বিস্তৃত নীল জলরাশি। পানিতে দাঁড়ানো কড়–ই-করছের সারি। স্বচ্ছ জলে হাজারো বিচিত্র মাছের ছুটে বেড়ানো। পাখির কলকাকলি। শ্যামল লতাগুল্ম কিংবা গাছপালা। দিগন্ত ঘেঁষা সবুজ পাহাড়শ্রেণি। নদী। সূর্যাস্তের অপূর্ব রূপ। প্রকৃতির নিসর্গরূপের কী নেই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া-জন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে বিপুল সম্ভাবনা আর প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযের ডালা সাজিয়ে বসে আছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি ‘মাদার ফিশারিজ’ খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিগন্তে ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত এই রামসার সাইট।
দেশের এই প্রান্তিক জনপদে বিধাতা যেন অকৃপণ হাতে বিলিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির অফুরন্ত সম্পদ, সম্ভাবনা আর অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য।
হাওরের হিজল, করছ, বল্লা, ছালিয়া, নলখাগড়া আর নানা প্রজাতির বনজ ও জলজ প্রাণী হাওরের সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই রূপসুধা আহরণে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিদেশ থেকেও ছুটে আসেন প্রতিদিন হাজার হাজার প্রকৃতিপ্রেমী।
বর্ষা আর শীত- দুই মৌসুমে নানা রূপের দেখা মেলে টাঙ্গুয়ার হাওরে। তবে শীতের বাড়তি আকর্ষণ পরিযায়ী পাখি। সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, নেপালসহ শীতপ্রধান দেশ থেকে হাজারো প্রজাতির অতিথি পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে এসে নামে বিশাল টাঙ্গয়ার হাওরের বুকে। এসব অতিথি পাখির কলকাকলি, কিচিরমিচির ধ্বনি, হাজার হাজার পাখির ঝাঁক নীল আকাশে ওড়ার দৃশ্য, হাওরের বুকে ডুব দিয়ে মাছ শিকারের চিত্র কাছ থেকে দেখে যে কারও চোখ জুড়িয়ে যায়।
শীতের রাতে পূর্ণিমা কিংবা রাতের আলো-আঁধারে আকাশে অতিথি পাখির ডাকে এক ভিন্ন রকম অনুভূতির জন্ম দেয়।
টাঙ্গুয়ার হাওরের আয়তন
সীমান্ত ঘেঁষা মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ হাওর উপজেলার প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫২টি হাওরের সমন্বয়ে ৯৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থানের কারণে জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি এটি। জলময় মূল হাওর ২৮ বর্গ কিলোমিটার এবং বাকি অংশ গ্রামগঞ্জ ও কৃষিজমি।
শুষ্ক মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্তগর্ত ৫১টি জলমহলের আয়তন ৬ হাজার ৯১২ একর হলেও বর্ষায় তার বিস্তৃতি প্রায় ২৪ হাজার একর, যেন সীমানাবিহীন বিশাল সমুদ্র। টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি প্রবাদ আছে- ছয় কুড়ি বিল আর নয় কান্দার সমম্বয়ে গঠিত হাওর পাড়ের মানুষের জীব বান্ধা। হাওরপারে ৮৮টি গ্রামে ৬০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস।
রামসার সাইট ঘোষণা
১৯৯১ সালে ইরানের রামসার নগরে অনুষ্ঠিত বিশ্বনেতাদের সম্মেলনে গৃহীত রামসার কনভেনশন অনুযায়ী টাঙ্গুয়ার হাওরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রামসার সাইটে আনা হয়। এরপর সরকারের সুনজর পড়ে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ মিঠাপানির এই হাওরের দিকে। সুন্দরবনের পর টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট হিসাবে ঘোষণা করা হয় ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি। পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বের মোট ১ হাজার ৩১টি স্থানকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রামসার সাইট ঘোষণা করা হয়, যার একটি টাঙ্গুয়ার হাওর। ২০০৫ সালে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয় এটি।
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য
টাঙ্গুয়ার হাওরে বর্তমানে প্রায় ২০৮ প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১১২ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তির পথে ১০ প্রজাতির পাখি, ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৪ প্রজাতির সাপ, ৩ প্রজাতির কচ্চপ, ২ প্রজাতির গিরগিটি ও ১ প্রজাতির উভচর এবং বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্নের দিকে প্রায় ৫৫ প্রজাতির মাছ ও ৩১ প্রজাতির পাখি তাদের শেষ আশ্রয়ন্থল হিসেবে বিশাল টাঙ্গুয়ার হাওরকে বেছে নিয়েছে।
এসব পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ইগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক, মৌলোভী হাঁস, পিয়ারী, কাইম, কালাকুড়া, রামকুড়া, মাথারাঙা, বালিহাঁস, লেঞ্জা, চোখাহাঁস, চোখাচোখি, বিলাসী শালিক, মরিচা ভুতিহাঁস, পিয়াংহাস, সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস ইত্যাদি।
এ ছাড়া রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়াল (বাংলাদেশে এর নমুনাসংখ্যা ১০০টির মতো)। ২০১১ সালে পাখি শুমারিতে এই হাওরে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮ হাজার ৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয়। কিন্তু এসব পাখি এখন আর আগের মতো নেই; দিন দিন বিলুপ্তি হচ্ছে বলে দাবি করেন বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহল।
তাদের মতামত
টাঙ্গুয়ার হাওরের ঐতিহ্য রক্ষায় অতিথি পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে। অতিথি পাখির আগমনধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এ হাওরে মাছ, পাখি শিকার বন্ধ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন কার্যকর করা না হলে বিপন্ন হবে টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্য।
পর্যটকদের কথা
টাঙ্গুয়ায় বেড়াতে আসা রফিকুল, মেহেদী হাসান, ডা. কৌষিক পাল, নিউটন রায়, ব্যবসাযী আবুল কালামসহ পর্যটকরা জানান, বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় নানা জাতের মৎস্যসম্পদ আর পাখির এক নিরাপদ আবাস্থল এটি। টাঙ্গুয়ার হাওর, যাদুকাটা নদী, বারেক টিলাসহ একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা দেখতে ঢাকাসহ দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকরা মুগ্ধ হন। আমরাও মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা না থাকায় টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে আসা পর্যটকরা কষ্টের শিকার হচ্ছেন।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল জানান, হাওরবেষ্টিত তাহিরপুর উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওর একটি মূল্যবান সম্পদ। এখানে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু পর্যটনশিল্পের সম্প্রসারণের জন্য অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন হয়নি। এ নিয়ে বারবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরের ঐতিহ্য রক্ষায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। হাওরের ক্ষতি হয় এমন কাজ করলে কোনো ছাড় পাবে না কেউ।