সভ্যতার ইতিহাস আসলে মানুষের উত্থান-পতনের ইতিহাস। প্রাচীন যুগে বহু নগর গড়ে উঠেছিল শিল্প, স্থাপত্য আর জ্ঞানের উৎকর্ষে। কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই শহরগুলোর কিছু হারিয়ে গেছে, কিছু ভেঙে পড়েছে, কিছু আবার মাটির নিচে চাপা পড়েছে। আজও সেসব শহরের ধ্বংসাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দ সাক্ষীর মতো। ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা চেষ্টা করছেন রহস্যের জট খোলার, তবুও অনেক প্রশ্নের উত্তর আজও অমীমাংসিত।
চলুন জেনে নেওয়া যাক এমনই কিছু হারানো শহরের কথা, যেগুলো আজও রহস্যে ঘেরা-
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো প্রথম লিখেছিলেন আটলান্টিস নিয়ে। তার মতে, আটলান্টিস ছিল এক সমৃদ্ধশালী নগররাষ্ট্র, যেখানে প্রযুক্তি ও স্থাপত্য ছিল অতুলনীয়। কিন্তু হঠাৎ কোনো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শহরটি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যায়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ আটলান্টিসের সন্ধান করছে। কেউ বলছেন, এটি ভূমধ্যসাগরে ছিল, কেউ আবার আটলান্টিক মহাসাগর বা ক্যারিবীয় অঞ্চলের দিকে ইঙ্গিত করছেন। আধুনিক গবেষণা স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করেও কোনো নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি। প্রশ্ন থেকেই গেছে আটলান্টিস কি সত্যিই ছিল, নাকি প্লেটোর কল্পনার অংশ এটি। যার রহস্য আজও অমীমাংসিত।
পেরুর আন্দিজ পর্বতের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে মাচু পিচু, ইনকা সাম্রাজ্যের বিস্ময়কর শহর। ১৫শ শতকে নির্মিত হলেও ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের নজরে এটি আসে ২০শ শতকের শুরুতে। পাহাড়ের চূড়ায় পাথর কেটে এমন নিখুঁত স্থাপত্য নির্মাণ এটাই প্রথম বিস্ময়। মাচু পিচুর আসল উদ্দেশ্য নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন এটি ছিল ইনকা রাজাদের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, কেউ বলেন ধর্মীয় কেন্দ্র। আবার অনেকের মতে, এখানে জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণা করা হতো। এত উচ্চতায় পানি সরবরাহ ও কৃষি ব্যবস্থা কীভাবে চলত, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে।
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে অবস্থিত মোহনজো-দারো ছিল প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার এক কেন্দ্র। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে এখানে গড়ে উঠেছিল পরিকল্পিত নগরায়ণ, ড্রেনেজ সিস্টেম, স্নানাগার যা আধুনিক সভ্যতাকেও অবাক করে। তবুও হঠাৎ করেই শহরটি ধ্বংস হয়ে যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন, হয়তো কোনো ভয়াবহ বন্যা, ভূমিকম্প বা আক্রমণের কারণে মানুষ শহর ছেড়ে চলে যায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শহর জুড়ে পাওয়া গেছে অনেক মানব কঙ্কাল-যাদের মৃত্যু হঠাৎ ও অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছিল। কিন্তু আসল কারণ কী ছিল, তার নির্দিষ্ট উত্তর আজো নেই।
খ্রিস্টপূর্ব ৭৯ সালে ইতালির পম্পেই শহর হঠাৎ করেই ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যায়। ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে মুহূর্তের মধ্যে শহরটি ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে। আজও প্রত্নতত্ত্ববিদরা শহরের ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে খুঁজে পান সেই সময়ের জীবনের নিদর্শন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ছাইয়ে ঢাকা দেয়াল, ঘরবাড়ি আর মানুষের দেহ প্রায় অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। ফলে আমরা জানি প্রাচীন রোমানদের জীবনযাত্রা কেমন ছিল। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়-কেন মানুষ এতদিন ধরে এই বিপজ্জনক আগ্নেয়গিরির পাদদেশে বসবাস করছিল, যখন তারা বিপদের আভাস পাচ্ছিল।
কম্বোডিয়ার জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাঙ্কর ওয়াট শুধু একটি মন্দির নয়, বরং এক বিশাল সাম্রাজ্যের অংশ। খেমার সাম্রাজ্যের সময় এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নগরকেন্দ্র। এখানে ছিল হাজার হাজার মন্দির, প্রাসাদ ও বসতি। কিন্তু ১৫শ শতকের দিকে হঠাৎ করেই শহরটি পতনের পথে যায়। কেউ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও খরার কারণে কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কেউ মনে করেন, আক্রমণকারীদের হাতে ধ্বংস হয়েছিল শহর। আজ অ্যাঙ্কর ওয়াট দাঁড়িয়ে আছে মহিমায়, তবুও এর পতনের আসল কারণ আজও রহস্যে ঢাকা।
প্রাচীন গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’-এ হোমার বর্ণনা করেছেন ট্রয় নগর নিয়ে, যেখানে ট্রোজান যুদ্ধ হয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ ভেবেছিল, ট্রয় কেবল কল্পকাহিনি। কিন্তু ১৯শ শতকে প্রত্নতত্ত্ববিদ হাইনরিখ শ্লিমান আধুনিক তুরস্কের এক স্থানে খুঁজে পান ট্রয়ের ধ্বংসাবশেষ।তবুও রহস্য এখানেই শেষ হয়নি। ট্রোজান যুদ্ধ কি সত্যিই হয়েছিল, নাকি তা কেবল কাহিনি? শহরের ধ্বংসের আসল কারণ কী ছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও সম্পূর্ণ পাওয়া যায়নি।