ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশের জন্য একটি যৌথ ও সমন্বিত অভিবাসন নীতির সংস্কার গ্রহণের ঠিক কয়েক মাস আগে ফ্রান্সে শুরু হয়েছে দেশটির জাতীয় অভিবাসন আইনের সংস্কার প্রক্রিয়া। সামগ্রিক অভিবাসন নীতি কঠোর করতে চায় প্যারিস।
২০২১ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে বসবাসরত অ-ইউরোপীয় নাগরিকের সংখ্যা ছিল জোটের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ। অর্থাৎ ব্লকের মোট ৪৪৭ মিলিয়ন বা ৪৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ২৪ মিলিয়ন বা দুই কোটি ৪০ লাখ অভিবাসী।
সবচেয়ে বেশি অভিবাসী আছেন জার্মানিতে, যেখানে সাড়ে ১১ মিলিয়ন বা এক কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি বিদেশি নাগরিক বসবাস করছেন। অপরদিকে ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনে মোট অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) শিগগিরই একটি নতুন অভিবাসন নীতি গ্রহণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও ২৭টি সদস্য দেশের এই বিষয়ে নিজস্ব আইন রয়েছে। এই আইনগুলো একে অপরের থেকে বেশ আলাদা।
সবচেয়ে কঠোর ডেনমার্ক ও সুইডেনে
ফ্রান্সের ডানপন্থি এবং অতি-ডান দলগুলো ডেনিশ অভিবাসন নীতিকে বারবার তাদের উদাহরণ হিসেবে নানা বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। ইইউতে সবচেয়ে কট্টর অভিবাসন নীতি আছে ডেনমার্কে।
অনিয়মিত উপায়ে দেশটিতে যাওয়া অভিবাসীদের সঙ্গে থাকা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং মৌলিক সুবিধা সীমিত করা হয়। দেশটির চাকরির বাজারও অভিবাসীদের জন্য উন্মুক্ত নয়। বিদেশি কর্মীদের জন্য অনুমোদিত পেশার নির্দিষ্ট তালিকা রয়েছে। যার ফলে দেশটির বিভিন্ন খাতে শ্রমিক ঘাটতি থাকলেও অভিবাসন যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের আরেক দেশ সুইডেন চলতি মাসের শুরুতে অভিবাসন আইন কঠোর করেছে। ওয়ার্ক পারমিটের আওতায় রেসিডেন্স পারমিট পেতে আগ্রহী অভিবাসীদের এখন থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে দুই হাজার ৪০০ ইউরো বেতনের চাকরিতে নিযুক্ত থাকতে হবে। যদিও বেশিরভাগ বিদেশিরা কম বেতনের সঙ্গে অনিশ্চিত চুক্তিতে কাজ করে থাকেন।
সুইডেনের অতি-ডানপন্থি এসডি পার্টি (সুইডেন ডেমোক্র্যাটস) থেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসনের ওপর তার জোটের প্রধান মিত্ররা অভিবাসনবিরোধী নানা রোডম্যাপ চাপিয়ে দিচ্ছে।
শিথিল করছে জার্মানি
জার্মানির জনসংখ্যায় বাড়ছে বার্ধক্য ও অবসরে যাওয়া লোকেদের সংখ্যা। দেশটির বিভিন্ন খাত সচল রাখতে প্রয়োজন অন্তত চার লাখ বিদেশি। এ লক্ষ্যে ২০০০ সালের পর প্রথমবারের মতো জার্মান সরকার সম্প্রতি অভিবাসন নীতি শিথিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর আওতায় পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত বসবাসের পর নাগরিকত্ব আবেদনের সুযোগ দেওয়া, দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখার বিধান রাখাসহ বেশ কিছু পরিবর্তন এনে দক্ষ অভিবাসীদের আকৃষ্ট করতে চাইছে দেশটি।
বৈধ অভিবাসনে আগ্রহী হলেও আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের জন্য থাকা সুবিধা সীমিত করতে চাইছে। এ লক্ষ্যে গত ৬ নভেম্বর রাজ্যপ্রধানদের সঙ্গে ঐক্যমতে পৌঁছেছে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস।
হাঙ্গেরির ‘দ্বৈতনীতি’
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ইউরোপের কট্টর অভিবাসনবিরোধী নেতাদের একজন। শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের না চাইলেও দেশটি বিদেশি শ্রমিকের ওপর নির্ভর করে। পোল্যান্ডের ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য।
হাঙ্গেরি সরকার আগামী বছরগুলোতে অর্ধ মিলিয়ন বা পাঁচ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করতে চায়। কারণ দেশটির অনেক নাগরিক পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে গণহারে পাড়ি জমানোর কারণে শ্রমিক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার কারণে দেশটিকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জন্য ইস্যু করা অস্থায়ী ওয়ার্ক পারমিট ভিসার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
অভিবাসন নীতি সহজ করছে স্পেন
অভিবাসীদের ইউরোপে আগমনের অন্যতম প্রধান দেশ স্পেন। আশ্রয়প্রার্থী এবং অন্যান্যদের রেসিডেন্স পারমিট প্রাপ্তির প্রক্রিয়াগুলোকে সহজ ও ত্বরান্বিত করতে ২০২২ সালে আগস্টে একটি বিশাল সংস্কার নিয়েছিল তারা।
নিয়ম অনুযায়ী, যেসব অনিয়মিত অভিবাসী কমপক্ষে দুই বছর স্পেনে থাকার প্রমাণ দিতে পারবেন তাদের ১২ মাস মেয়াদি একটি রেসিডেন্স পারমিট দেওয়া হবে। তবে শ্রমিক ঘাটতির খাতগুলো কর্মরত আছেন এমন শর্তপূরণ করতে হবে।
মৌসুমি কর্মীরা স্পেনে অবস্থানরত বিদেশি বাসিন্দাদের একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তারাও নতুন এই সংস্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে তাদের জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নতির জন্য এটি ভূমিকা রাখবে। মৌসুমি ভিসায় আসা লোকেরা চাইলে এখন থেকে চার বছর মেয়াদি ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই আইনের আওতায় অভিবাসী বছরে নয় মাস পর্যন্ত কাজ করার অনুমতি পান। তবে বছরে তিন মাসের জন্য তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে হবে।
এছাড়া পারিবারিক পুনর্মিলন ভিসায় আসা ব্যক্তিদের জন্য নতুন আইনে একটি মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। এখন থেকে পারিবারিক পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইস্যু করা রেসিডেন্স পারমিটে ওয়ার্ক পারমিট অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই সুবিধা আগে ছিল না।
ইতালির শক্ত সুর
জর্জা মেলোনির নেতৃত্বাধীন কট্টর ডানপন্থি ইটালীয় সরকার এই বছর শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের অভ্যর্থনা শর্তগুলোকে কঠোর করে এমন কয়েকটি পদক্ষেপের অনুমোদন দিয়েছে।
বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে নাবালকদের আবাসন ব্যবস্থা, আটককেন্দ্রে অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ নিয়মিত অনেক অভিবাসীকে বহিষ্কারের মতো বিষয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
যদিও দেশটির সরকার মৌসুমি ও স্পন্সর ভিসায় নিয়মিত অভিবাসনের জাতীয় কোটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কর্তৃপক্ষের মতে, অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্য নির্দিষ্ট খাতে শ্রমিক ঘাটতির অভাব মেটাতে গত বসন্ত থেকে নিয়মিত অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গ্রিসেও নানা ব্যবস্থা
স্পেন ও ইতালির মতো গ্রিসও তাদের অভিবাসন আইনে পরিবর্তন এনেছে। প্রায় ১০ বছর ধরে শরণার্থী আগমনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছে।
দেশটির রক্ষণশীল সরকার গণহারে বৈধতার পরিবর্তে নিয়মিতকরণের পদ্ধতিগুলো সহজ করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ, মিশরসহ বিভিন্ন দেশের অনিয়মিত অভিবাসীদের নিয়মিত করতে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও স্কিমও সই করেছে।
তবে আশ্রয়প্রার্থীদের দেশটিতে ভোগান্তির শেষ নেই। ২০২২ সাল থেকে আশ্রয়প্রার্থীরা তাদের আশ্রয় আবেদন জমা করতে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। একবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলে তাদের এক বছর পর্যন্ত আবেদনের সিদ্ধান্ত পেতে অপেক্ষা করতে হয়।
এছাড়া আবেদন চলাকালে আশ্রয়প্রার্থীদের অবশ্যই বন্ধ আশ্রয় কেন্দ্রে থাকতে হয় যেখান থেকে দৈনিক সীমিত সময়ের জন্য বের হওয়ার সুযোগ থাকে।
দেশটির আশ্রয় ও অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গ্রিসে বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সাত লাখ ৫০ হাজার অভিবাসী নিয়মিতভাবে বসবাস করছে। ২০২২ সালে এক লাখ ৫০ হাজারেও বেশি রেসিডেন্স পারমিট ইস্যু করা হয়েছে।
অভিবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মকে তাদের পিতা-মাতার সূত্রে বর্তমানে ১০ বছর মেয়াদি রেসিডেন্স পারমিট দেওয়া হচ্ছে। আগে এটির মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর।
সূত্র : ইনফোমাইগ্রেন্টস