বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৩০ অপরাহ্ন
Uncategorized

অমর প্রেমের স্মৃতি সৌধ: তাজমহল

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২১

প্রেমের সমাধি তাজমহল। শ্বেতশুভ্র এই সৌধ অমলিন ভালোবাসার প্রতীক। দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনায়ক থেকে সেলিব্রেটি সকলেই নিজেদের প্রেমকে বর্ণময় করে রাখতে এই সৌধের সঙ্গে এক ফ্রেমে জড়িয়ে নিতে চেয়েছেন যুগে যুগে। বিল ক্লিনটন, ওবামা, মুশাররফ, ট্রাম্প থেকে ইংল্যান্ডের রাজকুমার কে যে নেই, তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। প্রেমের এই সৌধ শুধু দেশের নয়, বিশ্বের অবশ্যই দর্শনীয় স্হানগুলী মধ্যে অন্যতম। তাই তাজমহল জীবনে একবার না দেখলে হয়তো অসমাপ্ত থেকে যাবে আমাদের এই ক্ষণিকের মনুষ্য জীবন।

কবি কল্পনায়  আঁকা তাজমহলের সঙ্গে বাস্তবের আঙিনায় দাঁড়িয়ে তাজমহলের অপরূপ সৌন্দর্য  দু’চোখে দেখা এক অভাবনীয়  ব্যাপার। ঐতিহাসিক স্হান – স্হাপত্যভূমি-প্রত্নস্হল -স্মৃতিসৌধ  চিরদিন আমার  কাছে অত্যন্ত আদনীয় ও আকর্ষণীয়।

এই অমোঘ আকর্ষণে সুযোগ পেয়েই চলে গিয়েছিলাম  দিল্লীতে সপরিবারে এক শারদীয়া দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিনে। বেশ কয়েক বছর আগে। সঙ্গে ছিলেন মা ও ছোট শ্যালিকা,মোট পাঁচজন। আজ তিনি বেঁচে নেই। চাকরিতে যোগদানের পর বলেছিলেন পারলে একটু  আগ্রা দেখাস‌। মায়ের ‘সাজাহান’ কবিতার প্রতি অসাধারণ আকর্ষণ ছিল। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়  আবৃত্তি করে আমাকে শুনিয়েছিলেন। আজো শুধুই অমলিন স্মৃতি । বাঁকুড়া থেকে নীলাচল এক্সপ্রেসে রাত ১০টায়  উঠে পড়লাম। রিজার্ভেশন করা ছিল আগে থেকে। যে যার সিট খুঁজে নিয়ে  বসে পরলাম। শুরু হলো গল্প আর গল্প। জীবনে এটাই ছিল প্রথম দিল্লি যাওয়া।

রাত বাড়ছে ক্রমশ। বেশ গতিতে এগিয়ে চলেছে আমাদের ট্রেন। একটু পরে রাতের খাবার পর্ব সারলাম। রাতে ঘুমানোর সময় ভেসে উঠতে লাগলো দিল্লী-আগ্রার নানা বর্ণময় ইতিহাস যে গুলো ছোটবেলায় শুধুই  পাঠ্যবই -এ  পড়েছিলাম। আগ্রার প্রতি  আমার অমোঘ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু রবীন্দ্রনাথের  ‘সাজাহান’ কবিতা।  বাংলার স্যারের উদাত্ত কণ্ঠে শোনা কবিতা আজ  নিজের মানসপটে  জেগে উঠলো নতুন ভাবেই। ‘সাজাহান ‘কবিতার মর্মবাণী যেন শুনতে পেলাম। পরের দিন সকাল হলো। আমরা এসে পৌঁছলাম বিহারের পাটনা। সকালে টিফিন সেরে জানলা দিয়ে বাইরের পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। একটা-একটা  অপরিচিত  জনপদ অতিক্রম করে আমরা কানপুরে পৌঁছলাম। তারপরের দিন দুপুরে পৌঁছলাম দিল্লী। সময় লাগলো ৩৭/৩৮ ঘন্টা।

এবার গন্তব্যস্হল দিল্লীর ওয়েস্ট প্যাটেল নগরে আমার শ্যালিকার বাড়ি। ওরা ওদের গাড়ি করে নিয়ে গেল বাড়িতে। থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম বলে আমি একেবারেই চিন্তাভাবনা মুক্ত। শুধুই ঘুরবো, এই মনোভাব জেগে উঠলো। শ্যালিকার স্বামী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অফিসার  হওয়ায় নানা জায়গায় থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটা বাড়তি পাওনা। ফলে পরিকল্পনা শুরু করলাম, দিল্লী  ঘুরে আগ্রায় থাকবো তিন দিনেক তারপর দিল্লি ফিরে  দেরাদুন-মুসৌরি-হরিদ্রার সহ গাড়োয়াল। ১৫দিনের বেশ লম্বা চওড়া সফর। খাওয়া-থাকার ব্যাপারে কোন মাথাব্যাথা ছিল না। পুরো সফরের দায়িত্ব পালন করলো দিল্লীর আত্মীয়-স্বজন। ওদের আন্তরিকতা ছিল হৃদয় ওপড়ানো। মাঝে মাঝে একটু অস্বস্তি লাগছিল ও আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগছিল। কোথাও আমাকে একটি টাকা খরচ করতে দেয়নি। দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম এবং বাঙালিদের সুপ্রাচীন বসতি দিল্লির পুরাতন কালিবাড়িও জানুকিপুরি (বহিঃ দিল্লি) গেলাম, অনেক বাঙালি পুজোয় এসেছেন নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে। এরপর গেলাম জানকীপুরি,এটাকে বহিঃ দিল্লি বলে।

ওখানকার বাঙালিদের কাছে পেয়ে ভালো লাগলো। পুরো কলোনিতে শুধু বাংলা-ভাষাভাষির মানুষজন। বেশ সময় কাটছিল একেবারে মসৃনভাবে,  করোলবাগে বাজার করে  ফিরে আসলাম। রাতের খাবার পর্ব সারলাম। নানা ধরনের ভাবনা মনে জায়গা করে নিল। দিল্লি মানে তো একটা শহর, একটা দেশের রাজধানী শুধু নয়। আরো অনেক কিছুই। পরতে পরতে বনেদিয়ানার ছাপ ও অতীত ঐতিহ্যের এবং  ইতিহাসের অপার বিস্ময়। তবে নয়া দিল্লি নয়, পুরোনা দিল্লিতে খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে ভারত আত্মার খোঁজ। একান্ত নিভৃতে অতীতের দিকে ফিরে ইতিহাসের  হলুদ পাতা উলটে- পালটে দেখতে চেষ্টা করলাম।

 

ছবিঃ লালকেল্লা

পরেরদিন শীতের সকালে বেরিয়ে পড়লাম দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দেখতে। ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্হাপত্য লালকেল্লা, পুরাতন দিল্লির চমৎকার একটি সুপ্রাচীন স্হাপত্য জামা মসজিদ, কুতুবমিনার, যন্ত্ররমন্ত্রর, লোদী গার্ডেন, অক্ষয়ধাম মন্দির। একেএকে দেখতে শুরু করলাম। শুরুতে পৌঁছলাম কুতুব মিনারে। ঈষৎ হেলানো, নির্মাণ সময় ১১৯৯। ১৪ মিটার পরিধি যুক্ত জায়গা জুড়ে রয়েছে।

 

ছবিঃ কুতুব মিনার

কুতুব মিনারের  শীর্ষ বিন্দু দেখতে গিয়ে আমার মাথাটা  পিছনে অনেক খানি হেলে গেল।  অবাক হলাম সেই সময়ে গঠন শৈলী  নিজের চোখে দেখে। এর রূপকার কুতুব উদ্দিন আইবক, ৩৬৭টি ধাপ  আছে। লতাপাতা-ফুল দিয়ে নানান ধরনের নকশা করা।  মাাঝে মাঝে  আরবি ভাষায় লেখা, পড়তেই পারলাম না। পাঁচ তলার মিনার, ব্যালকোনি আছে। মুগ্ধ হলাম। এরপর গেলাম  হুমায়ুনের সমাধি দেখতে। পুরনো কেল্লার কিছুটা দূরে, হুমায়ুনের সমাধি, যা তৈরি করেছিলেন প্রয়াত সম্রাটের  স্ত্রী। বিশাল এলাকা জুড়ে সুসজ্জিত বাগিচার মধ্যে লাল বেলেপাথর ও অন্যান্য  মারবেল দিয়ে তৈরি অপূর্ব নির্মাণশৈলীর উদাহরণ এই সমাধি। ইউনেস্কো কর্তৃক এই সমাধি ভবনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে।

মধ্যদিল্লির গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্যস্হান শান্তিবন, শক্তিস্হল, লোটাস বিজয় ঘাট, বীরভূম, লোটাস টেম্পল, পদ্মমন্দির নামে খ্যাত, মহাত্মা গান্ধীর সমাধিক্ষেত্র, জায়গাটি নিরিবিলি, শান্ত, মনোরম পরিবেশ, খুব ভালো লাগলো। রাজঘাট ঘুরে প্রয়াত শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নামে সংগ্রহশালাটি ঘুরে বিকেলে পৌঁছলাম নতুন দিল্লির প্রাণকেন্দ্র পার্লামেন্ট ভবন, ইন্ডিয়াগেট। এই  গেট প্রথম বিশ্বযুদ্ধের  সময়  শহীদ জওয়ানদের স্মারক হিসাবে ই়়ংরেজরা এটি তৈরি করেন।

তোরণের নীচে পাক-ভারত যুদ্ধে নিহত জওয়ানদের স্মারক হিসাবে রয়েছে অমর জওয়়ান জ্যোতি। অসাধারণ স্হান। গর্বে বুক ভরে গেল। এরপর পার্লামেন্ট ভবন, নর্থব্লক ও সাউথ ব্লক ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সন্ধ্যার সময় জায়গাটি বেশ জমজমাট।বহু মানুষের সমাগম ঘটে। অনেককেই পরিবার নিয়ে ঘুরতে দেখলাম। পুরানো ও নতুন দিল্লি জুড়ে ছড়িয়ে আছে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন। এত কম সময়ে ভালো করে দেখা সম্ভব নয়। তবু একটা চেষ্টা করলাম মাত্র। বেশ কিছু সময় এই মনোরম পরিবেশে সময় কাটানোর পর সন্ধ্যায় ফিরলাম লালকেল্লায়। এখানকার সংগ্রহশালা জুড়ে অসাধারণ নিদর্শন গুলো দেখতে শুরু করলাম, সন্ধ্যায় লাইট আ্যন্ড সাউণ্ড অনুষ্ঠান দেখলাম।মন ভরে গেল। চাঁদনী চক বাজারে কিছু কেনাকাটা করার পর ক্লান্ত দেহে ফিরলাম আত্মীয়ের বাসায়।রাতের খাবার পর্ব সারলাম এবং ব্যালকণিতে বসে রাতের দিল্লির মনোমুগ্ধকর রূপ দেখতে লাগলাম।

পরের দিন সকালে আমাদের গন্তব্যস্হল আগ্রার তাজমহল। ভোর সাড়ে পাঁচটায় রওনা দিলাম আগ্রার দিকে। দিল্লি থেকে দূরত্ব প্রায় ২২০কিমি। ভাড়া করা গাড়িতে চলছি।মন জুড়ে নানা ভাবনার স্রোত বয়ে চলেছে। মুঘল ইতিহাস আজও বিস্ময় এখানে। আর সব সৌধের সেরা আকর্ষণটি দেখে বলে উঠতে কোন বাধা নেই ‘বাহ তাজ’। অনেকটা বিজ্ঞাপনী কায়দায়। ভাবছি ! দেশ-বিদেশের পর্যটকদের বেশিরভাগ কোন অমোঘ আকর্ষণে ছুটে আসেন যুগ যুগ ধরে? আগ্রা যেন রূপকথার স্বপ্নপুরী। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা স্হাপত্য কীর্তিগুলি মনকে মুগ্ধ করবেই। ঘন্টা তিনেক বাদে পৌঁছলাম ফতেপুর সিক্রি ভারত সম্রাট আকবরের বর্ণময় রাজধানী। ফতেপুর সিক্রির ইতিহাস যেন এক রূপকথার স্বপ্নপুরী।

 

ছবিঃ ফতেপুর সিক্রি

ভারত সম্রাট আকবর-অফুরন্ত তার ধনদৌলত, ক্ষমতা। কিন্তু নেই কোন সন্তান। শেষে আগ্রার অনতিদূরে এই ফতেপুর সিক্রি গ্রামের এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ফকির শেখ সেলিম চিস্তির আশীর্বাদে অম্বর মহিষী যোধাবাইয়ের সন্তান হলো। ফকিরের নামানুসারে নাম রাখলেন সেলিম। মুঘল-ই–আজমের দৌলতে-এ কাহিনী এখনো বহুল প্রচারিত। এই ফতেপুর সিক্রিতেই রাজধানী স্হানান্তরিত হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর এখান থেকেই শাসনকার্য চালাবার পর তীব্র জলাভাবের কারণে এই স্হান পরিত্যক্ত হয়। দু-মাইল লম্বা, এক মাইল চওড়া শহরের তিনদিকে উঁচু পাঁচিল। ঊষার প্রথম সূর্যকিরণের সঙ্গে লাল বেলেপাথরে তৈরি ফতেপুর সিক্রি এক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়। প্রথম দর্শনেই অতীত ইতিহাস যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠলো। শাহি দরওয়াজা দিয়ে ঢুকেই দেখলাম প্রথমেই দেওয়ান-ই-আম। সামনে প্রশস্ত উদ্যান। একটুখানি এগিয়ে ইবাদতখানা। সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক প্রার্থনাস্হল। আকবর সব ধর্মের গুণীজনদের এখানে আমন্ত্রণ করতেন। চতুষ্কোণ কৃত্রিম জলাশয়ের কেন্দ্রে প্রস্তর নির্মিত বেদি। তানসেন, বৈজুবাওরা–সরস্বতীর বরপুত্ররা এখানে সুরের সাধনা করতেন। পাশের ঝরোখায় দাঁড়িয়ে একবার ছবিটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। নিজের অজান্তেই কখন যেন পৌঁছে গেলাম সেই যুগে। ভাবতেই রোমাঞ্চিত হলাম। দেওয়ান-ই-খাস ছিল সম্রাটের মন্ত্রণা কক্ষ। চতুষ্কোণ এই ইমারতটি বিখ্যাত তার কেন্দ্রস্হ স্তম্ভটির জন্য। হিন্দু আর মুসলিম স্থাপত্যের এক অভূতপূর্ব মিলনের ফসল এই অনিন্দ্যসুন্দর প্রাসাদ। পিরামিডের আকারের পাঁচমহল নির্মিত হয়েছিল গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের হাত থেকে বাঁচার জন্য। একেএকে দেখলাম ঐতিহ্যবাহী যোধাবাই প্রাসাদ, সুনহারা মকান, বীরবলপ্রাসাদ। স্হাপত্যের বিচারে প্রতিটি প্রাসাদ অভিনবত্বের দাবি রাখে। কালের প্রকোপ সত্ত্বেও অতীতের কারুকার্যের নানান চিহ্ন আজও বর্তমান। মন ভরে উঠলো ফতেপুর সিক্রি দেখে। ফতেপুর সিক্রির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ মসজিদ চত্বরের সেলিম সিস্তির মকবরা। প্রশস্ত চত্বরের মাঝখানে লাল পশ্চাদপটে যেন শ্বেতশুভ্র পদ্ম।  ইতিহাসের এক বর্ণময় নিদর্শন। মুগ্ধ হলাম।এরকম সম্ভ্রমপূর্ণ  স্হাপত্যকীর্তি বিরল। গুরুর স্মৃতিতে মঠ-মসজিদ–মকবরা তো কতই  নির্মিত হয়েছে, কিন্তু এমনি খুব  কমই দেখা যায়। ফতেপুর সিক্রির প্রবেশপথের আকর্ষণ আমাকে মুগ্ধ করেছে সবচাইতে বেশি। এখানকার শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ, বুলন্দ দরওয়াজা। মিনারের  জগতে যেমন কুতুব মিনার, মকবরার জগতে যেমন তাজমহল,  তেমনি দরওয়়াজার দুনিয়ায় বুলন্দ। ইংরেজরদের তৈরি মুম্বাইয়ের গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া অথবা দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না। বুলন্দ দরওয়াজা-অসাধারণ স্হাপত্য আর অনুপম ভাস্কর্যের এক সার্থক সমাহার।  আকবর তার দাক্ষিণাত্যের ও গুজরাতের জয়কে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য বুলন্দ দরওয়াজা নির্মাণ করেছিলেন। আমার  মনে একটা বিস্ময় জেগেছিল, সম্রাট এই বিজয়তোরণকে শহরের প্রবেশপথের উপর কেন নির্মাণ করেন নি? জামা-ই-মসজিদের দক্ষিণ প্রবেশপথেই এটি নির্মিত। আমার মনে হয়েছে, বিজয়তোরণ শহরের প্রবেশপথেই ভালো মানায়। এর কারণ জানলাম, ধর্মপ্রাণ সম্রাট তার ঐহিক সাফল্যের জয়মাল্য শ্রদ্ধার সঙ্গে নামিয়ে রেখেছেন পরমেশ্বরের পদতলে– অর্ঘ্য হিসেবে! এখানেই যে অন্তিম শয়ানে শুয়ে আছেন তাঁর গুরু সেলিমচিস্তি। সামনের সিঁড়ির উচ্চতা যোগ করলে বলন্দ দরওয়াজার উচ্চতা দাঁড়ায় ১৭৬ ফুট।

দুপুরের খাওয়া পর্ব সংক্ষেপে সেরে পড়ন্ত বিকেলে ফতেপুর সিক্রি থেকে ৩৭ কিমি দূরে আগ্রায়  উদ্দশ্যে রওনা দিলাম। মন জুড়ে শুধু তাজমহল। তাঁর অতীত আর বর্তমান আমাকে গভীর ভাবে আচ্ছন্ন করতে থাকলো। আগ্রার অতীত ইতিহাস অন্বেষণে  ইতিহাসের পাতায় ফিরে এলাম। কিছু মলিন স্মৃতি একটু ঘাটতে লাগলাম আনমনে। গাড়ি চলছে। বিভিন্ন জনপদভূমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোতে লাগলাম। একটা ভাবনার স্রোত বয়ে চলেছে দেহ-মনে।

আগ্রা হল এক ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্হান। উত্তর ভারতের উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত যমুনা নদীর তীরবর্তী স্হান  আগ্রা প্রাচীন মুসলিম ভারতের রাজধানী ছিল, তৎকালীন প্রশাসনিক সমস্ত কাজ নিয়ন্ত্রিত হতো আগ্রা থেকে।  মূলত মোগল রাজত্বকে  কেন্দ্র করেই আগ্রার প্রসিদ্ধি সর্বাধিক। মহাভারতের যুগে, এমনকি তার ও পূর্বে মহর্ষি অঙ্গিরার নামোল্লেখ প্রসঙ্গে আগ্রার কথা উল্লেখিত হয়, কিন্তু এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সুলতান সিকন্দর লোদির হাত ধরেই।  পরবর্তীতে তাঁর পুত্র ইব্রাহিম লোদী মোগল সম্রাট বাবরের কাছে পরাজিত হলে এই শহরের সুবর্ণযুগের সূত্রপাত ঘটে। তখন এই শহরের নাম ছিল ‘আকবরাবাদ’। পরবর্তীকালে এই অঞ্চলটি মারাঠাদের হস্তগত হলে এর নামকরণ করা হয় আগ্রা। ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক মূল্যের জন্যই এই স্হানটিকে চোখে একবার দেখার ইচ্ছাও লোভ ছিল প্রবলতর। এই কথা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম।

গাড়ি তাজমহল রোডের এক জায়গায় রেখে দেওয়া হলো। তারপর সামান্য কিছু ঘুরে  হোটেল অভিমুখে আমরা সবাই গেলাম। সন্ধ্যা নামছে মন্দর মন্থরে। আগেই হোটেল বুকিং ছিল। ফলে নিজ নিজ রুমে জিনিস রেখে ফ্রেস হলাম। টিফিন সেরে আগ্রা শহর পরিক্রমায় চললাম।বনেদি শহর। পরতে পরতে বনেদিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হলো। অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির  মেলবন্ধন এই প্রাচীন শহর। পরিকল্পনা ছিল রাত্রে ব্যালকোনি থেকে পুরো শহর ও রাতের তাজমহলের রূপ প্রাণভরে দেখব। নটা নাগাদ ঘুরে এলাম হোটেলে। হোটেলের ভৌগোলিক অবস্থান অসাধারণ।ফলে মনের ইচ্ছা পূরণ হবে বলে উপলব্ধি করলাম। রাতের খাবার পর্ব সারলাম এবং সবাই মিলে সুন্দর ব্যালকোনিতে এসে জড়ো হলাম। ইতিহাসের বর্ণময় আভিজাত্যের মোড়কে মোড়া শহর আগ্রা। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত চরাচর দূরে  সাদাবেল ফুলের কুঁড়ির মতো তাজমহল যেন প্রস্ফুটিত হয়ে আছে।মনভরে গেল।আহা! কি দেখিলাম জন্ম জন্মান্তর ভুলিবনা! আলোর মালায় সুসজ্জিত তাজমহল। শ্বেতশুভ্র তাজমহলের নির্মাণ কাহিনী কম-বেশি সবাই জানি। প্রাণপ্রিয় মমতাজকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখতে যমুনার তীরে প্রেমের সৌধ বানিয়েছিলেন শাহজাহান। ইন্দো-পারসিক স্হাপত্যে গড়া তাজমহল শাহজাহান ও মমতাজকে অমর করে রেখেছেন প্রেমের বন্ধনে।

তির তির করে বয়ে যাওয়া যমুনা নীরব সাক্ষী হয়ে আজও বহমান। কুড়ি হাজার শ্রমিক, বাইশ বছরের চেষ্টায় যে সৌধ বানিয়েছিলেন তা আজ বিশ্বের বিস্ময়। রাতের তারাভরা নীলাকাশের নির্জনতার মাঝে তাজমহলের রূপ অনন্য। কেয়ারি করা বাগান তাজের সৌন্দর্যকে অনেক খানি বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে হল। তাজের মাথায় দিনের প্রথম রোদের আলো থেকে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নালোকিত স্বপ্নের তাজ যেন এক রোমান্টিক অশ্রুকণাময় প্রেমাখ্যান। সকালের প্রথম আলোয় শ্বেতশুভ্র গম্বুজ কমলা রঙের আলোছায়ায় মায়াবী হয়ে ওঠে, তারপর বদলে যেতে থাকা আলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে মেলে ধরে তাজ। হোটেলের মালিক বললেন যে কোন ঋতুতে তাজ অনন্য। তবে পৃর্ণিমার রাতে অন্যরূপে ধরা দেয় তাজের সৌন্দর্য। আমাদের সৌভাগ্য দিনটা ছিল পূর্ণিমা। মায়াবী আলোয় উদ্ভাসিত মাখামাখি করে থাকা প্রেমের সৌধের রূপ বর্ণনা করা খুব সহজ নয় বলে মনে হল। কারণ তাজের রূপের বর্ণনা কখনো শেষ করা যায় না। নিঝুম অন্ধকারে জ্যোস্না মাখা তাজমহল যেন কল্পনার অধরা জগৎ। নক্ষত্রের দল তাজের গায়ে নেমে এসে খেলা করে যেন। সব মিলিয়ে তাজ হয়ে ওঠে কবিতার কোলাজ। যমুনা আর তাজমহল যেন এক দীর্ঘ রূপকথার উপাখ্যান।

রাত বাড়ছে ক্রমশ।সবাই যে যার রূমে গিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলাম, নতুন সকালের স্বপ্ন দেখতে দেখতেই। পরের দিন খুব সকালে ব্যালকোনি থেকে সকালের তাজমহলের রূপ প্রাণভরে উপভোগ করলাম। কিন্তু রাতের তাজমহলের রূপ অনন্য ও মনোমুগ্ধকর। দিনে সেটা পেলাম না বলে মনে হলো। টিফিন সেরে চলে গেলাম তাজমহলের দিকে। টিকিট কেটে নিরাপত্তা তল্লাশির বাধা টপকে কয়েক পা এগোতেই অনুভব করলাম বুকের মধ্যে এক উত্তেজনা। দু’ পাশে রক্ষীদের থাকার ঘর। লাল বেলেপাথরের তৈরি। সামনে প্রশস্ত উদ্যান সহ সুসজ্জিত বিশাল চত্বর। পায়ে পায়ে অনেকেই এগিয়ে চলেছে।যারা উল্টো দিক থেকে ফিরে আসছেন, তাদের চোখে-মুখে এক অমলিন তৃপ্তির–পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির উদ্ভাস।চত্বরে এসে বাঁ -দিকে তাকাতেই এক অনির্বচনীয় আনন্দে মন ভরে উঠল। যা কল্পনা করেছিলাম, বাস্তবে তার থেকেও অনেক গুণ সুন্দর। আকাশ জোড়া লাল বেলেপাথরের বিশাল গেট। তাতে শ্বেতপাথরের ফুল-লতাপাতার অনিন্দ্যসুন্দর কাজ। খিলানের মধ্যে দিয়ে পরিস্ফুট তাজমহলের আভাস। শিল্পীর অসাধারণ শৈল্পিক ভাবনার স্বার্থক ফসল অনিন্দ্যসুন্দর তাজমহল। বিশ্বজুড়ে তার খ্যাতি। এক কথায় বিশ্বের বিস্ময়। যেন শরমে জড়সড়ো প্রথম দেখা প্রেমিকা, নির্ভয়ে কোলে তুলে নেওয়া যায়। প্রথম দর্শনেই প্রেম। একটা মাদকতা ও ঘোর কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম।বাগিচার মধ্য দিয়ে যত এগোচ্ছি ততই প্রতি মুহূর্তে তার রূপ পালাটাচ্ছে। কেন্দ্রীয় জলাধারের চত্বরে বেশ ভিড়, ক্যামেরার ঘন ঘন ঝলকানি দেশি-বিদেশি পর্যটকরা বেঞ্চে বসে ছবি তোলাচ্ছে–তাজের সান্নিধ্যে এই মধুর অনুরণনটিকে স্মৃতিতে অমর-অক্ষয় করে রাখতে হবে। এটাই সবার ভাবনা। বিশ্বের বহু  রাষ্ট্রনায়কদের ও গুণী মানুষের পদধুলি পড়েছে এই চত্বরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাজের রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে বলে আমার মনে হল। এখন আর সে প্রথম দেখা প্রেমিকা নয়– পূর্ণ যৌবনা দয়িতা। বেলা বাড়ছে সেদিকে খেয়াল নেই। শ্বেতশুভ্র মার্বেল পাথরের বহির্গাত্রে কারুকার্যের অসামান্য বাহার প্রদর্শনকারী তাজমহল দ্বিপ্রাহরিক সূর্যের বিকিরিত কিরণের মাঝে অনন্য রূপে দণ্ডায়মান। মোগল বাদশাহ শাজাহানের কালজয়ী অমর পত্নীপ্রেমের অসামান্য নীরব সাক্ষী এই অনিন্দ্যসুন্দর সৌধ প্রাসাদ তাজ। ইসলামীয়া, পারসিক, তুর্কি, ভারতীয় প্রভৃতি বিভিন্ন স্হাপত্য–ভাস্কর্যশৈলীর অনুপম সমন্বয়ে তৈরি এই শুভ্রবসনি শৈলীটি পরিদর্শনেই অনেক সময় ব্যয় হল।

এগিয়ে গেলাম, মোকাম–কুর্মির নীচে এসে যায় উপরে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এ যেন সেই অতিপরিচিত জীবন সঙ্গিনী নয়। গম্বুজ নেই! মিনারিকা নেই!  যৌবনের যুগ্ম জয়স্তম্ভ  হারিয়ে গেছে– আছে শুধু পরিণত প্রেমের এক আন্তরিক আহ্বান। দেখতে দেখতে নানা ভাবনার স্রোত বয়ে চলেছে হৃদয় জুড়ে। সাদা মাকরান পাথরের অসামান্য ভারসাম্য সমন্বিত এই ধরনের ইমারতের তুল্য স্হাপত্য পৃথিবীতে আর একটাও নেই। মকবরার বাইরের গায়ে মূলত তিনটি রং ব্যবহৃত হয়েছে। গভীর তাৎপর্যপূর্ণ  বলে মনে হল প্রত্যেকটি রঙের ব্যবহার দেখে। তিনটি রং হল সাদা–কালো আর গেরুয়া। সাদা রং মমতাজের প্রতীক, আর কালো সে তো সাদার শ্রেষ্ঠ জবাব। শাহজানের প্রতীক কালো রং। যে কারণে কৃষ্ণতাজের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। গেরুয়া রঙ ব্যবহৃত হয়েছে ত্যাগের প্রতীক হিসাবে। তাদের বাইরের নান্দনিক সৌন্দর্যের কোন তুলনাই হয়না। সাদা মার্বেলের নকশা।সাদার উপর সাদা।ফুল-লতাপাতা বর্ণময় নকশা। শিল্প শৈলীতে যে সংযম এখানে দেখানো হয়েছে তা জাত শিল্পীর। মূল স্মৃতি সৌধের চারদিকে চারখানা মিনারিকা , তাদের আকার আয়তন আর তল বিভাগের সু বিন্যাস  এক কথায় অনন্য। পরতে পরতে বনেদিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। পদ্ম–কলসের উপর ঈদের চাঁদ।যাকে বলৈ উস্তাদো কা উস্তাদ -এর ফিনিশিং টাচ। এরপর প্রবেশ করলাম সাহজাহান ও মমতাজের সমাধিকক্ষের মধ্যে।আমি আবিষ্ট হয়ে পড়লাম। অতীতের কথকতা শুধুমাত্র স্মৃতি রোমন্থন। অষ্টভূজাকৃতি সমাধিকক্ষের কেন্দ্রে মমতাজের সমাধি আর একটু পশ্চিম ঘেঁষে সম্রাট সাহজাহানের।

 

ছবিঃ অষ্টভূজাকৃতি সমাধিকক্ষ

সমাধির চারদিকে অষ্টভূজাকৃতি জালিকরা প্রাচীর।শ্বেত পাথরের জারিরকাজ রূপোলি তারের সূক্ষ্মতাকেও হার মানায়। সমাধির উপর ধাতব বাতির ঝাড় ঝোলানো এটি মোগলশৈলীতে বানানো। উঁচুতে জালিকাজ করা গবাক্ষ দিয়ে বাইরের আলো আসছে।সিলিঙের নান্দনিক সৌন্দর্যের নকশা অপুর্ব।দেহ-মন তৃপ্ত হল। দুপুরের খাওয়া পর্ব সংক্ষেপে সেরে চলে গেলাম লালপাথরের দুর্গ দেখতে। আগ্রা ভ্রমণের মুখ্য আকর্ষণ আগ্রার লালকেল্লা। শুধু তাজমহল নিঃসন্দেহে  একমাত্র আকর্ষণ নয়। কিছু দূরে  আগ্রা ফোর্ট।

ছবিঃ আগ্রা ফোর্ট

বিশাল লাল বেলেপাথরের প্রাচীর।পরিখা পার হয়ে অমর সিং গেট দিয়ে  প্রবেশ করলাম লালকেল্লাতে। ১৫৬৫ খ্রীস্টাব্দে আকবর যখন আগ্রা কেল্লা নির্মাণ শুরু করেন তখন তিনি মাত্র তেইশ বছরের যুবক। আকবরের যে কটা স্হাপত্যকীর্তি আজও টিকে আছে এটি তার অন্যতম। একে-একে জাহাঙ্গীর মহল,মতি মসজিদ, মীনাবাজার, নাগিনা মসজিদ, মচ্ছি ভবন। দেওয়ান-ই-খাস, দেওয়ান–ই-আম, খাসমহল, শিসমহল ও মুসাম্মান বুর্জ। জাহাঙ্গির মহলের ঢুকে দেখলাম একটি সুপ্রাচীন বৈচিত্র্যময় পাথরের স্নানপাত্র ,যেটা নূরজাহান স্নান করতেন। মুসম্মান বুর্জ এই দুর্গের অন্যতম  দর্শনীয় স্থান। শাহজাহান জীবনের শেষ আট বছর দেওয়ালের মণি– মুক্তায় তাজমহলের প্রতিবিম্ব দেখে দিন কাটিয়েছেন।এই রকম নানান ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখলাম আগ্রার দুর্গের ভিতরে। আসলে আগ্রায় এসে ফতেপুর সিক্রি না দেখলে আগ্রা দর্শন সম্পূর্ণ হয়না। ইতিহাস-, শিল্প -ঐতিহ্য ও অমর প্রেমগাথায় মোড়া আগ্রা। মুকারমের সামনের দিকে পাঁচটি আর পাশের দিকে তিনটি নয় পাপড়িওয়ালা খিলান, সমতলছাদ, দু’পাশে দুটি ছত্রি। দেখে মনে হচ্ছে দিল্লির লালকেল্লার দেওয়ান-ই-খাসের সঙ্গে এর অনেক খানি মিল আছে। দুটো স্হাপত্যই হুবহু একরকম। শাহজাহান যেন  টাইপ কোয়াটার  বানিয়েছিলেন। সামনে শিসমহল দেখলাম। শুধু মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে দেহ-মনে। এত ভালো মানের গ্লাস মোজাইকের কাজ মনে হয় সমগ্র ভারতে বিরল। একটুখানি এগিয়ে মুসম্মান বার্জ–শাহজাহানের জীবনের প্রথম পর্যায়ের স্হাপত্য-কীর্তি। ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দি বৃদ্ধ সম্রাট এখান থেকেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন তাজমহলের দিকে। যমুনার তীরে তাজমহলের অবস্হান এখান থেকে ভালো ভাবে উপলব্ধি করা যায়। পাশের অলিন্দে ই তাজ দেখতে দেখতে তার জীবন দীপ নিভে যায়। একটা স্মৃতিকাতরতা আমাকে গ্রাস করলো।  কিছুটা বিষন্ন হয়ে পড়লাম। হঠাৎ মনজুড়ে একটা  অব্যক্ত বেদনা সঞ্চারিত হল। শাহজাহানের শেষ জীবনের করুন অবস্থা মেনে নিতে আমি পারিনি। এখানে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস পড়ে। সামনের মতি মসজিদের স্হাপত্যও মনোমুগ্ধকর কর। বর্তমানে আগ্রা ফোটের বেশিরভাগই সেনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে–যেখানে সাধারণ মানুষের ও পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। পড়ন্ত বিকেলে আর একবার নয়নভরে তাজমহল ঘুরে এলাম হোটেলে। রাতের খাবার পর্ব সারলাম এবং ব্যালকণিতে বসে রাতের তাজমহলের রূপ প্রাণভরে উপভোগ করতে করতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলাম।

তৃতীয় অর্থাৎ শেষ দিন সকালের টিফিন পর্ব সংক্ষেপে সেরে আগ্রা ফোর্ট থেকে যমুনা নদী পার হয়ে চলে গেলাম  ইৎমদ-উদ–দৌলা দেখতে। জাহাঙ্গিরের প্রিয়তমা মহিষী নূরজাহান তার পিতা- মাতার জন্য এই সমাধি মন্দির বানিয়ে ছিলেন। আকবরের স্হাপত্যে পৌরুষের প্রাধান্য এবং শাহজাহানের স্হাপত্যে নারীসুলভ পেলবতা লক্ষ্য করলাম। আর এই দুই ভিন্নধর্মী স্হাপত্যে শিল্পের মধ্যে এক ছোট হাইফেনের মতো ইৎমদ –উদ–দৌলা। টিকিট কেটে নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা সমাধিক্ষেত্রে ঢুকলাম। চারদিকে চাহরবাগ আর মাঝখানে বর্গক্ষেত্রের মতো দৃষ্টিনন্দন সমাধি সৌধ। ভিতরের অসাধারণ শিল্পকর্ম অপলক নয়নে দেখলাম। আসলে কাজের এমন বর্ণবৈচিত্র্যের কেরামতি শিল্পী দেখিয়েছে যে  কেবলমাত্র এক প্রজাতির ডানার সঙ্গেই তার তুলনা করে চলে। মকবরার ভিতরের দেয়ালে পাথরে খোদাই করা ‘স্টিল লাইফ’ – ফুল ভর্তি ফুলদানি,প্রসাধন সামগ্রী, পানের পাত্র,ফলের পাত্র প্রভৃতি নকশা দেওয়ালে এমনভাবে খোদাই করা যেন এটা হারেমের রঙমহল। সিলিং আর সমস্ত দেওয়াল জুড়ে নানা ভাবনার ও জাতের জটিল জ্যামিতিক নকশা। শুধু মুগ্ধতার আবেশ বুকে নিয়ে তাজমহল থেকে দশ কিলোমিটার উত্তরে আগ্রা–মথুরা জাতীয় সড়কের উপর সেকেন্দ্রা — আকবরের সমাধি। এই সমাধি সৌধের পরিকল্পনা আকবর তার জীবিত কালেই করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ করে যেতে পারেননি। জাহাঙ্গির এটি সমাপ্ত করেন। চারতলা সমাধিসৌধ ধাপে ধাপে উপরে উঠে গেছে। নীচের তিনটি তল লালপাথরের,উপরেরটি শ্বেতপাথরের। চারকোণে চারটি মিনার। সমগ্র সমাধিসৌধে ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার এক অদ্ভুত বৈচিত্র্য–দু সম্রাটের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার ফসল। দক্ষিণ তোরণ দ্বারে  ওই মিনারিকা চতুষ্টয় বিশেষ ভাবে দ্রষ্টব্য।সম্রাট আকবর যেন সেখানে দাঁড়িয়ে দু’-বাহু শূন্যে তুলে তার প্রাণের আক্ষেপ জানাচ্ছে।

দিনের শেষে তিন দিনের তাজমহল ও ফতেপুর সিক্রির বিরল মনকাড়া মনোরম স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আমরা পাড়ি দিলাম দিল্লির উদ্দেশ্যে।ফেলে আসা বর্ণময় স্মৃতি মনে করিয়ে দিল আমার মন থেকে ইতিহাসের এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়কে, যা শুধু জেনেছিলাম ইতিহাসের শিক্ষকের মুখ ও বই থেকে। আজ বাস্তবে নিজের চর্মচক্ষু দিয়ে উপভোগ করলাম। বহুদিন মনের মণিকোঠায় চিরজাগরূপ হয়ে থাকবে। এত অল্প সময়ে তাজমহলকে দেখা ও উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। হাতে যথেষ্ট পরিমাণে সময় নিয়ে ঘুরতে পারলে প্রাপ্তির  ভাণ্ডার ভরে উঠবেই–এটা আমার নিজস্ব বিশ্বাস ও উপলব্ধি। প্রকৃতির সৃষ্টির অনবদ্যতা  বারবার প্রত্যক্ষ করেছি যখন বাংলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেরিয়েছি, কিন্তু মানুষের কলানৈপুণ্য, হস্ত কারুকৃতি কীভাবে প্রকৃতির সজ্জাকে নবরূপে দান করে তার আদর্শ প্রমাণ মিললো আগ্রা সফরে। মানুষের হস্তগুণে ও বুদ্ধিমত্তায়  আগ্রার বুকে জেগে ওঠা স্মৃতিসৌধ ও দুর্গপ্রাকারগুলির মোহনীয়তা ও ঐতিহাসিক মূল্যের গাম্ভীর্য মিলে মিশে অনেক সময় যে অভূতপূর্ব অনুভূতির জন্ম দিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, আমার জীবন ইতিহাসের পাতার চারিধারে বিচরণ করে এসে নতুন করে স্বার্থকতা পেল। আমার মননের গভীরে যে চিত্র অঙ্কিত হয়ে গেছে তা হয়তো কোনদিনও মোছার নয়। প্রতিদিনের রোজনামচার  মাঝে ওই বিরল স্মৃতিগুলিই জীবনযাপনের মূল রসদ হয়ে উঠবে বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস।আর এই সফর এটাই  জীবনের বড় প্রাপ্তি।

পথনির্দেশ- 
কোলকাতা থেকে ট্রেনে (রাজধানী, কালকা এবং জয়পুরগামী ট্রেন) অথবা কোলকাতা থেকে প্লেনে দিল্লি। দূরত্ব মাত্র ২০০০ কিমি, দিল্লিও আগ্রায় থাকার জন্য আছে বহু বিভিন্ন বাজেটের লজ, গেস্টহাউস হোটেল। অনলাইনে বুকিংয়ের জন্য ওয়েবসাইটে গেলে একদমই সহজেই বুকিং। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার। উত্তর প্রদেশ সরকারের অধীনে বেশ কিছু হোটেল আছে। পরিস্কার ও পরিছন্ন। সহযোগিতা ভালো। গাড়ি পার্কিং করার ব্যবস্থা রয়েছে।

ডঃ সুবীর মণ্ডল

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com