ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমের একটি ছোট দেশ বেলজিয়াম। ইউরোপের ক্ষুদ্রতম ও সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে এটি একটি। এই দেশটি সাংবিধানিক ভাবে রাজতন্ত্র। ১৮৩০ সালে বেলজিয়াম নেদারল্যান্ডসের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বেলজিয়াম ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ইউরোপের বড় বড় সব প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত। ব্রুসেল শহরটি বেলজিয়ামের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, ন্যাটো ও বিশ্ব শুল্ক সংস্থার সদর দপ্তর ব্রুসেল শহরে অবস্থিত। আমরা বলতে পারি বেলজিয়াম ইউরোপের প্রধান কেন্দ্রস্থল। অনেকে বেলজিয়ামকে ইউরোপের রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আকাশ থেকে বেলজিয়ামকে খুবই সুন্দর ও আকর্ষণীয় লাগছে। ছাঁয়াঘেরা সবুজের সমারোহ ও চারদিকের নান্দনিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবে যে কেহ। বিমান ল্যান্ড করার পর বাহিরে পা রাখা মাত্রই শীতল বাতাসে মুহুর্তে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো। বাহিরের তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রী। কিছুটা দৌঁড় দিয়ে চলে গেলাম বিমান বন্দরের ভিতরে। বেলজিয়াম সময় প্রায় ৪টা ১৫ মিনিটে ব্রুসেলস বিমান বন্দরে এসে পৌছঁলাম। এবারের ভ্রমনে সফর সঙ্গী ছিলেন রনি মোহাম্মদ, রনি হোসাইন, রাসেল আহমেদ, আজিজ ও মুক্তা ভাবি। আমাদের সব সময় ব্যস্ত রাখার জন্য সাথে ছিলেন রাসেল ভাইয়ের একমাত্র ছেলে রাহিম আহমেদ।
বিমান বন্দর পৌঁছে ব্যাগ থেকে শীতের পোষাক গায়ে জড়িয়ে নিলাম। আমাদের জন্য বাহিরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন বেলজিয়াম প্রবাসী আমাদের প্রিয় ফারুক আহম্মেদ মোল্লা ভাই। বিমান বন্দরের ভিতর থেকেই বাহিরটা দেখছি। আকাশটা কেমন যেন গম্ভির হয়ে আছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, মেঘলা আকাশ। মুহুর্তের মধ্যে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। রনি মোহাম্মদ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম এত অন্ধকার কেন? হাসি দিয়ে জানালেন রাত তো হয়ে এলো অন্ধকার তো হবেই। তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না এখানে প্রায় সাড়ে ৪টার মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে যায়। কিছু সময়ের মধ্যেই ফারুক মোল্লা ভাই আমাদের কাছে এসে পৌঁছে গেছেন। কুশল বিনিময় সেরে আমরা রওনা হলাম হোটেলের দিকে। আগে থেকেই ফারুক ভাই আমাদের জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। হোটেল থেকে সরাসরি চলে গেলাম ফারুক ভাইয়ের বাসায় সেখানে ভাবি আমাদের জন্য বাহারি দেশিয় খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ঘরোয়া আয়োজনে এত সুন্দর খাবার আয়োজনের জন্য ভাবিকে ধন্যবাদ দিতেও ভুল করিনি। খাবার আর আলোচনা করতে করতে ফারুক ভাইয়ের বাসাতে প্রায় রাত ১১টা বেজে গেছে। সকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাতে সবাই হোটেলে চলে এসেছি। অবশ্যই রাতেই সিডিউল ঠিক করে রেখেছি কোথায় কখন কিভাবে বেড়াতে যাবো।
আমার জানা মতে, বেলজিয়ামের কয়েকটি শহর বেশ বিখ্যাত। তার মধ্যে রাজধানী ব্রাসেলস, এন্তারপেন, ব্রুজ, ঘেন্ট, লিয়েশ, বাঙালি অধ্যাষিত এলাকা পোরতে দে নামোর ও মন্স অন্যতম। পরিকল্পিত নগরায়নের কারণে একেকটা সিটি দেখতে একেক রকম সুন্দর। পর্যটকরা মূলত সব সিটিতে ঘুরতেই পছন্দ করেন। ব্রাসেলস থেকে খুব সহজেই ট্রেনে করে সব সিটিতে যাওয়া যায়। বেলজিয়াম বেড়াতে গেলে ইউরোপের প্রায় সব দেশের লোকজনের সঙ্গেই আপনার দেখা হবে। এ দেশের লোকজন ফরাসি ভাষায় কথা বলেন। তাছাড়া জার্মান বা ডাচ ভাষাও চলে। তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটু সমস্যা হতে পারে, কিন্তু বড় বড় সিটিতে সবাই কম বেশি ইংরেজি বলতে পারেন।
বেলজিয়ামে এটাই আমার প্রথম সফর। সকালে উঠে দেখি জরুরি কাজে রনি মোহাম্মদ ভাই ও রাসেল ভাই খুব সকালেই বাহির হয়ে গেছেন। রনি ভাই আগে থেকেই রুবেল ভাইকে বলে রেখেছেন আমাকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে। তাই আমি আর রুবেল ভাই বাহির হলাম শহর দেখার জন্য। ব্রাসেলসে ট্রেন ভ্রমন সাশ্রয়ী ও সহজ তাই সারা দিনের জন্য ৮ ইউরো দিয়ে একটি টিকেট সংগ্রহ করলাম। এই টিকেট দিয়ে বাস, ট্রেন ও মেট্রোতে সারাদিন ভ্রমন করতে পারবেন।
প্রথমেই পরিচিত কিছু বাংলাদেশি প্রবাসীদের সাথে ঘুরে ঘুরে দেখা করলাম। তাদের সকলের অতিথিয়তায় মুগ্ধ, বিশেষ করে রুবেল ভাই। এত ব্যস্ত সময়ের মাঝেও তিনি আমাকে ৩ঘন্টা সময় দিয়েছেন। বিকেলে কাজ থাকার কারণে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে দিয়ে তিনি চলে গেলেন কাজে। আমি একা একাই ঘুরে বেড়িয়েছি আর চারিদিকের এত সুন্দর অত্যাধুনিক বিল্ডিং দেখেছি।
সারাদিন মেঘলা আকাশ সূর্যের দেখা নেই। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়ছে কিছু সময়ের মধ্যে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এলো। মানুষের জীবন প্রতিটি মুহুর্ত জমা হচ্ছে স্মৃতির খাতায়। বহুদিন পর এমন সুন্দর একটি দিন উপভোগ করলাম। মজার বিষয় হচ্ছে ছুটির দিনে ওপেন মার্কেট বসে এই শহরে। মানুষজন অনেক মজা করে বাজারও করে আবার খাবারও খায়। অনেকটা আমাদের দেশের মেলার মতো। সবজি থেকে সবকিছু পাওয়া যায়। বেলজিয়াম বেড়াতে গেলে আপনি ব্রুজ আর এন্তারপেন সিটি বেড়াতে ভুলবেন না। ব্রুজে যেমন আপনি অনেক খাল দেখতে পাবেন যেগুলো বাসাবাড়ির মাঝপথ দিয়ে চলে গেছে অন্যদিকে ইউরোপের এক অসাধারণ রেলস্টেশন এন্তারপেন।
বেলজিয়াম প্রবাসী বাংলাদেশি সামাদ বলেন, এন্তারপেন সিটি ডায়মন্ডের জন্য বিখ্যাত। সেখানে সারি সারি ডায়মন্ডের দোকান রয়েছে। তবে ডায়মন্ড কিনতে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ এমন কিছু পাথর আছে যা দেখতে ডায়মন্ডের মত মনে হয়। আসলে সেগুলি পাথরের তাই পরিচিত জন ছাড়া না কিনাই ভালো। বেলজিয়ামের মানুষ সাইকেল চালাতে পছন্দ করে। সাইকেল ভাড়া নিয়ে আবার ঘুরে ফিরে জমাও দিতে পারবেন। বেলজিয়ামে প্রায় পাঁচ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করছে। একেক জন একেক শহরে থাকার কারণে খুব কমেই দেখা হয়। বিশেষ কোন আয়োজন ছাড়া দেখা হয়না বলা যায়। তবে পোরতে দে নামোর এলাকায় বাংলাদেশিদের বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে ঘুরতে গেলে দু একজন বাংলাদেশির সাথে পরিচয় হয়ে যেতে পারে। তাই কোন বাংলাদেশি বেলজিয়ামে ঘুরতে আসলে পোরতে দে নামোর যেতে ভুল করেনা।
ধীরে ধীরে শীতের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বাহিরে বেশি সময় না থাকাই ভালো। রাতের খাবার শেষ করে করতে হবে। বেলজিয়ামে খাবারের কথা আসলেই বলতে হয় ফ্রেন্স ফ্রাইয়ের কথা। ফ্রেন্স ফ্রাই বা আলুভাজির কথা শুনলে মনে হবে এটা ফ্রান্সের কিন্তু তা নয় ফ্রেন্স ফ্রাই বেলজিয়ামের আবিস্কার। আর বেলজিয়ামের মানুষ এটা গর্ব করে বলেও। বেলজিয়ামের সব জায়গাতেই আপনি এ ফ্রাই পাবেন। ক্ষুধা লাগলেই খেয়ে নিতে পারেন। তাই তান্দুরী রুটির সাথে গ্রিল কাবাব আর ফ্রেন্স ফ্রাই দিয়ে শেষ করলাম রাতের খাবার।
বেলজিয়াম ছোট দেশ হলেও বৈচিত্র্যময় আর সৌন্দর্যের দিক থেকে অনেক বড় দেশ। অল্প সময়ে দেখার মত খুব সুন্দর একটি দেশ। মাত্র ৩দিনের এই সফরে অনেক কিছুই দেখা হলো। তবে আমাদের সবার প্রিয় ফারুক আহম্মেদ মোল্লা ভাইয়ের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি। অবশেষে বেলজিয়ামের মায়া কাটিয়ে সকলেই একসাথে রওনা হলাম ইউরোপের আরেক দেশ পর্তুগালের দিকে।