোর্টটি। প্রায় ১৮ বিঘা জমি সাজানো হয়েছে মাটির ঘর, বাগান, পার্ক, সুইমিং পুল, ব্যাডমিন্টন কোট, লেক, মসজিদ, ১৪ কক্ষ বিশিষ্ট একটি বাংলো এবং দুটি খেলার মাঠ দিয়ে।
রিসোর্টটির কটেজের একদিনের জন্য রুম প্রতি ভাড়া ৫ হাজার টাকা। অনুষ্ঠান বা পিকনিকের জন্য ভাড়া দিতে হয় ৭০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা।
রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টের এমপি চেকপোস্ট থেকে প্রায় সাত কিলোমিটারের পথ অঙ্গনা রিসোর্ট।
মোটামুটি বাজেটের রিসোর্ট হিসেবে গাজীপুরের সালনার এই রিসোর্টটি একটি দারুণ পছন্দ হতে পারে।
লেকে বুনো হাঁসের জলকেলি দেখতে দেখতে পুকুর পাড়ে বসে আড্ডা হতে পারে। অথবা বড় বড় খেজুর ও আমগাছের ছায়ায় সবুজ বেঞ্চগুলোতে বা ঘাসে বসে উদাস সময় কাটিয়ে দেয়া যেতে পারে। প্রতিটা মুহুর্তই পাথেয় হয়ে থাকবে সারা জীবনের জন্য।
এখানকার বাংলোর রুম গুলোতে থাকতে খরচ হবে ক্যাটাগরি ভেদে ৪০০০ থেকে ৬০০০ টাকা পর্যন্ত। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে শিমুলতলী সড়ক ধরে সালনা পৌছে বামে দুই কিলোমিটার গেলেই পাওয়া যাবে রিভেরি হলিডে রিসোর্ট।
গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরস্থ ফাউগান নামক এলাকায় প্রায় ১০০ বিঘা জমির উপর তৈরি হয়েছে জলেশ্বরী রিসোর্ট। সবুজের গালিচার মাঝে এখানে বানানো হয়েছে তিনটি সুসজ্জিত ভবন, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, সুইমিংপুল, রেস্টুরেন্ট, বিশাল লেক ও খেলার মাঠ।
ডে লং প্যাকেজের খরচ ক্যাটাগরি ভেদে ৫,০০০ থেকে ৬,৫০০ টাকা। রাতে থাকার প্যাকেজে খরচ হবে ৭০০০ থেকে ৮৫০০ টাকা। কমপক্ষে ১০ জনের গ্রুপের জন্য নির্ধারিত প্যাকেজ হচ্ছে জনপ্রতি ১,৭৫০ টাকা।
রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা পার হয়ে রাজেন্দ্রপুর বাজার থেকে ফাউগান বাজার পেরিয়ে কিছুটা সামনেই জলেশ্বরী রিসোর্ট।
ঢাকার কাছাকাছি এই ১০টি রিসোর্টে রয়েছে গ্রামীণ পরিবেশ এবং শহুরে সুযোগ সুবিধা। পরিবার, পরিজন, আত্মীয় বা বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে আসা স্মরণীয় করে রাখতে পারে ঈদের ছুটিকে। শুধু দারুণ কিছু মুহুর্তের অবতারণা করবে তা নয়; ছুটির পর কর্মজীবনে ফিরে যেতে নব উদ্যম সঞ্চার করবে শরীর ও মন জুড়ে। রিসোর্টগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে নিজের বাসায় থাকার মত অভিজ্ঞতা ও শতভাগ নিরাপত্তার সুবিধা। তাই দলবেধে বনভোজন ও রোমাঞ্চপ্রিয় ভ্রমণপিপাসুদের পাশাপাশি পরিবার নিয়ে বিনোদন সন্ধানী মানুষগুলোরও প্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে এই দর্শনীয় স্থানগুলো।