মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই ভিডিও হোস্টিং প্ল্যাটফর্ম ‘ভিমিও’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অঞ্জলি সুদ। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফরচুন সাময়িকীর ‘ফোরটি আন্ডার ফোরটি তালিকায় নাম রয়েছে। ২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘তরুণ বৈশ্বিক নেতা’। তার সাফল্যের কথা তুলে ধরছি।
আমার বাবা ছিলেন চিকিৎসক। ‘আমেরিকান ড্রিম’ নিয়ে অভিবাসী হয়ে এ দেশে এসেছিলেন। খুব ছোট একটা এলাকায় ভারতীয় অভিবাসী পরিবারের সঙ্গে আমার বেড়ে ওঠা। চিকিৎসক হলেও প্রযুক্তি আর ব্যবসার দিকে ছিল বাবার ঝোঁক। সেটিই একসময় আমাকেও পেয়ে বসে।
আমার বন্ধু বা পরিবারের যে কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, অঞ্জলি ছেলেবেলায় কী হতে চাইত? সবাই এক বাক্যে বলবেন, ‘বস হতে চাইত!’ সত্যিই তাই। ছোটবেলা থেকে আমার ইচ্ছা ছিল এমন কিছু করব, যাতে সবাই আমার কথা শুনবে, আমার সিদ্ধান্তগুলো অনেকের জীবন বদলে দেবে, আমার কাজ সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এখন মনে হয়, আমি সেই ছেলেবেলার স্বপ্নের জীবনটাই যাপন করছি।
পড়াশোনা যখন প্রায় শেষ দিকে, অন্য তরুণদের মতো আমিও তখন একটি ভালো চাকরি খুঁজতে শুরু করি। ফিন্যান্স নিয়ে পড়েছি। তাই আমার প্রথম পছন্দ ছিল ব্যাংকিং খাত। প্রায় এক ডজন ব্যাংকে চাকরির আবেদন করেছিলাম সে সময়। কিছু জায়গায় ইন্টারভিউ দিই। কিন্তু সবখানেই বাদ পড়ি।
অথচ আমার ব্যাচের বন্ধুরা সবাই বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছিল। এখনো মনে আছে, এক ইন্টারভিউতে আমাকে বলা হয়েছিল, ‘ব্যাংকার হওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব তোমার নেই।’ ওই সময় ভীষণ খারাপ লেগেছিল, মন ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু পরে ওই কথাটিই আমাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। আমি আরও আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি খুঁজতে শুরু করি। একটা ছোট নতুন ব্যাংকে চাকরি পেয়েও যাই। আর ওটা দিয়েই শুরু হয় আমার দারুণ এক ক্যারিয়ার।
সেই ছোট চাকরিটাই আমাকে পরে জীবনে বড় বড় দায়িত্ব ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তৈরি করেছে। সেদিনের সেই ইন্টারভিউ থেকে আমি শিখেছি, আমি দেখতে কেমন বা আমার যোগ্যতা কতটুকু, এটা মাপার দায়িত্ব আরেকজনকে দিতে নেই। নিজের যোগ্যতা, নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে।
এখনো আমাকে দেখতে হয়তো ভিমিওর মতো একটা বড় কোম্পানির সিইও বলে মনে হয় না। কিন্তু এই সব কাজে আদতে কোনো প্রভাব ফেলে না। আমি ভাগ্যবান, এই বিষয়টা আমি আমার ক্যারিয়ারের শুরুতেই শিখে ফেলেছিলাম। এখন তাই নিঃসংকোচে অনেক জটিল সিদ্ধান্ত আর কঠিন কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারি।
ভুল স্বীকার করার মনোবৃত্তি থাকলে ভুল করার প্রবৃত্তি কমে যায়। একজন অল্পবয়সী সিইও হিসেবে আমি আমার ক্যারিয়ারে অনেক ভুল করেছি, এখনো করি। আমার মতে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে বোঝা এবং সেটা দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া কোনো দুর্বলতা নয়; বরং এটা এক দুর্লভ যোগ্যতা।
আজ থেকে ছয় বছর আগে আমি ভিমিওতে ডিরেক্টর অব মার্কেটিং পদে যোগ দিই। তিন বছর আগে সেখান থেকে আমাকে সিইও হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। যখন সিইওর দায়িত্ব পাই, তখন আমার বয়স কম ছিল, অভিজ্ঞতা কম ছিল, বিপণনের বাইরে অন্য খাতগুলোর ব্যাপারে ধারণাও কম ছিল। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতাগুলো একসময় আমার শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। আমার সমস্যাগুলো নিয়ে না ভেবে এগুলোর সমাধান বের করার জন্য আশপাশের সবার সাহায্য নিতাম, সবার মতামত গ্রহণ করতাম আর নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করতাম।
মাতৃত্ব আমাকে অনেক বেশি সাহসী আর সহানুভূতিশীল হতে শিখিয়েছে। আর এই দুটি বৈশিষ্ট্য প্রত্যেক উদ্যোক্তা, সংগঠক ও নেতার ভেতরে থাকা খুব জরুরি। একটা সময় ছিল যখন রাত–দিন কাজ করতাম। চাইতাম আমার আশপাশের সবাই আমার মতো করেই কাজ করুক। আরেকজনের ব্যক্তিগত জীবনে কী চলছে, সেসব দেখার সময় আমার ছিল না। এটাকে আমি গুরুত্বপূর্ণও মনে করতাম না।
এখন উপলব্ধি করি আমার সেই ভাবনা কতটা অসংবেদনশীল ছিল। যাঁদের সঙ্গে কাজ করছি, তাঁদের কাছ থেকে জানা, প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা এখন বুঝি। আগে ভোর ছয়টা কিংবা গভীর রাতে অনলাইনে মিটিং করতে চাইলে কেউ ‘না’ করলে খুব বিরক্ত হতাম। কিন্তু মা হওয়ার পর আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। দিন-রাত পরিশ্রম করলেই সাফল্য অনিবার্য নয়, সাফল্য নির্ভর করে ভারসাম্যেও।
একটি কথা আমি অনেক তরুণকেই বলি। যে পথে লোকে কম হাঁটে, সেই পথ ধরে এগোও। ব্যবসার বেলাতেও তা-ই। যেদিকে মানুষের মনোযোগ কম, সেদিক খুঁজে বের করো, সেখানে মনোযোগ দাও। হ্যাঁ, শুরুতে চ্যালেঞ্জ থাকবে; কিন্তু ওই প্রতিবন্ধকতা একবার উতরে গেলে পরের পথটা সহজ হয়ে যাবে, সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা পথ সহজ হবে; কিন্তু সেখানে উদ্ভাবনের সুযোগ থাকবে না, নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ থাকবে না। তাই বলব, তোমার স্বপ্নপূরণের পথ যত কঠিন হোক না কেন, সেটা ধরেই চলতে থাকো। পথ কঠিন হলেও লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে।
প্রতিবেদন : আদর রহমান, প্রথম আলো