একটি দেশের দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মূল চালিকা শক্তি দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সভ্যতা বিনির্মাণ ও সংস্কৃতির সংস্কারের প্রতিটি স্তরে যোগ্য লোকের উপস্থিতি দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে। আর এর মধ্যে সুপ্ত থাকে সেখানে বসবাসরত মানুষের মানসম্পন্ন জীবনধারণের বীজ। এ বিষয়গুলো বিচারে ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় দেশটি হলো ইংল্যান্ড। বিশ্ববিখ্যাত সব বিদ্যাপীঠের আশ্রয়স্থল হওয়ায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে দেশটিকে ঘিরে ক্যারিয়ার গঠন করার। ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আবেদনের পদ্ধতি, পড়াশোনার খরচ, স্কলারশিপসহ উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন সুবিধাগুলো জেনে নেওয়া যাক—
কেন ইংল্যান্ড সেরা গন্তব্য
ক্যারিয়ার গঠনে ইংল্যান্ড শিক্ষার্থীদের সেরা পছন্দ হওয়ার নেপথ্যের মূলে রয়েছে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যেকোনো র্যাঙ্কিংয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শীর্ষ ১০-এ থাকে দেশটির অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন ও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন প্রায়ই শীর্ষে থাকে। তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সেরা শহর বিবেচনায় এ বছরের শীর্ষ স্থানটি দখল করে আছে লন্ডন। ইংল্যান্ডের জীবনধারণের মানও উন্নত। বিশেষ করে আকর্ষণীয় স্কলারশিপগুলো অর্জনের মাধ্যমে পড়াশোনার পাশাপাশি সেই জীবনধারণের সান্নিধ্যে যেতে পারেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা।
শীর্ষস্থানীয় ইংলিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো
ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ, ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন, ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার, কিংস কলেজ লন্ডন, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক প্রভৃতি।
ইংল্যান্ডগামী ছাত্রছাত্রীরা যে বিষয়গুলো বেশি বাছাই করেন
আইন, ফিজিওথেরাপি, অ্যাকচুয়ারিয়াল সায়েন্স, ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা, মনোবিজ্ঞান, ডেটা সায়েন্স, মেডিসিন ও সার্জারি, কম্পিউটার সায়েন্স, বিজনেস স্টাডিজ ও বিজনেস অ্যানালাইটিকস।
সাধারণত সামার, অটাম ও স্প্রিং—এ তিনটি সময়ে ইংল্যান্ডের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির কার্যক্রম শুরু করে। সেখানে সামার মে থেকে জুন পর্যন্ত। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর অবধি থাকে অটাম এবং জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে চলে স্প্রিং অ্যাডমিশন। তবে ভর্তির মৌসুম নির্বিশেষ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার ন্যূনতম ৯ থেকে ১০ মাস আগে আবেদন শুরু করা উচিত।
ইংল্যান্ডে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে স্নাতকের আবেদনগুলো নেওয়া হয়। সাইটটির নাম ইউসিএএস (ইউনিভার্সিটিস অ্যান্ড কলেজেস অ্যাডমিশন সার্ভিস), যার ওয়েব ঠিকানা: https://www.ucas.com/undergraduate/applying-to-university। এখানে ছাত্রছাত্রীরা নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নথিপত্র আপলোডের পর আবেদন সম্পন্ন করে থাকেন।
অপর দিকে স্নাতকোত্তর কোর্সগুলোয় আলাদাভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইটে আবেদন করতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ এবং প্রার্থীদের মধ্যকার সাধারণ যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে ই-মেইল। শিক্ষার্থীদের কাগজপত্র যাচাই করে তাঁর ই-মেইল ঠিকানায় দরকারি নির্দেশনা পাঠানো হয়। এই ই-মেইলগুলোর মাধ্যমে সাধারণত অতিরিক্ত প্রয়োজনীয় কাগজ ও প্রবেশিকা পরীক্ষা বা সাক্ষাৎকারের কথা জানানো হয়।
সবদিক মূল্যায়নের পর ভর্তির সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলে শিক্ষার্থীকে অফার লেটার পাঠানো হয়। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে এটি কনফারমেশন অব অ্যাকসেপট্যান্স ফর স্টাডিজ (সিএএস) নামে পরিচিত। এই লেটারটিই ইংল্যান্ডের স্টাডি ভিসার আবেদনের প্রথম শর্ত। সিএএস পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়।
১। লন্ডনের বাইরের শহরের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে ১ হাজার ৩৩৪ পাউন্ড বা ২ লাখ ৯ হাজার ৩০ টাকা (১ পাউন্ড = ১৫৬ দশমিক ৬৯ বাংলাদেশি টাকা)। এটি ৯ মাসে দাঁড়ায় মোট ১৮ লাখ ৮১ হাজার ২৭২ টাকা।
২। লন্ডনে থাকলে মাসে ১ হাজার ২৩ পাউন্ড করে ৯ মাসে মোট ৯ হাজার ২০৭ পাউন্ড (১৪ লাখ ৪২ হাজার ৬৮৫ টাকা)।
ইংল্যান্ড দূতাবাসে সশরীর আবেদন জমা দেওয়ার আগে অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। এ তারিখ নেওয়ার জন্য এই লিংকে গিয়ে প্রার্থীর নিজস্ব ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। এই ই-মেইলেই পাঠানো হবে সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ।
দূতাবাসের ঠিকানা: ভিএফএস বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড, নাফি টাওয়ার, ৫৩, গুলশান অ্যাভিনিউ, গুলশান-১, সপ্তম তলা, ঢাকা-১২১২।
নির্ধারিত তারিখে ওপরের ঠিকানায় ভিসার আবেদনের প্রতিটি নথি মূল কপিসহ উপস্থিত হতে হবে। ভিসাকেন্দ্রে সাক্ষাৎকারসহ প্রার্থীর ছবি ও ১০ আঙুলের ছাপ নেওয়া হবে। সবশেষে ভিসা ফি গ্রহণপূর্বক একটি রসিদ দেওয়া হবে। ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট নিতে আসার সময় এই রসিদ সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে।
স্টুডেন্ট ভিসা ফি ৪৯০ পাউন্ড, ঢাকায় ভিএফএস (ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সার্ভিসেস) অনুসারে যা ৭৯ হাজার ২৬৫ টাকা। তবে প্রয়োরিটি ভিসার ফি ৫০০ পাউন্ড বা ৭৮ হাজার ৩৪৭ টাকা, যেখানে সুপার প্রয়োরিটি ভিসার জন্য দিতে হবে ৮০০ পাউন্ড (১ লাখ ২৫ হাজার ৩৫৬ টাকা)।
আবেদনের অংশ হিসেবে এই খরচের সঙ্গে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যসেবা সারচার্জ দিতে হয়। এর মাধ্যমে প্রার্থী ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভ করতে পারেন। এই চার্জ নির্ভর করে সাধারণত ভিসার মেয়াদের ওপর। এই লিংক থেকে এই সারচার্জ বাবদ ঠিক কত খরচ হবে, তা জানা যাবে।
সাধারণত হিউম্যানিটিস, আর্টস ও জেনারেল এডুকেশন কোর্সগুলো বেশ স্বল্প খরচের হয়। অন্যদিকে মেডিসিন ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়গুলো যথেষ্ট ব্যয়বহুল। স্নাতক অপেক্ষা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অধ্যয়ন ফি সাধারণত বেশি হয়ে থাকে, যা বিষয়ভেদে ভিন্ন হয়। অন্যান্য দেশের মতোই এমবিএ প্রোগ্রামগুলোর খরচ সর্বাধিক। স্নাতক ডিগ্রির বার্ষিক খরচ ১০ থেকে ২০ হাজার পাউন্ড এবং স্নাতকোত্তরে গড়পড়তায় খরচ হয় প্রতিবছর ১২ থেকে ২২ হাজার পাউন্ড। বার্ষিক ১৫ থেকে ২৪ হাজার পাউন্ড বাজেট রাখতে হবে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিএইচডি প্রোগ্রামগুলোর জন্য সম্পূর্ণ অর্থায়নের ব্যবস্থা থাকে।
জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে লন্ডনের বাইরে থাকা হলে বাজেট অনেকটাই সাশ্রয়ী হয়ে আসে। শেয়ার করা রুমে থাকার ক্ষেত্রে গড়ে আবাসন খরচ হতে পারে মাসিক ৫৫৪ পাউন্ড। মাসে সম্ভাব্য ইউটিলিটি বিল হতে পারে ৪০ থেকে ৫০ পাউন্ড। খাদ্য ও গৃহস্থালির জন্য রাখতে হবে ১৬০ থেকে ২০০ পাউন্ড। মুঠোফোন বিল ১৫ থেকে ৫০ পাউন্ড। স্টুডেন্ট পাস নিয়ে যাতায়াত করা হলে পরিবহনে ব্যয় হবে প্রায় ৩২ পাউন্ডের (৫ হাজার ১৪ টাকা) মতো।
টায়ার-৪ স্টুডেন্ট ভিসার মধ্যে চাকরিসংক্রান্ত সুবিধাগুলো হচ্ছে-
এগুলোয় সপ্তাহে গড়ে সর্বনিম্ন ২০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত আয় হয়। এ ক্ষেত্রে আয়করের বিষয়টি খেয়াল রাখা জরুরি। কেননা, খণ্ডকালীন চাকরির ওপরও ট্যাক্স ও জাতীয় বিমা ধার্য হয়।
মাসে গড়ে ১ হাজার ৪২ পাউন্ডের (১ লাখ ৬৩ হাজার ২৭৬ টাকা) বেশি উপার্জনকারীদের আয়কর দেওয়া বাধ্যতামূলক। আর সপ্তাহে ১৬৬ পাউন্ডের (২৬ হাজার ১২ টাকা) বেশি আয়কারীদের বিমা ফি পরিশোধ করতে হয়। মূলত নিয়োগকর্তারাই আয়কর ও জাতীয় বিমা ফি কেটে মজুরি দিয়ে থাকেন।
তথ্যসূত্র: ইউএনবি