শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৮ পূর্বাহ্ন

অল্প টাকায় পৃথিবী ঘুরবেন কীভাবে

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৩

আমাদের আগের প্রজন্মের জীবনের লক্ষ‍্য ছিলো চাকুরি করে বিয়ে করা, বাচ্চা নেয়া। তারপর সুন্দর একটা বাড়ি বানিয়ে নাতি-পুতি পেলে কবরে চলে যাওয়া। আমাদের বর্তমান প্রজন্মটা একটু ভিন্ন। আমাদের হাতে সহজে টাকা থাকে না। নিজের বন্ধু-বান্ধবের সাথে কথা বলে যা বুঝেছি, বেশীর ভাগই জমি-বাড়ি-অ‍্যাপার্টমেন্ট কেনায় অনাগ্রহী। কিন্তু, একটা বিষয়ে মিলেনিয়াল প্রজন্ম অসম্ভব উৎসাহী; সেটা হলো ট্রাভেলিং।

আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় আমার ক্ষুদ্র জীবনের সবচেয়ে বড় উপলব্ধি কোনটা, আমি নি:সন্দেহে বলবো— “বিদেশ ভ্রমণ হলো জীবনটাকে শেখার ও জানার সবচেয়ে বড় সুযোগ।”

আমরা ছোটবেলা থেকে বড় হই নিজের ছোট্ট একটা গন্ডির মাঝে। বাহিরের দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সংকীর্ণ। এর ফলে “জেনোফোবিয়া” বা অন‍্য জাতির প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়াটা অনেক স্বাভাবিক। বাংলাদেশের জনসংখ‍্যার বড় একটা অংশ ভারত অথবা পাকিস্তানের ঘোর বিদ্বেষী। এরা কোনদিন ভারত কিংবা পাকিস্তান ঘুরে আসলে হয়তো মনের ভাব পরিবর্তন করতো। আমাদের ধারণা, পশ্চিমা বিশ্বে সব মেয়ে-ছেলে সারাদিন অযাচিত মেলামেশা করছে। যে একবার পশ্চিমা বিশ্বে ঘুরে গেছে সে এরকমটা চিন্তা করবে না। ছোটবেলা থেকে আমরা একই ভাত-মাছ-মুরগী খেতে শিখি। এর বাহিরে খাবার আছে সেটা চিন্তাও করতে পারি না। বিদেশ ভ্রমণ করে যখন জাপানিজ রামেন কিংবা হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ চেখে দেখার সুযোগ হবে, তখন ঠিকই মানসিক দিগন্তের পাশাপাশি স্বাদের বর্ণালীটাও প্রসারিত হবে।

ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হলো মানসিকতার প্রসারণ। যে মানুষটা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায় সে তুলনামূলক কম বর্ণবাদী হয়, তার সাথে কথা বলে মজা এবং সে অপরকে ছোট করে দেখে না। এটা আমার একান্ত ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। তাই, আমি সবার কাছেই একটা বাণী প্রচার করি— “দয়া করে ঘুরতে যান। দেশের সীমানাটা ছাড়া সময় এখনই।”

কিন্তু কীভাবে? টাকা কই পাবো? বাংলাদেশী পাসপোর্টে ভিসা কীভাবে পাবো?

বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে অল্প খরচে ঘুরতে যাওয়ার কয়েকটা টিপস এই ব্লগে আলোচনা করছি। আমি অবশ‍্যই এই ব্লগ লেখার জন‍্য আদর্শ ব‍্যক্তি নই। আমার নিজের অভিজ্ঞতা নেহায়েত সামান‍্য। তাই, শুরুতেই নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাটা স্বীকার করে নিচ্ছি। আপনাদের কাছে এর বাহিরে কোন টিপস থাকলে কমেন্টে জানাবেন। আমি অবশ‍্যই তা যোগ করে দিবো। আরেকটা সতর্কবাণী- এই ব্লগটা বড়লোক/হানিমুন কাপল/আরামপ্রিয় ট্রাভেলার্সদের জন‍্য নয়। ইহা খেটে খাওয়া মানুষের বিদেশ ভ্রমণে টাকা বাচাঁনোর ধান্ধা।

টিপস-০১: দেশ নির্বাচনে পাসপোর্ট আর ভিসার কথা ভাবুন

প্রথম প্রথম ঘুরতে যাওয়াটা একটু কঠিন। কারণ, ভিসা আবেদন করার প্রক্রিয়াটা সবাই বুঝতে পারে না। তাই, ভিসা লাগে না এমন দেশে ঘুরতে যাওয়াটা শুরুর দিকে খুবই বুদ্ধিমান কাজ। ভিসা করতেও দেশ ভেদে ১ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগে। ভিসা বিহীন দেশে গেলে সে খরচটা বেঁচে যাবে।

বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের জন‍্য নিচের দেশগুলো ঘুরতে যাবার আগেই কোন ভিসা আবেদনের দরকার হয় না। এদের কোন কোনটিতে অনলাইন ফর্ম পূরণ করে যেতে হয়। কোনটাতে এয়ারপোর্টে নেমে একটা ফি প্রদান করতে হয়। আবার এই লিস্টটা প্রতি বছর পরিবর্তন হয়। তাই অবশ‍্যই কোন দেশে যাওয়ার আগে গুগলে চেক করা ভালো সিদ্ধান্ত।

এশিয়া: আজারবাইজান, ভূটান, জর্জিয়া, লাওস, ম‍্যাকাউ, মালদ্বীপ, নেপাল, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা, তিমুর, বালি (ইন্দোনেশিয়া), ফিলিপাইন

আফ্রিকা: বুরুন্ডি, কেপ ভার্ডে, জিবুতি, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, মালাউ, মোজাম্বিকা, সেইশেলিস, টোগো, উগান্ডা, ডোমিনিকা, গ্রেনাডা, হাইতি, মনসেরাত, সেন্ট কিটস, সেন্ট ভিনসেন্ট, টার্ক আইল‍্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল‍্যান্ড, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, লেসোথো, বেনিন

বাকী বিশ্ব: কুক আইল‍্যান্ড, ফিজি, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু, পালাউ, সামোয়া, তাভালু, ভানাতু, বাহামা, বার্বাডোস, হাইতি

(লিস্টটি কয়েকটি সোর্স থেকে নেয়া। দয়া করে এর উপর ১০০% ভরসা করবেন না। প্রতিটি দেশের ওয়েবসাইটে গিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।)

নবীন ট্রাভেলার্সদের প্রতিবেশী নেপাল, ভূটান দিয়ে শুরু করার অনুরোধ করবো। পাসপোর্টে কয়েকটা সীল পড়লে ভবিষ‍্যতে থাইল‍্যান্ড, সিংগাপুর যাবার ভিসা আবেদনে হয়তো সুবিধা হবে। খালি পাসপোর্টে প্রথম ভিসা পেতে একটু বেগ পেতে হতে পারে। বাংলাদেশীদের জন‍্য ভারত, থাইল‍্যান্ড, মালয়েশিয়া, বালিতে ঘুরতে যাওয়াটা তুলনামূলক সহজ।

টিপস-০২: এয়ার টিকেট কাটতে হবে অফ সিজনে

হট-সীজনে ঘুরতে গেলে টিকেটের দাম অনেক বেশী থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে ক্রিসমাস-ইস্টারের সময় টিকেট কিনতে গেলে ফতুর হয়ে যাবেন। যেকোন দেশের গ্রীষ্মকালে অনেক খরচ বেড়ে যায়। অফ-সীজন হলো ঘুরবার জন‍্য ভালো সময়। রমজান মাসে এয়ার টিকেটের দাম অনেক কমে যায়। আমার ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় থেকে সবচেয়ে কম রেটে টিকেট কাটা যায়।

আমার অভিজ্ঞতা বলি। এপ্রিল মাসে যুক্তরাজ‍্যে ইস্টারের বন্ধ। সবাই এপ্রিলের ১৯ তারিখে বাসায় থাকতে চায়। তাই, এই তারিখে আয়ারল‍্যান্ড ঘুরতে গেলে টিকেটের দাম অনেক বেশী পড়বে (ধরুন ১৯ হাজার টাকা)। এর পরের সপ্তাহে ২৬ তারিখ আবার টিকেটের দাম অর্ধেক হয়ে যায় (ধরুন ৬ হাজার টাকা)। কারণ সবাই তখন ছুটি শেষে কাজে ফিরে গেছে। কেউ আর ঘুরতে চায় না দেখে এয়ার লাইন কম্পানিগুলো দাম কমিয়ে দেয়। সবই ডিমান্ড-সাপ্লাই কার্ভের কারসাজি!

কয়েকটা বিষয় বিবেচনায় রাখা যায়:

১. ডিরেক্ট ফ্লাইটের খরচ বেশী পড়ে। বড় গ‍্যাপ সহকারে কানেকটিং ফ্লাইটের দাম তুলনামূলক কম। যদিও এতে অনেক সময় এয়ারপোর্টে বসে থাকতে হয়। আমি যদিও ব‍্যাপারটা খুবই এনজয় করি!

২. কোন দিন, কখন ফ্লাই করছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। শুক্রবার রাতে আর সোমবার সকালের ফ্লাইটগুলো বেশী দামী হয়। বেশ বাজে টাইমিং এর ফ্লাইটগুলো কমদামী হয়। ধরুন রাত ৩ টার ফ্লাইটের খরচ হয় সবচেয়ে কম। তাই সার্চ করার সময় এক/দুই দিন আগে পিছে সার্চ করে দেখুন। নিজের টিকেট নিজে অনলাইনে কাটতে শিখুন। ট্রাভেল এজেন্ট তার নিজের লাভ দেখবে, আপনার সুবিধার কথা তার জন‍্য সেকেন্ড প্রায়োরিটি।

৩. এয়ার লাইনের মাইলস পয়েন্ট কালেক্ট করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। আমার বন্ধুরা ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সের মাইলস পয়েন্ট পাওয়ার জন‍্য জীবন দিয়ে দেয়। মাইলস পয়েন্ট দিয়ে ফ্লাইট বুকিং এর ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। কখনো কখনো বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড পাওয়া যায়। সারাবিশ্বের এয়ার লাইন গুলো তিনটি বড় দলে বিভক্ত— one world, star alliance, sky team. একই দলের এয়ার লাইনে ট্রাভেল করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে একটার পয়েন্ট অন‍্যটাতে ব‍্যবহার করা যাবে। এই পয়েন্ট দিয়ে আপনি বিশ্বের বড় এয়ারপোর্টে ফ্রি বুফে ডাইন করতে পারবেন। আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ড থাকলে আপনি মুদি দোকানের বাজার করেও এয়ার মাইল পয়েন্ট কামাতে পারবেন। সুতরাং, একটু সার্চ করে এগুলো পড়ে দেখুন।

৪. বিশাল লাগেজসহ ট্রাভেল করাটা বেশ খরচের ব‍্যাপার। অনেক এয়ার লাইন ব‍্যাগের জন‍্য আলাদা চার্জ করে থাকে। ট্রাভেলার্স স্পিরিটে ব‍্যাকপ‍্যাকিং করাটা খুবই আনন্দের। জাস্ট একটা কাঁধের ব‍্যাগ নিয়ে ঘুরতে শিখুন। চার দিনের জন‍্য আপনার সাত জোড়া জুতো না নিলেও হবে। আমি আর বন্ধু ইফতি প্রায়ই এক প‍্যান্টে ঘুরতে বের হই। এতে লাগেজ হাল্কা হয়; ভ্রমণ হয় আরামদায়ক।

সুতরাং দেরী কেন? এখুনই সার্চ করুন পরবর্তী ট‍্যুরের টিকেটের জন‍্য।

টিপস-০৩: AirBnB নাকি Booking.com

উত্তর হলো- দুটোই! হোটেল ভাড়া ভ্রমণের একটা বড় খরচ। জায়গা ভেদে একটা সফরের ৩০% টাকা শুধু এই খাতেই চলে যায়। ব‍্যক্তিগতভাবে আমি হোটেলে টাকা ঢালার বিরোধী। কারণ, নতুন জায়গায় গেলে আমি হোটেল রুমে শুধু ঘুমাতে আর হাগতে যাই; অন‍্যসময় থাকি বাহিরে। সুতরাং, থাকার জন‍্য ট্রাভেলার্স হোস্টেল আমার প্রথম পছন্দ। যদি একা ভ্রমণ করেন তাহলে হোস্টেলে অনেক অপরিচিত মানুষের সাথে আড্ডা দিতে পারবেন। ভ্রমণের আনন্দ এতে বেড়ে যাবে বহুগুণে। AirBnB এবং Booking.com অবশ‍্যই ঘেঁটে দেখতে হবে। অনেক সময় অফার চলে। কম খরচে ভালো হোটেলও পাওয়া যায়। বুদ্ধিমান ট্রাভেলার সকল অপশন ঘেঁটে তারপর বেস্ট অপশন সিলেক্ট করেন। কিছু ব‍্যাপার মাথায় রাখবেন:

১. হোস্টেলের রিভিউ খারাপ হলে থাকতে যাবেন না। মালপত্র চুরিও হতে পারে। রিভিউ ব‍্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

২. AirBnB/Booking.com-এ সিটি সেন্টার থেকে একটু দূরে গেলে কমে বাসা পাওয়া যায়। দলে-বলে ট্রাভেল করলে ৪ জনের একটা বাসা নিয়ে সেখানে ৬-৭ জন ম‍্যানেজ করে থাকতে পারেন। কেউ সোফা, স্লিপিং ব‍্যাগে ঘুমাবে। এভাবেও খরচ কমানো সম্ভব।

৩. আমি প্রতিবার ঘুরতে গেলে নিজের বাসাটা খালি রেখে যাই না। বরং সেটা AirBnB-তে ভাড়া দিয়ে যাই। অনেক সময়ই আমি নিজের ভ্রমণের জন‍্য বিশাল একটা টাকা এভাবে তুলে আনি। নিজের রুম/বাসাটাকে একটু সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারলে গেস্ট পেতে সমস‍্যা হয় না। তবে আপনার বাসা যদি চিপা ঘিঞ্জি এলাকায় হয় তাহলে ঘটনা বিপরীত!

৪. অনেক হোস্টেল/হোটেল/AirBnB-তে থাকার সাথে সকালের নাস্তা অন্তর্ভূক্ত থাকে। এরকম জায়গায় থাকলে সকালে খাওয়ার খরচ কমে যায়।

৫. AirBnB বাসা গুলোতে রান্নার সরঞ্জাম থাকে। মুদি দোকান থেকে খাবার কিনে রান্না করলে বাহিরে খাবার খরচটা বাচাঁনো সম্ভব। বিশেষ করে ইউরোপে ঘুরতে গেলে এই কিপ্টামী করাটা বেশ দরকারী!

টিপস-০৪: বেশী মানুষ, কম খরচ

৫-৬ জনের দল নিয়ে ভ্রমণ করলে যাতায়াত, হোটেলের খরচটা অনেকের মাঝে ভাগ হয়ে যায়। একজনের জন‍্য খরচটা কমে আসে অনেক। তবে ২০ জনের দলে ভ্রমণ করাটাও আমি সাজেস্ট করি না। তখন সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নষ্ট হয়। নিজের সাথে একই মতাদর্শী বিশ্বাসী ৪-৫ জন খুঁজে বের করে একটি কাল্ট গঠন করুন। তাদের সাথে মরণের ভাব জমিয়ে বিদেশ ঘুরুন। আপনি খেতে ভালোবাসলে আরো একদল খাদক নিয়ে ঘুরুন। আপনি ফাইভ স্টার হোটেলে থাকতে চাইলে কিছু স্বচ্ছল বন্ধুবান্ধব ম‍্যানেজ করুন। আপনি ফ‍্যান্টাসী স্পোর্টস করতে চাইলে এড্রেনালিন জাংকি টাইপ মানুষ খুঁজে বের করুন। আপনি কফি খেতে ভালোবাসলে আরো কয়েকটা কফি প্রেমিক জোটান। আপনি রাতের অন্ধকারে রাস্তায় হাঁটতে ভালোবাসলে কয়েকজন বাউন্ডুলে খুঁজে বের করুন (আমি নিজে এই দলের সদস‍্য)। ভ্রমণের সবচেয়ে বড় সহায়ক হলো ঝামেলাবিহীন পার্টনার। আপনার বন্ধু যদি বেলা ১১ টা পর্যন্ত ঘুমায় তাহলে তাকে ঢাকার বাসায় ঘুম পাড়িয়ে একা ঘুরতে যান। কষ্ট করে প্লেনভাড়া দিয়ে অন‍্যদেশে গিয়ে ঘুমানোর মানে কি?

টিপস-০৫: বাদ দিন ট‍্যুরিস্ট স্পোর্টস

বাঞ্জি জাম্প, প‍্যারাগ্লাইডিং, স্কাই ডাইভিং, স্কুবা ডাইভিং এর মতো এক্টিভিটি করতে প্রায় ৫-৩০ হাজার টাকাও লাগতে পারে। তাই, কম খরচে ঘুরতে চাইলে এই গুলো এড়িয়ে চলুন। মনের মানুষের সাথে সুন্দর একটা জায়গায় বসে নাস্তার টেবিলে কফি খেলেই দেখবেন জীবনটা অনেক সুন্দর মনে হবে। এর জন‍্য ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটা পাহাড় থেকে লাফ দেয়ার প্রয়োজন হয়তো নেই।

টিপস-০৬: নো শপিং

এই মুহুর্তে আমার ব্লগের ফিমেল রিডার অর্ধেক হয়ে গেলো। ইয়েস! শপিং না করলে টাকা বাচাঁনো যায় অন্তত ২৫%! সবাই ঘুরতে গিয়ে গুষ্টির সবার জন‍্য জিনিসপত্র কিনে আনে। স্টুডেন্ট ট্রাভেলারদের এইটা করার প্রয়োজন দেখি না। চিন্তা করে দেখুন, আপনার এক ট্রিপের শপিং-এর টাকা দিয়ে হয়তো আরেকটা ট্রিপের ৫০% ফান্ড হয়ে যেতে পারে। একবার ট্রাভেল করা শুরু করলে এভাবে ভাবা শুরু করবেন।

টিপস-০৭: ইম্পোর্টার হয়ে যান

আপনি হয়তো আমেরিকা যাচ্ছেন। সেখান থেকে কেউ একটা ল‍্যাপটপ কিনে আনতে চাচ্ছে। backpackbang এর সদস‍্য হয়ে আপনি অন‍্য কারো জন‍্য এই কাজটা করে দিতে পারেন। আপনি নিজে একটা কমিশন পাবেন। সেটা দিয়ে হয়তো আপনার ট্রিপের দুই দিনের থাকার খরচ উঠে যাবে। অনেকেই ফেইসবুকে গ্রুপ খুলে ভারত থেকে নিয়মিত জিনিসপত্র কিনে এনে দিচ্ছে। আমার এক ছোটভাই এইভাবে অন্তত ১০ বার ভারত ঘুরে এসেছে। আপনিও পারবেন।

টিপস-০৮: বাহিরে কফি খাওয়াটা কমান

ট্রাভেল করার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, “কফি অসম্ভব দামী একটা পানীয়।” এককাপ কফি খেতে মোটামুটি ২০০-৫০০টাকা খরচ হয়। অনেকেই দিনে ৩ কাপ পর্যন্ত কফি বাহিরে খায়। যদি আপনি কফি ছাড়া থাকতে নাই পারেন তাহলে AirBnB/হোটেলে নিজেই কফি বানিয়ে খান। নেশার কাজ হবে। কিন্তু, প্রতিবেলা বাহিরে বসে কফি না খেলে দেখবেন আপনার টাকা বাচঁবে দিনপ্রতি ১ হাজার। অনেকের জন‍্যই কফি আবার একটা ফ‍্যাশন। ইন্টাগ্রামে কফির ছবি না দিলে ট্রিপ সাকসেসফুল হয় না। আমাকেও সেই কাতারে ফেলতে পারেন। তবে, একজন পাপী হিসেবেই বলছি, কফি বাহিরে না খেলে অনেক টাকা বাচেঁ।

টিপস-০৯: পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব‍্যবহার করতে শিখুন

এয়ারপোর্টে নামলেন। সেখান থেকে হোটেল যাবেন ট‍্যাক্সি কিংবা উবার করে! অনেক টাকার ব‍্যাপার। খুজেঁ দেখুন বাস/ট্রেন আছে কিনা। ইউরোপে ঘুরতে গেলে ট্রেন/ট্রাম ব‍্যবহার করাটা একদম আবশ‍্যক। সেখানে “ডে-টিকেট” বলে একটা ব‍্যাপার আছে। একটা নির্দিষ্ট টাকায় সারাদিন শহরের যেকোন জায়গায় আনলিমিটেড ঘুরতে যাওয়া যায়। ভারতে বাস/ট্রেনে ঘোরার খরচ অনেক কম। থাইল‍্যান্ডে গ্র‍্যাব অ‍্যাপ দিয়ে বাইকে চড়ে ঘোরাটা বুদ্ধিমানের কাজ। যেকোন শহরে যাবার আগে TripAdvisor.com ঘেঁটে দেখে নিন বিভিন্ন যানবাহনের খরচ। ট‍্যাক্সি আর উবার সাধারণত সবচেয়ে খরুচে বাহন। এগুলো এড়াতে পারলে খরচ বাচঁবে অনেকখানি। পায়ে হাঁটা বেশ সস্তা; খরচটা শূণ‍্যের কাছাকাছি। যারা পায়ে হাঁটে তাদের হৃদরোগ কম হয়, সাধারণ জ্ঞানটাও বেশী থাকে।

টিপস-১০: বী রেসপন্সিবল

অনেক ট্রিপে কয়কজন ব‍্যক্তি থাকেন যারা ঝামেলা বাধাঁয়। কেউ মোবাইল হারিয়ে ফেলে, কেউ বাইক চালাতে গিয়ে অ‍্যাকসিডেন্ট করে বসে, কেউ ধুমধাম অসুস্থ হয়ে যায়। এই সবকিছুতেই অযাচিত টাকার খরচ হয়। ঘুরতে গিয়ে একটু রেসপন্সিবল আচরণ করলে এগুলো এড়ানো যায়। আপনার স্কুবা ডাইভ দেয়ার ইচ্ছে নেই। বন্ধুদের প্রেশার ডাইভ দিলেন। বাকী ট্রিপ বমি করে জ্বর বাধিঁয়ে একাকার। আপনার আর বন্ধু উভয়েরই মজা মাটি। অসুস্থ মানুষজন নিয়ে ট্রাভেল করাটা জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। তাই, আপনার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, দরকারী জিনিস, মোবাইল চার্জার, কসমেটিকস ইত‍্যাদি সাথে করে নিয়ে যান। তাহলে বিদেশে গিয়ে সেটা কেনার জন‍্য অর্থ ব‍্যয় করতে হবে না।

এই দশ পয়েন্টের সবগুলো একজন পালন করতে পারবে না। আমি নিজেও টিপস-০৫ এবং ০৮ পালন করি না। মানুষ বিচিত্র প্রাণী। একেকজনের টেস্ট একেকরকম। কেউ এয়ার ট্রাভেলে টাকা খরচ করতে চায়, কেউ হোটেলে, কেউ কফি শপে। আপনি আপনার বন্ধুদের সাথে ট্রিপের আগে একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিন কোনগুলো ফলো করা আপনাদের জন‍্য যুক্তিযুক্তি। আমার কথা কোরান-হাদিসের বাণী নয়। চাইলেই সেটা অমান‍্য করতে পারেন। কেউ দোযখের আগুনে পোড়াবে না। খালি পকেটের টাকা পুড়বে!

শেষ করবো আবার ভ্রমণ নিয়ে আমার ফিলোসফি কপচিয়ে। খাবার আর গবেষণার পর ট্রাভেলিং আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জীবনসঙ্গী নির্বাচনের সময়ও হয়তো আরেকজন ট্রাভেলারকেই খুজেঁ বের করবো। এই জীবনটা অনেক ছোট; পৃথিবীটা অনেক বড়। সুতরাং, আজকেই প্ল‍্যান করুন কই যাবেন! জীবনে মিনিমান ২৫টা দেশ না ঘুরলে আপনার বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ডিগ্রী বাতিল হয়ে যাবে (মিথ‍্যা কথা; এগুলো আমার ছড়ানো প্রপাগান্ডা)। যে নিজের দেশের বাহিরে যায় নাই তার চিন্তা-ভাবনা অনেক সময়ই খুব সংকীর্ণ হয়। অন‍্যদিকে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহুর্তগুলোর একটি হলো যখন আপনি বিশাল একটা পাহাড়ের উপরে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা দীগন্ত বিস্তৃত প্রান্তের তাকিয়ে আছেন। যে মানুষটা বিদেশ ঘুরে বেড়ায় তার মনটা ওই পাহাড়ের মত সুবিশাল হয়।

টিপস বলা হলো, ফিলোসফি বলা হলো। কিন্তু আপনি মনে মনে ভাবছেন, “শালার পুত! তোমার মতো কাড়িকাড়ি টাকা আমার ব‍্যাংকে পড়ে নাই।” সত‍্যি কথা হলো, ঘোরার জন‍্য জীবনের অনেক কিছুই আমি বিসর্জন দিয়েছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খেটে বেড়াই যাতে করে পরবর্তী ট্রিপের জন‍্য টাকা জমানো যায়। আমার জীবনের দর্শনটা পরবর্তী ট্রিপ পর্যন্তই বিস্তৃত। এর বাহিরে খুব বেশী দেখতে পারি না। না খেটে, কষ্ট না করে টাকা কামানোর উপায় আমার জানা নেই, ভাই। পরিশ্রম করার বিকল্প নেই জীবনে। অনেকেই এই ব্লগের নীচে বেশ সাধারণ প্রশ্ন করবেন ভ্রমণ সম্পর্কে। তাদের বলছি, “গুগলে ঘেঁটে দেখেন। গুগলে ঘাঁটা কষ্ট যে করতে রাজি না সে কীভাবে অন‍্য একটা দেশ ঘেঁটে দেখবে?”

শেষটায় এই ব্লগের উপরের ছবিটায় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ছবি। ভূটানের পারো নগরীর চেলেলা-পাস নামক জায়গায় তোলা। বিশাল একটা পাহাড়ের উপর বসে বিশালতার পানে তাকিয়ে আছি। মৃত‍্যুর আগে এই ছবিটা বার বার দেখবো। এই জীবনটা নিয়ে কোনদিন আফসোস হবে না আমার।আপনার আফসোস হবে কি?

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com