ইবনে বতুতা ছিলেন মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভ্রমণকারী, মুসলিম পর্যটক, বিচারক ও মালিকি মাজহাবে বিশ্বাসী এক ধর্মতাত্ত্বিক। যার সফরনামা রিহলা আজও ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। এই সফরনামায় উল্লেখিত আছে তার তিন দশক ধরে উত্তর আফ্রিকার বিস্তৃত এলাকা থেকে চীন পর্যন্ত ভ্রমণের বিস্তারিত কাহিনী। তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শুধু মাত্র ইতিহাসেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাই দখল করে নেই, বরং চতুর্দশ শতাব্দীতে মধ্যযুগীয় বিশ্ব কেমন ছিল- তা বুঝতেও সহায়তা করেছে। এমনকি তার ভ্রমণ শুধু ভৌগোলিক অনুসন্ধানই ছিল না; বরং এটি ছিল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পর্যবেক্ষণের এক বিস্ময়কর দলিল।
ইবনে বতুতা আনুমানিক ৭৫ হাজার বর্গমাইল এবং কিলোমিটারের চিন্তায় এক লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ৪০টিরও বেশি এলাকা ভ্রমণ করেছিলেন, যা খ্যাতনামা ইতালিয়ান অভিযাত্রী মার্কো পোলোকে ছাড়িয়ে গেছেন। উল্লেখিত এই ৪০টি অঞ্চলই দার আল ইসলামের অধীনে ছিলও। দার আল ইসালম অর্থাৎ সে সময় যতগুলো রাজ্য মুসলিম শাসকরা শাসন করতো তাদেরকে একত্রে বলা হতো দার আল ইসলাম। যেটা শুরু হয়েছিলো পশ্চিমের মরক্কো, স্পেন থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলা ও আরাকান ছাড়িয়ে বর্তমান ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত, আর বর্তমান রাশিয়ার কাজান শহর থেকে দক্ষিণে আফ্রিকার মাদাগাস্কার শহর অব্দি। মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম অভিযাত্রী বলে অভিহিত করা হয়ে তাকে।
একটা সময় জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে মরিয়া ইবনে বতুতা প্রথমেই হজ করার সংকল্প করেন। যদিও তার যাত্রা শুধু হজেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তিনি ইসলামের বিস্তৃত ভূখণ্ড আবিষ্কারেরও স্বপ্ন দেখেছিলেন।
ইবনে বতুতা ১৩২৫ সালে তানজানিয়া থেকে মক্কার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। তবে তার যাত্রা সহজ ছিল না, যাত্রাপথে বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হন তিনি। উত্তর আফ্রিকার মরুভূমির প্রখর উত্তাপ ও বিপদশঙ্কুল পরিবেশ থেকে শুরু করে ডাকাত দলের হামলার মুখে পড়তে হয় তাকে। তবে ভয়াল মরুভূমির উত্তপ্ত ঝড়, সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ, দুর্বৃত্তরের নির্যাতন, রোগ ব্যাধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এসব প্রতিকূল পরিবেশের সাথে মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যান তিনি। সবকিছু পেছনে ফেলে স্বপ্নাবিষ্টের মতো এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি।
প্রথমে তিনি উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়া, তিউনিস, মিশর ও লিবিয়া অতিক্রম করেন। আরবের পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন তিনি। এরপর তিনি সিরিয়া ও ফিলিস্তিন হয়ে মক্কায় পৌঁছান এবং প্রথম হজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু হজ সম্পন্ন করার পর তিনি ফিরে না গিয়ে আরও দূরে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
মিশরে পৌঁছে ইবনে বতুতা কায়রো শহরের জাঁকজমক দেখে হতবাক হয়ে যান। মধ্যযুগের অন্যতম বড় ও প্রাণচঞ্চল শহর ছিল কায়রো। সেখানে তিনি কিছুদিন আশ্রয় নেন এবং মিশরের সুফি সাধকদের কাছ থেকে দীক্ষা নেন, যা তাকে পরবর্তীতে বিচারক পদের জন্য যোগ্য করে তোলে। এ কারণে বিভিন্ন শাসক দরবারে তাকে সম্মানিত অতিথি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। মিশরে থাকা অবস্থায় তিনি আরও ভ্রমণপিপাসু হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি সিরিয়া ও ফিলিস্তিন অতিক্রম হয়ে মক্কায় পৌঁছান এবং হজ সম্পন্ন করেন। তার সঙ্গীরা মিশরে অবস্থান করলেও তিনি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। বিভিন্ন দেশের শাসক, গভর্নরের সহায়তায় তিনি তার ভ্রমণ চালিয়ে যান। হজ পালনের শেষে তিনি ইরাকে যান, সেখানে আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ পরিদর্শন করেন। এমনকি ইরানের ‘মোঙ্গল’ বংশের শেষ শাসক আবু সাঈদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এমনকি ইস্পাহান ও শিরাজের মতো শহর পরিদর্শন করে সেগুলোর সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতায় ভীষণভাবে প্রভাবিত হবার কথাও বর্ণিত আছে তার লেখায়।
এরপর (১৩২৭-১৩৩০) অব্দি পুরোটা সময় ধরে তিনি ধর্মীয় জীবন যাপন করেন। কিন্তু, হজ বা ধর্মীয় জীবন যাপন তার মূল উদ্দেশ্য না হওয়ায় তিনি আবারও জেদ্দা থেকে ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। লোহিত সাগর অতিক্রম করে এডেন বন্দরে পৌঁছান এবং সেখানে কিছুদিন ঘুরে আফ্রিকা উপকূল ধরে তানজানিয়া, আরব উপত্যকা ও পারস্যের দক্ষিণাঞ্চল, ওমান ও হরমুজ ঘুরে ১৩৩২ সালে পুনরায় মক্কায় ফিরে যান।
মক্কায় পৌঁছে তিনি দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক এবং মুসলিম পণ্ডিতদের প্রতি তার উদারতার কথা শুনে তিনি দিল্লি সফরের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, দিল্লির অনুসন্ধানে তিনি এশিয়া মাইনরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এ সময়ের যাত্রার বিস্তারিত বর্ণিত আছে তার লেখা বইতে, যা ইতিহাস বইগুলিতে সেলজুক সাম্রাজ্যের পতন এবং অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের নির্ভরযোগ্য সূত্র। তিনি যখন দিল্লি সফরে আসেন তখন দিল্লির সুলতান ছিলেন মুহাম্মদ বিন তুঘলক। তিনি দিল্লির সুলতানের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন ৩০টা ঘোড়া, কয়েকটি উটসহ বেশ-কয়েকজন দাসদাসী। এর প্রতিদানে সুলতানও তাকে ২০০ মুদ্রা উপহার দেন এবং সালতানাতের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করেন।
বেশ-কিছুদিন এখানে চাকরি করার পর সুলতান তাকে নতুন একটি চাকরির প্রস্তাব দেন দিল্লির দূত হিসেবে চায়নায় পাঠানোর। ইবনে বতুতা সুলতানের কথা অনুযায়ী, ১৫ জন বনিকসহ চীনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অন্যান্য যাত্রার মতো তার এ যাত্রাও সহজ ছিল না। দিল্লি থেকে চায়না যাবার পথে তাকে দুইবার ডাকাতদলের মুখে পড়তে হয়। পরনের জামা ছাড়া তার সবকিছুই ডাকাতি হয়ে যায়। এমনকি ডাকাতের হাত থেকে পালানোর সময় তিনি তার দলের সঙ্গীদের কাছ থেকেও আলাদা হয়ে যান। ঘটনার আট দিন পর তাকে এক ব্যক্তি উদ্ধার করে তার সঙ্গীদের কাছে নিয়ে যান।
এরপর তারা একসাথে দৌলতাবাদ পৌঁছায়। সেখান কিছুদিন অবস্থান করে কালিকটে পৌঁছায় এবং সেখান থেকে আবার চায়নার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু এবারও তাদের ভাগ্য সহায় হয়নি। সেদিন উপকূলে ভয়ঙ্কর ঝড়ে দুটো জাহাজ ডুবে যায়। কিন্তু একই সাথে থাকা তৃতীয় একটি জাহাজে তার সঙ্গীরা তাকে না নিয়েই চায়নার উদ্দেশ্যে চলে যায়। এরপর তিনি কিছুকাল কালিকৌটে থেকে একা একা চিনে সফর করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং এবার তিনি প্রথমে কালিকোট থেকে মালদ্বীপে যান এবং সে সময় মালদ্বীপের শাসকরা এরকম আরবি জানা একজন লোক খুঁজছিলও বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করার জন্য। তারপর ৯ মাস তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন মালদ্বীপে। এরপর তিনি মালদ্বীপ থেকে চায়না যান। এ সময় তিনি যাত্রা বিরতি নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আসেন।
১৩৪৬ সালে তিনি বাংলায় আসেন আর ওই সময় সিলেটে শাহজালাল (র:) নাম ডাক থাকায় তিনি তার সাথে দেখা করতে যান। যখন তিনি বাংলায় আসেন তখন বাংলা শাসন করছিলেন ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ। যিনি মূলত দিল্লি শাসকের বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলা শাসন করছিলেন। ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ নিজেকে দিল্লির গভর্নর হিসাবে নিজে দাবি করায় তার সাথে দেখা করতে যাননি ইবনে বাতুতা। তিনি বাংলায় অবস্থান করেন পৌনে দু মাসের মতো জুলাই এবং আগস্ট মাস। তিনি শাহজালালের কাছে তিনদিন আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি হবিগঞ্জ ও সোনারগাঁও শহরে যান ১৩৪৬ সালের ১৪ আগস্ট, এই যাত্রায় তার সময় লেগেছিল ১৫ দিন। তার বাংলা ভ্রমণের সিংহভাগ নদীপথ হলেও তারপরও তিনি তার লেখায় শহুরে জীবন যাপনের বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন। বিবৃতি করেছেন বাজার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক আধিপত্যর বিবর্তন।
ইবনে বতুতার লেখায় বাংলার চারটি অঞ্চলে ও তিনটি নদীর নাম পাওয়া যায়। অঞ্চল চারটি হলো সুদকাও, কামরু, হবংক, সনরকাও। সুদকাঁও শব্দটি মূলত চাটগাওয়ান শব্দের সাথে মিলিত এবং এ সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন এটি একটি বিশাল বন্দর ও সমুদ্রের নিকটবর্তী। এই বর্ণনা শুনে বোঝয় যায়, এটা বর্তমান চট্টগ্রামকে বুঝিয়েছেন। কামরু বা কামরূপ রাজ্য যা ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি অঞ্চল বা সিলেটের সীমান্ত অঞ্চলকে বলা হয়। এরপর যে শব্দটি আসে সেটা হলো হবংক, এটি মূলত বর্তমান হবিগঞ্জের ১০ মাইল দূরে হবংক টিলা নামে অভিহিত এবং সোনারগাঁও তৎকালীন মেঘনা নদীর তীরে বিখ্যাত রাজধানী।
তিনি যখন বাংলায় আসেন তখন বাংলায় সুফিবাদের ব্যাপক প্রভাব। সুলতান থেকে জনসাধারণ সবাই সুফিদের সম্মান করতেন। সুফিদের কথা বলতে গিয়ে তিনি তুলে ধরেন বাংলার দরবেশদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী শাহ জালাল উদ্দিনের কথা। যার মাজার বর্তমানে সিলেটে তার মাজার অবস্থিত। তার প্রসঙ্গে তিনি এক অলৌকিক গল্পের কথা বলেন। শাহ জালাল উদ্দিন গুহায় থাকতো। পশমের পোশাক জড়িয়ে লম্বা পাতলা গড়নের দৃঢ় মানুষ ছিলেন তিনি। ইবনে বতুতার আগমনের কথা তার জানার কথা না, অথচ তিনি তাকে অভ্যর্থনা দেওয়ার জন্য চারজন শিষ্য পাঠান। আর এই ঘটনাটি বিস্মিত করেছে তাকে। এখানেই শেষ নয়, তিনি জালাল উদ্দিনের পোশাক দেখে মুগ্ধ হন এবং মনে মনে এরকম একটা পোশাকের আশা করেন কিন্তু সংকোচে বলেননি। বিদায়কালে দরবেশ তাকে এই পোশাক উপহার দিয়ে তাকে অবাক করেন। শাহ জালাল উদ্দিন কিছু ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, যা চিনে গেলে সত্য হয়।
ইবনে বাতুতা সময় স্বল্পতা এবং বেশিরভাগ সময় নৌপথে কাটানোর কারণে তিনি ভালো করে বাংলার মানুষের জীবন পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি। তবুও বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি তুলে ধরেন বিভিন্ন সামাজিক প্রসঙ্গ। যেমন, বাংলা জুড়ে সুফি দরবেশদের প্রচার প্রচারণা, কামরূপে মুসলিম আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে চোখ থেকে এড়ায়নি হিন্দুদের তীর্থস্থান বা গঙ্গাস্নান। তিনি যখন বাংলায় আসেন তখন বাংলায় দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। তিনি নিজেই এক স্বর্ণ দিনারে আশুরা নামে পরমা সুন্দরী দাসী ক্রয় করে তার সহযাত্রী এক অল্পবয়স্ক ছেলেকে কিনেছিলেন দুই স্বর্ণ দিনারে। জাদু বা যোগবিদ্যার জন্য কামরূপ বরবারই প্রসিদ্ধ। ইবনে বতুতা সেই জাদুর প্রসঙ্গ ধরতেও ভুল করেননি। পরবর্তী আরেক ঐতিহাসিক আবুল ফজলের আইনি আকবরীতেও কামরূপ কামাখ্যার জাদু ও প্রয়োগ কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তিনি বাংলার বাজার ব্যবস্থার কথা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। তার লেখা অমর-গ্রন্থ তুফাতুন নুজ্জার ফি গরাইব ও আল আমাসার ওয়া আজাইবুল আফসারে বইয়ে তুলনামূকভাবে সে সময়ে বাংলার বাজার পণ্যের দাম আলোচনা করে তিনি। বইটির বেশিরভাগ পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল দ্রব্যমূল্যের বিস্তর আলোচনা। ইবনে বাতুতা বাংলায় এসে তিনি একটা উক্তি করেন, দীর্ঘ তেতাল্লিশ রাত্রি সমুদ্রের বুকে কাটিয়া আজ বাঙ্গালা দেশে পৌছালাম। এ বিশাল দেশে প্রচুর চাল উৎপন্ন হয়। সারা পৃথিবীতে আমি এমন কোনো দেশে দেখিনি, যেখানে জিনিসপত্রের মূল্য বাংলার চেয়ে কম দামে বিক্রি হয়।’
বাংলার বাজারে তখন এক রৌপ্য দিনারে আট মন ৩০ সের চাল পাওয়া যেত। সে সময় মিশরের দিরহাম ভারতে প্রচলিত ছিল। সেই হিসাবে এক রৌপ্য দিনারে পাওয়া যেত আটটি মুরগি, ১৫টি কবুতর। কিন্তু বাংলার সাধারণ মানুষের হাতে কখনও এক দিরহাম আসতো না, হয়তো পুরো জীবন কেটে যেত কড়ি নিয়ে। অন্ত:বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য ইঙ্গিত আছে তার লেখায়। মেঘনা নদীতে তিনি দেখেছেন অজস্র নৌকার পারাপার, অভ্যন্তরীণ ব্যবসা ছিল রমরমা।
মালদ্বীপে থাকা অবস্থায় তিনি বলেন, এখানকার মানুষ কড়ি সংগ্রহ করে বাংলাদেশ থেকে চাল আমদানি করতো। এক স্বর্ণ দিনারের মান ৪ লাখ করি। বাংলাদেশেও তখন কড়ির সাহায্যে লেনদেন হতো। এই বাংলাকে নিয়ে তার একটি বিখ্যাত উক্তি ‘দোজখ-ই-পুর নিয়ামত’ অর্থাৎ প্রাচুর্যে ভরপুর এক দোজখ এই বাংলা। বাংলার ভূমি ছিল উর্বর ও সমৃদ্ধি। তবে বাংলা আবহাওয়া মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা কিংবা অন্যান্য অঞ্চলে মানুষের জন্য প্রতিকূল। তার ওপরে রয়েছে নদীর প্রাধান্য আর বর্ষার পানি কিংবা শীতের কুয়াশা অসহনীয়। জলপথ ব্যবহার না করে ভ্রমণ কিংবা অভিযান অসম্ভব, বাংলা আসতে অনেকে রীতিমতো হিমশিম খেতেন অনেকে। যার কারণে তিনি উক্তিটি করেছেন বলে অনেক ইতিহাসবিদরা মনে করেন। আবার ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, সে সময় হিন্দু- মুসলিমের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জের ধরেই তিনি এমন মন্তব্য করতে পারেন।
বাংলা সফর শেষে তিনি চীনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং চীনের ব্যস্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্র গিয়ে পৌঁছান। বেইজিংয়ে জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় আদালত, চীনা সভ্যতা এবং শাসনের ধরন দেখে তিনি চমৎকৃত হন। চীনের সমাজের অনবদ্য জীবনযাপন পদ্ধতি ও রীতিনীতি নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করে লিখে রাখেন।
এই লম্বা যাত্রা শেষে ১৩৪৬ সাল সুমাত্রা, মালাবার ও পারস্য উপকূল অতিক্রম করে বাগদাদ ও সিরিয়া হয়ে মরক্কো ফিরে যান। মরক্কোর সুলতান আবু ইবনে ফারিজ নিয়োগ দেন আবু ইবনে জুজাইকে তার ভ্রমণ কাহিনী লিপিবদ্ধ করার জন্য। মৃত্যুর আগ অব্দি তিনি মরক্কোর একটি শহরে কাজি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
এনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, তিনি ১৩৭৮, ১৩৬৯ অথবা ১৩৭৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তার জন্মভূমি মরক্কোর তানজান শহরে তাকে সমাধি করা হয়। ইবনে বতুতার আনুমানিক এক লাক ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার ভ্রমণ করে খ্যাতিমান অভিযাত্রী মার্কো পোলোকেও ছাড়িয়ে গিয়ে বিশ্বে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে তিনি। তার ভ্রমণের বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ বর্ণিত আছে তার সফরনামায়। তার বিখ্যাত দুটি সফরনামা হলো ‘তুহফাতুন নাজ্জার ফি গারা-ইবিল আমসার’ ও ‘ওয়া আজা-ইবিল আসফার’।
তার বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ এবং বর্ণনা ১৪ শতকের বিভিন্ন অঞ্চলের ভূগোল, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারনা দেয়। বিশেষ করে তার লেখায় মধ্যযুগের ইসলামিক বিশ্বের স্বর্ণযুগের বর্ণনা রয়েছে। তার এই গ্রন্থ ভূগোল, ইতিহাস এবং নৃ-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখেছিল। কারণ তিনি পশ্চিমের অনেক অজানা স্থান এবং সংস্কৃতির বর্ণনা করেছিলেন, যা ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিল। তার বই বিশ্বের অনেক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এখনও বিশ্বের অনেক গবেষকরা বইটি এখনও পড়েন এবং রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেন।
ইবনে বতুতার বইয়ের একটি চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে পড়ার আগে পাঠকের মনে হতে পারে বইটি একজন মধ্যবিত্ত মুসলমানের বয়ানে লেখা, যিনি শরিয়া ও সুফিবাদের মধ্যে দোদুল্যমান। কিন্তু বইটি পড়তে গিয়ে দেখা যায়, ইবনে বতুতা কোনো গভীর দর্শন প্রচার করেননি। জ্ঞানের তৃষ্ণা একজন মানুষকে যে কোনো প্রান্তে নিয়ে যেতে পারে- ইবনে বতুতার বিস্ময়কর ভ্রমণই তার প্রমাণ। শুধু ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্য নয় বরং বিশ্ব সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করার জন্যও তিনি ভ্রমণ করেন।
আজও ইবনে বতুতা একজন মহান অভিযাত্রী হিসেবে পরিচিত, যিনি তার ভ্রমণের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছেন এবং মানব সভ্যতার বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তাভাবনায় প্রভাব বিস্তার করেছেন।